শুক্রবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল কলকাতার রাজনৈতিক ভাষ্যকার গর্গ চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতারির নির্দেশ দিয়েছেন। গর্গর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি চালুং সুকাফাকে চিনা আক্রমণকারী বলে বর্ণনা করেছেন।
সুকাপা কে ছিলেন?
অহোম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সুকাপা, এঁরা ৬ শতাব্দী ধরে আসাম শাসন করেন। সমসাময়িক পণ্ডিতরা সুকাপার শিকড় খুঁজে পেয়েছেন বর্মায়।
The Ahoms বইয়ের লেখক অরূপ দত্ত বলেছেন, সুকাপা ছিলেন অহোমদের নেতা। তিনি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আপার বর্মা থেকে ৯০০০ অনুগামী সঙ্গে নিয়ে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় পৌঁছন।
আসামের ইতিহাস সম্পর্কিত মান্য গ্রন্থ A History of Assam-এর লেখক স্যার এডওয়ার্ড গেইট বলেছেন ১২১৫ শতাব্দীতে সুকাপা মাউলুং ছাড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আটজন সাধু, ও ৯০০০ পুরুষ, নারী ও শিশু- য়াঁদের অধিকাংশই পুরুষ। তাঁর সঙ্গে ছিল দুটি হাতি ও ৩০০ ঘোড়া। গেইট লিখেছেন ১২৩৫ সালে সুকাপা ও তাঁর লোকজন আপার আসামের চরাইদেওতে বসবাস শুরু করেন, তার আগে বেশ কয়েকবছর তিনি এখানে ওখানে ভ্রমণ করেছিলেন, তাঁর চলার পথে যারা বাধা হয়েছিল তাদের পরাজিত করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় অস্থায়ীভাবে বাস করেন।
চরাইদেওতেই সুকাপা তাঁর রাজত্বের বীজ বরন করেন, যা পরে অহোম রাজত্বে বিস্তারিত হবে।
আজকের অহোম কারা?
অহোম রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাদের নিজস্ব ভাষা ছিল, তাঁরা নিজস্ব ধর্ম পালন করতেন। পণ্ডিতরা বলেছেন, কয়েক শতক ধরে ক্রমে অহোমরা হিন্দু ধর্ম ও অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করে নেয়।
অরূপ দত্ত বলেছেন, অহোমরা এখানকার বসবাসকারীদের ভাষা, ধর্ম ও প্রথা গ্রহণ করে নেয়, তারা নিজেদের অভ্যাস এখানকার মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়নি। গেইট লিখেছেন যারা এসেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল পুরুষ। অরূপ দত্ত বলেন এই পুরুষেরা পরে আসামের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মেয়েদের বিবাহ করেন। আজকের অহোমদের সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ লক্ষ।
আমাদের নীতি আছে, নৈতিকতা নেই: গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার
তিনি বলেন সুকুপা এখানকার বসবাসকারী জনজাতিদের সঙ্গে - বিশেষ করে সুটিয়া, মোরান ও কাচারি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। আন্তর্বিবাহের প্রক্রিয়াও এঁদের মিশে যেতে সাহায্য করেছিল।
সুকাপা এত জরুরি কেন?
বিশেষ করে আজকের দিনে সুকাপা গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জনজাতির মধ্যে মেলবন্ধনের ব্যাপের তিনি সাফল্য দেখিয়েছিলেন। তাঁকে বড় আসাম বা গ্রেটার আসামের রূপকার বলা হয়ে থাকে।
সুকাপা এবং তাঁর লোকজন ক্ষমতা, সংস্কৃতি ও ধর্মকে এক অঞ্চলের মধ্যে এমনভাবে নিয়ে আসতে পারতেন যা বিভিন্ন ধারার বহু জাতি ও জনজাতি, যারা ইতিহাসের বিভিন্ন ক্ষণে অহোম রাজাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছে, তাদের একত্রিত করতে পারত। এবং তা ঘটেছিল দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মধ্যে দিয়ে যাওয়া এক রাজনৈতিক ভাবে সংবেদনশীল এলাকায়, প্রথম অহোম রাজা সুকুপাকে আসামের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে বড় আসামের রূপকার বলে বন্দনা করা হয়, বললেন সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক সুরজ গগৈ।
সুকাপা ও তাঁর শাসনকালকে মনে রেখে প্রতি বছর ২ ডিসেম্বর আসাম জুড়েপালিত হয় অসম দিবস। গত ডিসেম্বরে এই অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সোনোয়াল বলেছিলেন, সুকাপা ছিলেন বৃহত্তর অসমিয়া সমাজের রূপকার। নিজের নীতির মাধ্যমে তিনি ব্যাপক ও জীবন্ত এক আসামের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা সুকাপা নিয়ে কী বলেছেন?
গর্গ চট্টোপাধ্যায়, যিনি নিজেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বলে বর্ণনা করে থাকেন, তিনি একাধিক টুইটে বারবার সুকাপাকে চিনা আক্রমণকারী বলে বর্ণনা করেছেন এবং প্রশ্ন তুলেছেন বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার কেন তাঁর শাসনকালকে রাজ্য দিবস হিসেবে পালন করে।
গর্গ ১৭ জুন এক টুইটে বলেন, “কেন সর্বানন্দ সোনোয়াল নিয়মিত চিনা আক্রমণকারী ও তার আক্রমণকারী সৈন্যদের নিয়ে উদযাপন করে? নিষিদ্ধ সংগঠন আলফাই বা কেন চিনা আক্রমণকারীরা উদযাপন করে? সত্যিকারের ভারতীয়রা কি জানেন যে ভারতীয়দের করের টাকা আসামের বিজেপি চিনের আক্রমণকারীদের মূর্তি বানাচ্ছে?”
অন্য এক টুইটে - যার স্ক্রিনশট পাওয়া গেলেও অনলাইনে তা নেই আর, গর্গ লিখেছিলেন, “ভারতে এক রাজ্যে রাজ্য দিবস পালন করে আসাম বিজেপি, যে দিনে চিনা বাহিনী সহযোগে চিনা আক্রমণকারীদের বর্বর ভারত আক্রমণের উদযাপন করা হয়ে থাকে। এই আক্রমণকারীকে হিরো বলে মনে করে চিনের অর্থে পালিত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি আলফাও।”
কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?
গর্গর টুইট আসামে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। একাধিক পুলিশ কেস দায়ের হয়েছে। সোনোয়াল গর্গকে গ্রেফতার করে আসাম নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আসাম পুলিশের একটি দল কলকাতা পাড়ি দিয়েছে।
গর্গর গ্রেফতারির নির্দেশ সম্পর্কিত শুক্রবার এক প্রেস বিবৃতিতে সোনোয়াল বলেছেন, "সুকাপা বৃহত্তর অসমিয়া পরিচিতির রূপকার ছিলেন এবং তাঁর সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য সহ্য করা হবে না।" সোনোয়াল বলেন, "ঐতিহাসিক তথ্যের সোশাল মিডিয়ায় ভুল ব্যাখ্যা হলে আসামের মত জাতিগত বিভিন্নতার রাজ্যে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত তৈরি করতে পারে।" তিনি আরও বলেন, অবমাননাকর মন্তব্যের ফলে "অসমিয়া মানুষের ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে"।