পৃথিবীর সবচেয়ে অরক্ষিত ভূখণ্ডের নাম সুন্দরবন। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিস্তৃত এই দ্বীপ অঞ্চল। গত ১০০ বছরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ঘূর্ণিঝড় আমফানের জেরে সুন্দরবন টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এক শতকের পুরনো এক লোকনাট্য রূপ এবংং এক বনদেবীর আরাধনা কীভাবে দ্বীপবাসীদের প্রকৃতির শক্তি ও মানুষের সীমাবদ্ধতা বুঝতে সাহায্য করল এই কঠিন সময়ে?
বন বিবি কে?
বনবিবি ও তাঁর দুই যমজ ভাই শাহ জঙ্গলির মন্দির সুন্দরবনের দিকে দিকে। জেলে, কাঁকডা়-ধরা ও মধু-সংগ্রহকারী, দ্বীপের বাসিন্দাদের এই বড় অংশ বনবিবির অনুগামী। এঁদের প্রায় সকলেই দারিদ্র্যের শিকার, যাঁরা ঘন ম্যানগ্রোভ অরণ্যে যান, তাঁদের জীবনধারনের জন্য বাঘ আর কুমিরের মত বন্য জন্তুদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। তাঁরা মনে করেন বনে প্রবেশের পর কেবল বনবিবিই তাঁদের রক্ষা করতে পারেন।
বনবিবির পালাগানের মধ্যে দিয়ে তাঁরা নিজেদের বিশ্বাসের কথা বর্ণনা করে থাকেন। সারা সুন্দরবন জুড়ে এই পালা গাওয়া হয়ে থাকে। সুন্দরবনে পার্য় ৩০টির মত দল রয়েছে, যাঁরা সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পর্যটন মরশুমে ট্যুরিস্ট লজগুলিতে এই পালা গান করে থাকেন। সাধারণত এঁরা পালাগান করেন বনবিবির মন্দিরে বা জঙ্গলের নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে। তাঁদের পালার সময়ে সৌরবিদ্যুত বা জেনারেটরের আলো জ্বালানো হয়। মানুষ এই পালাগানকে তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ বলেই মনে করেন, কারণ তাঁদের বিশ্বাস বনবিবির দয়াতেই বাঘের দেশে বেঁচে বর্তে রয়েছেন তাঁরা।
বনের আইন
বনবিবির প্রতি বিশ্বাসই মানুষের লোভ আর অধিকারকে খর্ব করে। অলিখিত নিয়ম অনুসারে দ্বীপের বাসিন্দারা জঙ্গলে প্রবেশের সময়ে বন্দুক সঙ্গে নেন না। বনের মধ্যে তাঁদের প্রবেশ কেবল জীবনধারণের প্রয়োজনে, মধু হোক কি কাঁকড়া, মাছ হোক কি চিংড়ি, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়। ধূমপান, মলত্যাগ, বাসন ধোয়া এসব কিছুই বনের মধ্যে করেন না তাঁরা। স্থানীয় উপকথা অনুসারে, চোরাশিকারী বা জলদস্যু বা যারাই বনবিবিকে অমান্য করে, তাদের বাঘের হানায় প্রাণ যায়।
প্রথা ভাঙার ঐতিহ্য
হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই বনবিবিকে একই ভাবে আরাধনা করেন। কথিত আছে বনবিবি সুন্দরবনে এসেছিলে সৌদি আরব থেকে, তাঁর সঙ্গে ছিলেন শাহ জংলি। উনিশ শতকে লিখিত বনবিবির জহুরনামা বাংলা লিপিতে লেখা হলেও, তা খোলে আরবি পদ্ধতিতে, ডান দিক দিয়ে।
আমপানের পর বনবিবির পালা তিন মাস ধরে অনুষ্ঠিত হয়নি, যা সুন্দরবনে এক রেকর্ড। যাঁরা পালাগান করেন, তাঁদের বিশ্বাস সুন্দরবনে বাঁচতে গেলে পালাগান চালাতেই হবে।