Advertisment

তামিলনাড়ুতে পুলিশের বর্বর অত্যাচারে বাবা-ছেলের মৃত্যু, ঠিক কী কী হয়েছিল?

চেন্নাই শহরে পুলিশ হেফাজতে থাকা অভিযুক্তদের হাত-পা ভাঙা ছবি প্রকাশ করা স্বাভাবিক ঘটনা। থানায় পিছল শৌচাগারের জন্য এ ধরনের হাত-পা ভাঙার কারণ বলে বলা হয়ে থাকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Tamilnadu Father Son Death In police Custody

ঐতিহাসিক ভাবেই তামিলনাড়ু পুলিশ তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও থার্ড ডিগ্রি অত্যাচারের জন্য কুখ্যাত

তামিলনাড়ুর থুতুকুড়ির কাছে সতনকুলাম শহরে হেফাজতে অত্যাচারের কারণে মৃ্ত্যুর অভিযোগ নিয়ে উত্তাল সে রাজ্য। বুধবার তামিলনাড়ু ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন রাজ্যে কাজ বন্ধ রাখেন। মৃত পিতা-পুত্র দক্ষিণ তামিলনাড়ুর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব সম্পন্ন নাদার সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।

Advertisment

পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু কীভাবে ঘটল?

সতনকুলাম শহরে নিজের মোবাইলের দোকান ছিল ৬২ বছরের পি জয়রাজের। তাঁকে ১৯ জুন পুলিশ হেফাজতে নেয়।

অভিযোগ, ১৮ জুন একটি পুলিশের টহলদারি দল যখন লকডাউনের নিয়ম মেনে তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করতে বলছিল, তখন কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন জয়রাজ। একজন অটো ড্রাইভার পুলিশকে সে কথা জানায় এবং পরদিন পুলিশের একচি দল গিয়ে তাঁকে হেফাজতে নেয়। উত্তেজিত পুলিশের একটি দল জয়রাজকে হেফাজতে নেওয়ার পর তাঁর ছেলে ৩২ বছর বয়সী জে বেনিক্স পুলিশের দলটিকে অনুসরণ করে থানায় যান।

একজন বরিষ্ঠ পুলিশ আধিকারিক জানিয়েছেন, বেনিক্স দেখেন তাঁর বাবাকে শারীরিক লাঞ্ছনা করছে এক অফিসার। উত্তেজিত বেনিক্স ওই অফিসারকে প্রশ্ন করেন তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেন বা তাঁর ষাটোর্ধ্ব বাবাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। এই আধিকারিকের কথায়, এর ফলে গোটা পুলিশের দল উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তারা বাবা-ছেলেকে ঘন্টার পর ঘণ্টা মারধর করে। এই অত্যাচারী দলে ছিল দুই সাব ইন্সপেক্টর ও দুই কনস্টেবল। ওই ঘটনার সময়ে থানায় উপস্থিত ছিল মোট ১৩ জন আধিকারিক, এর মধ্যে ছিল পুলিশ বান্ধব স্বেচ্ছাসেবকরাও।

লকডাউন ভাঙার অভিযোগ প্রমাণিত হলে জয়রাজ খুব বেশি হলে তিন মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতেন।

পরদিন কী হল?

মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর জয়রাজের পরিবারের মানুষজনকে পরদিন সকালে বাবা ছেলেকে দেখতে দেওয়া হয়, তখন তাঁদের অবস্থা ভাল নয়। তাঁদের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে য়াওয়া হয়। জয়রাজের লুঙ্গি ও বেনিক্সের প্যান্ট ছিল রক্তে ভেজা। ব্যাপক রক্তপাতের জন্য বারবার দুজনের লুঙ্গি বদলাতে হয়। পুলিশ পরিবারের লোকজনকে গাঢ় রঙের লুঙ্গি আনতে বলেছিল।

তিনঘণ্টা হাসপাতালে কাটানোর পর দুজনকে ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করা হয়। জয়রাজের শ্যালক এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি বলেন, বিল্ডিংয়ের দোতলা থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের দলের দিকে হাত নাড়েন ম্যাজিস্ট্রেট। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দুজনকে কোভিলপত্তি উপ কারাগারে পাঠানো হয়।

২২ জুন সন্ধে পর্যন্ত পরিবারের কাছে বাবা-ছেলের কোনও খবর ছিল না। এরপর সেদিন সন্ধেয় সরাকরি হাসরাতালে দুজনকে ভর্তি করা হয়। ক্রমাগত রক্তক্ষরণ এবং শরীরের বাইরের ও ভিতরের আঘাতের জেরে বেনিক্স ২২ জুন সন্ধের পর মারা যান, জয়রাজ মারা যান ২৩ জুনের ভোরে।

 কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে?

দুটি এফআইআর দাখিল করা হলেও কোনও অফিসারের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ করা হয়নি। ব্যাপক বিক্ষোভের জেরে দুই সাপ ইনস্পেক্টর সহ চারজনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। স্টেশন অফিসারকে বদলি করা হয়েছে। বিচারবিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে, বন্ধ খামে পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে মাদ্রাজ হাইকোর্টে আদালত পুলিশ রিপোর্টের অপেক্ষা করছে।

রাজ্য সরকার নিহতের পরিবারের জন্য ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছে। ডিএমকে-র থুতুকোটির সাংসদ কানিমোঝি পরিবারের জন্য ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলেছেন।

কোনও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ রয়েছে?

জয়রাজের পরিবার নাদার সম্প্রদায়ভুক্ত। বহু সাক্ষীর বয়ান, মৃতদের আত্মীয়দের বয়ান এবং পুলিশের বয়ান থেকে দেখা যাচ্ছে এর সঙ্গে সরাসরি কোনও সাম্প্রদায়িক যোগাযোগ নেই। গোটা ঘটনা পুলিশ আধিকারিকদের বর্বর প্রতিশোধের জেরে হয়েছে। প্রথমত পুলিশের টহলদারি দলের সম্পর্কে জয়রাজ যে মন্তব্য করেছিলেন বলে অভিযোগ এবং দ্বিতীয়ত যে পুলিশ আধিকারিক তাঁর বাবাকে মারছিলেন তাঁকে শারীরিক ভাবে আটকানো ও ধাক্কা দেওয়ার ব্যাপারে বেনিক্সের সম্পর্কে যে অভিযোগ - তারই প্রতিক্রিয়ায় পুলিশএই বর্বরোচিত কাজ করেছে।

তামিলনাড়ু পুলিশ কি এরকম ঘটনা ঘটিয়েই থাকে?

ঐতিহাসিক ভাবেই তামিলনাড়ু পুলিশ তাদের স্বেচ্ছাচারিতা ও থার্ড ডিগ্রি অত্যাচারের জন্য কুখ্যাত। সিনিয়র অফিসাররা এটাকে ব্রিটিশ জমানা থেকে চলে আসা সাধারণ অভ্যাস বলে মনে করেন।

চেন্নাই শহরে পুলিশ হেফাজতে থাকা অভিযুক্তদের হাত-পা ভাঙা ছবি প্রকাশ করা স্বাভাবিক ঘটনা। থানায় পিছল শৌচাগারের জন্য এ ধরনের হাত-পা ভাঙার কারণ বলে বলা হয়ে থাকে। ম্যাজিস্ট্রেটর কাছেও একই কারণ দর্শানো হয়ে থাকে, অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত শাস্তিদানের এই প্রক্রিয়া স্বাভাবিকত্ব অর্জন করেছে সেখানে। অন্য অনেক রাজ্যের মতই এখানেও শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন পুলিশ কর্তা এ ধরনের বিচার বহির্ভূত প্রক্রিয়া সমর্থন করে থাকেন। অপরাধী এবং তার উৎস সম্পর্কে জানাবোঝায় খামতির কারণেই তাঁদের বোঝাপড়ায় এ ধরনের ভুল থেকে থাকে।

বিচারবিভাগ কি এ ঘটনায় ব্যর্থ?

মাদ্রাজ হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কে চান্দ্রুর কথায়, জরুরি অবস্থার সময়েও মানুষ আদালতের দ্বারস্থ হতে পারতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক লকডাউন গোটা ক্ষমতা পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছে। হাইকোর্ট যখন নিজে বলে অতিমারী জরুরি অবস্থার সমতুল্য এবং আধিকারিকদের হাতে অধিক ক্ষমতা দিতে হবে, তখন ভুল বার্তা পৌঁছয়। অসংখ্য ঘটনার উদাহরণ রয়েছে যেখানে দেখা যাবে তারা নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ।

এই ঘটনায় বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন প্রাক্তন বিচারপতী। তিনি বলেছেন, এ পরিস্থিতিতে তাঁর কাজ ছিল ক্ষত ও রক্তপাত পরীক্ষা করে পুলিশের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা, তার বদলে কোনও অভিযোগ নেই উল্লেখ করে হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন।

Human Rights tamil nadu
Advertisment