Advertisment

বিজেপির কাশ্মীর যোগ, সৌজন্যে শ্যামাপ্রসাদ

স্বাধীন ভারতের সঙ্গে জম্মু কাশ্মীরের একীকরণের প্রক্রিয়া ছিল সুদীর্ঘ এবং জটিল। বৃহত্তর ভারতের প্রেক্ষিতে রাজ্যের যথাযথ অবস্থান নিয়ে দড়ি টানাটানি চলে প্রায় ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
article 370 scrapped

জম্মু কাশ্মীরের সঙ্গে তাদের নাড়ির যোগ রয়েছে, এমনটা বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে বিজেপি, বিশেষ করে কাশ্মীর সমস্যার সঙ্গে দলের জন্মলগ্নের একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই যোগসূত্র যাঁর মাধ্যমে স্থাপিত হয়েছে, তিনি প্রখ্যাত বঙ্গসন্তান ডাঃ শ্যমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় - সুবিখ্যাত ব্যারিস্টার, শিক্ষাবিদ, এবং একদা জওহরলাল নেহরুর ক্যাবিনেট মন্ত্রী, যাঁর মৃত্যু হয় ২৩ জুন, ১৯৫৩ সালে, শ্রীনগর জেলে, যেখানে সরকারি নিষিদ্ধকরণ-নির্দেশিকা লঙ্ঘন করার অপরাধে তাঁকে বন্দী করেছিল শেখ আবদুল্লার সরকার। মৃত্যুর দু'বছর আগে, ১৯৫১ সালে, শ্যামাপ্রসাদ গঠন করেন আরএসএস-এর রাজনৈতিক শাখা, নাম হয় ভারতীয় জন সঙ্ঘ, যা কালক্রমে হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপি।

Advertisment

স্বাধীন ভারতের সঙ্গে জম্মু কাশ্মীরের একীকরণের প্রক্রিয়া ছিল সুদীর্ঘ এবং জটিল। বৃহত্তর ভারতের প্রেক্ষিতে রাজ্যের যথাযথ অবস্থান নিয়ে দড়ি টানাটানি চলে প্রায় ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। সেবছরের জুলাই মাসে দিল্লিতে নেহরু এবং তাঁর কিছু মন্ত্রীর সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন শেখ আবদুল্লা, যার পর লেখা হয় জম্মু কাশ্মীরে স্বায়ত্তশাসনের সীমারেখা নির্ধারণ করে খসড়া চুক্তি। ঠিক হয়, ভারতের তেরঙ্গার পাশাপাশি উড়বে জম্মু কাশ্মীরের পতাকা; অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের অনুমতি বিনা বাহিনী পাঠাতে পারবে না কেন্দ্র; বাকি ক্ষমতাসমূহ, যা দেশের অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের কাছে রক্ষিত থাকে, জম্মু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে রাজ্যের হাতেই থাকবে; এবং রাজ্যের 'পপুলেশন প্রোফাইল' রক্ষার্থে কোনও 'বহিরাগত' রাজ্যে জমি বা সম্পত্তি কেনাবেচা করতে পারবেন না।

কিন্তু এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না আবদুল্লা। তিনি ঘোষণা করেন, ভারতের হাতে কতটা ক্ষমতা দেওয়া হবে, এবং রাজ্যে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতার সীমারেখা কী হবে, তা নির্ধারণ করবে জম্মু কাশ্মীর সরকার। এই মর্মেই আবদুল্লা রাজ্যের তরুণ প্রশাসনিক প্রধান করণ সিং ডোগরাকে জানিয়ে দেন, তিনি যদি "প্রগতিবিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন" না করেন, তাঁর পিতা মহারাজা হরি সিংয়ের মতো তাঁকেও গদিচ্যুত করা হবে।

"প্রগতিবিরোধী গোষ্ঠী" কারা? জম্মুর হিন্দুরা, যাঁরা ভারতের সঙ্গে পূর্ণ একীকরণের সমর্থনে আন্দোলন করছেন তখন। তাঁদের স্লোগান ছিল, "এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান, দো নিশান, নহি চলেগা, নহি চলেগা (একই দেশে দুই বিধান, দুই প্রধান, দুই নিশান, চলবে ন, চলবে না)।" মহারাজার অনুগত প্রজা ছিলেন জম্মুর হিন্দুরা। তাছাড়াও তাঁদের ভয় ছিল, শেখ আবদুল্লার সমাজতান্ত্রিক ভূমি সংস্কার নীতি জম্মু পর্যন্ত পৌঁছলে কাশ্মীরের (অধিকাংশই হিন্দু) ভূস্বামীদের মতোই বিপুল পরিমাণে জমি হারাবেন তাঁরাও।

কাশ্মীরের ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিরুদ্ধে আন্দোলনে জম্মুতে বর্ষীয়ান স্থানীয় নেতা প্রেমনাথ ডোগরার নেতৃত্বে গড়ে উঠছিল প্রজা পরিষদ, যা স্থাপিত হয় ১৯৪৯ সালে। প্রজা পরিষদকে "সামন্ততান্ত্রিক প্রগতিবিরোধী" আখ্যা দিয়ে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন আবদুল্লা। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনে ১৯৫১-র জম্মু কাশ্মীর গণপরিষদের নির্বাচন বয়কট করে প্রজা পরিষদ, যার ফলে গণপরিষদের মোট ৭৫ টি আসনেই জেতে ন্যাশনাল কনফারেন্স।

আরও পড়ুন: জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, ১০ টি বিষয় যা আপনার জানা জরুরি

জম্মুর হিন্দুদের প্রতিবাদ দেশের বাকি অংশে ছড়িয়ে দাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন শ্যমাপ্রসাদ। কিংবদন্তী আইনজীবী এবং শিক্ষাবিদ তথা 'বাংলার বাঘ' স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র শ্যমাপ্রসাদ ১৯২৯ থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলেন, এবং জম্মু কাশ্মীর সহ একাধিক বিষয়ে মতের অমিল হওয়ায় নেহরুর ক্যাবিনেট ত্যাগ করেন। ২১ অক্টোবর, ১৯৫১ সালে তিনি জন সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। সদ্য গঠিত দলটি ১৯৫২-র সংসদীয় সাধারণ নির্বাচন লড়ে তিনটি আসনও জেতে।

সংসদে কেন্দ্রের কাশ্মীর নীতির তীব্র সমালোচনায় মুখর হন শ্যামাপ্রসাদ। প্রশ্ন তোলেন, শেখ আবদুল্লার মতো "বিভাজিত আনুগত্য" পোষণকারী কী করে "রাজাধিরাজ" হয়ে গেলেন, এবং জোর দিয়ে বলেন, কোনোরকম শর্ত ছাড়াই ভারতে সামিল করা হোক কাশ্মীরকে। তাঁর বিশেষ বক্তব্য ছিল, জম্মু এবং লাদাখের ভারতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একীকরণ হওয়া উচিত। ১৯৫২-র শেষভাগে জম্মু সফরে যান শ্যামাপ্রসাদ, এবং প্রজা পরিষদের "ন্যায়সঙ্গত ও দেশাত্মবোধক" আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। সেবছর সরকারের শ্রীনগর থেকে জম্মু  শীতকালিন স্থানান্তরের সময় আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ায় প্রজা পরিষদ, এবং একাধিকবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন: ৩৭০: শত্রুদের পাশে পেল বিজেপি, হাত ছাড়ল বন্ধু দল

১৯৫৩-র জানুয়ারি মাসে নেহরুকে চিঠি লিখে ভারতের সঙ্গে "সম্পূর্ণভাবে মিশে যাওয়ার" উদ্দেশ্যে পরিষদের "অত্যন্ত দেশাত্মবোধক এবং আবেগময়" আন্দোলনকে সমর্থন জানান। তিনি নেহরুর কাছে এও জানতে চান যে, পাকিস্তান দ্বারা অবৈধভাবে অধিকৃত কাশ্মীরের অংশ কীভাবে ফেরত আনবেন নেহরু, কারণ ওই ভূখণ্ড পুনর্দখল করতে না পারলে তা ভারতের "জাতীয় লজ্জা এবং কলঙ্ক" ছাড়া কিছু নয়। এছাড়াও তিনি নেহরু এবং আবদুল্লাকে বারংবার অনুরোধ করেন যেন পরিষদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কার্যকলাপ বন্ধ করা হয়, দলীয় নেতাদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, এবং সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসা হয়।

সফল হন নি তিনি। প্রধানমন্ত্রীর দাবি ছিল, পরিষদ আন্দোলন বন্ধ করুক আগে, শ্যামাপ্রসাদ চেয়েছিলেন আগে আলোচনা হোক। এই অচলাবস্থায় দিল্লির পথে আন্দোলনে নামেন শ্যামাপ্রসাদ। বিভিন্ন থানার বাইরে সত্যাগ্রহ এবং গ্রেফতার বরণ শুরু করেন জন সঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা, এবং রাম রাজ্য পরিষদের কর্মীরা। সমসাময়িক নথিপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৫৩-র এপ্রিল পর্যন্ত গ্রেফতার হন প্রায় ১,৩০০ বিক্ষোভকারী।

৮ মে, ১৯৫৩ সালে জম্মু অভিমুখে রওয়ানা দেন শ্যামাপ্রসাদ, পরবর্তী গন্তব্য শ্রীনগর। তাঁর গতিবিধির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে শেখ আবদুল্লার সরকার, কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে ১১ মে গ্রেফতার হন শ্যামাপ্রসাদ। শ্রীনগরের জেলে ঠাই হয় তাঁর।

কারাবন্দী অবস্থায় হিন্দু দর্শন পড়ে এবং চিঠি লিখে সময় কাটাতেন শ্যামাপ্রসাদ। জুন মাসের গোড়ার দিকে জ্বর এবং পায়ে ব্যথার কথা জানান তিনি। ২২ জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ২৩ জুন মৃত্যু হয় তাঁর। পরদিন তাঁর দেহ উড়িয়ে আনা হয় কলকাতায়, যেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে ছিল শোকের, সমর্থনের বন্যা। সেদিন থেকেই জম্মু কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বানানোর লক্ষ্যে শ্যামাপ্রসাদের "আত্মত্যাগকে" অনুপ্রেরণা স্বরূপ তুলে ধরে এসেছে বিজেপি।

Article 370
Advertisment