সোমবার (ডিসেম্বর ১১) সুপ্রিম কোর্ট ৩৭০ ধারা বাতিলকে বহাল রাখার রায়ের পর, অনেকেই ভারতে কাশ্মীরের 'বিশেষ মর্যাদা'-র প্রবল বিরোধী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে (১৯০১-৫৩) স্মরণ করেছেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আন্তর্জাতিক কার্যকরী সভাপতি অলোক কুমার বলেছেন, 'আজকের রায় … শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জীবন উৎসর্গের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার মত ব্যাপার।'
বিজেপির প্রাণপুরুষ
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মুখার্জি ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ, ব্যারিস্টার এবং রাজনীতিবিদ। তিনি ভারতীয় জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা, বিজেপির অগ্রদূত। তিনি হিন্দু অধিকারের দাবিতে সরব সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম। বিজেপির রাজনীতিকে তিনি অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। ২০২১ সালে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের জন্য আইনমন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল লিখেছিলেন, 'মুখার্জি ছিলেন জাতীয়তাবাদ আর অখণ্ড ভারতের প্রচারক। অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার (১৯৪৩-৪৬) সভাপতি হিসেবে ড. মুখার্জি হুসেন সোহরাওয়ার্দির ইউনাইটেড বেঙ্গল পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। সোহরাওয়ার্দির পরিকল্পনা ছিল বিশাল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে স্বাধীন বাঙালি জাতি গঠন। ড. মুখার্জি বলেছিলেন যে, সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলা আসলে হবে ভার্চুয়াল পাকিস্তান।'
জাতীয়তাবাদী বিকল্প জনসংঘ
১৯৪৭ সালে, ড. মুখার্জীকে শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী হিসাবে অন্তর্বর্তী মন্ত্রিসভায় যোগদানের জন্য পন্ডিত জওহরলাল নেহরু আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি নেহরুর মন্ত্রিসভার দুই অ-কংগ্রেসি মন্ত্রীর একজন ছিলেন (অন্যজন ছিলেন ড. বিআর আম্বেদকর)। ড. মুখোপাধ্যায় তিন বছরেরও কম সময়ের জন্য মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বিতর্কিত নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির জেরে ১৯৫০ সালের এপ্রিলে পদত্যাগ করেন। নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি হল, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। যা দুই দেশের সংখ্যালঘুদের চিকিত্সার জন্য একটি কাঠামো গঠনের কথা বলেছিল। এই সময়ের মধ্যে, তিনি হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এরপর ১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় জনসংঘ প্রতিষ্ঠা করে। যাকে তিনি কংগ্রেস পার্টির জাতীয়তাবাদী বিকল্প হিসেবে কল্পনা করেছিলেন।
ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের একীকরণের প্রবক্তা
জনসংঘের মূল বক্তব্য ছিল, ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীরের একীকরণ। ১৯৪৭ সালে মহারাজা হরি সিং ভারতে যোগদানের পর, ভারতে জম্মু-কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা চলতে থাকে। ১৯৫২ সালের গ্রীষ্মে, ভারতের স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ বছর পরে, জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লা দিল্লি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। যা জম্মু-কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখাকে চিহ্নিত করেছিল। কাশ্মীরকে তেরঙার পাশাপাশি নিজস্ব পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এর জমি বহিরাগতদের হাত থেকে সুরক্ষিত ছিল। আর, কেন্দ্রকে রাজ্যের অনুমতি ছাড়া কাশ্মীরে সশস্ত্র বাহিনী প্রেরণে নিষেধ করা হয়েছিল। সংসদে, ড. মুখোপাধ্যায় নেহেরু সরকারের জম্মু ও কাশ্মীর নীতির তীব্র সমালোচনা করেছিল। ড. মুখোপাধ্যায় জানতে চেয়েছিলেন কে শেখ আবদুল্লাহ? শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্লোগান তুলেছিলেন, 'নেহি চলেঙ্গে এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান, অউর দো নিশান।'
আরও পড়ুন- শিকে ছিঁড়ল না বসুন্ধরার, বামুনের হাত ধরেই রাজস্থানে ইতিহাস বিজেপির
একটি আন্দোলন আর অকালমৃত্যু
ড. মুখার্জি জম্মুতে হিন্দুদের রাজনৈতিক দল প্রজা পরিষদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাশ্মীরকে সম্পূর্ণরূপে ভারতভুক্ত করার দাবিতে পথে নেমেছিলেন। তিনি বারবার নেহেরু এবং শেখ আবদুল্লাহর কাছে দাবি জানিয়েছিলেন, যাতে তাঁরা প্রজা পরিষদের কর্মীদের ওপর ধরপাকড় বন্ধ করে। এই দাবিতে ড. মুখোপাধ্যায় আন্দোলনে নেমেছিলেন। ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে তিনি এই দাবিতে দিল্লির রাস্তায় আন্দোলনে নামেন। এই আন্দোলনের জেরে জনসংঘের শতাধিক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। নেহরুকে নীতি পরিবর্তন করাতে ব্যর্থ হয়ে, ড. মুখার্জি ১৯৫৩ সালের ৮ মে, জম্মুর পথে যাত্রা করেন। শেখ আবদুল্লাহ তাঁকে আন্দোলন বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও ড. মুখোপাধ্যায় শ্রীনগরে যাওয়ার চেষ্টা চালান। ১১ মে তাঁকে গ্রেফতার করে শ্রীনগর কারাগারে পাঠানো হয়। জুন মাসে, কারাগারে থাকাকালীন ড. মুখোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২২ জুন তিনি একটি বড় আকারের হৃদরোগে আক্রান্ত হন। একদিন পরে তিনি মারা যান। সঙ্ঘ পরিবারের অনেকেরই বিশ্বাস, ড. মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু কাশ্মীরের আন্দোলনকে দমন করার একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। বিজেপির ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে যে, 'কাশ্মীরকে বাকি ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার লড়াইয়ে তিনি শহিদ হয়েছিলেন।'