গত বছর ইজরায়েল এবং হামাসের মধ্যে ১১ দিন যুদ্ধ চলেছিল। ফের উত্তপ্ত গাজা উপত্যকা। ইজরায়েল সৈন্যদের সঙ্গে প্যালেস্তাইনের জঙ্গিদের মধ্যে শনিবার গুলি বিনিময় হয়েছে। ইজরায়েলের বিমান হানায় ১১ জন প্যালেস্তিনীয় প্রাণ হারিয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ইরান-সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী, প্যালেস্তাইন ইসলামিক জিহাদের একজন সিনিয়র কমান্ডারও আছেন। তাঁকে লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। পালটা জঙ্গিরা ইজরায়েলের শহর লক্ষ্য করে কয়েক ডজন রকেট ছুড়েছে। ইজরায়েল সেই রকেটের বেশিরভাগই এয়ার ডিফেন্সের মাধ্যমে প্রতিরোধ করেছে। পাশাপাশি, বেশ কয়েকটি বিমানহানা চালিয়েছে।
হামাসের ছায়া
ইসলামিক জিহাদ হল গাজা উপত্যকার দুটি প্রধান প্যালেস্তিনীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে একটি। এটি ছোট। ক্ষমতাসীন হামাস গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা অনেক বেশি। তবে ইসলামিক জিহাদ ইরানের থেকে সরাসরি আর্থিক এবং সামরিক সমর্থন পায়। আর, সেই জন্যই ইজরায়েলের বিরুদ্ধে রকেট হামলা ও সংঘর্ষে তাদের নাম উঠে আসছে।
হামাস, ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্যালেস্তাইন কর্তৃপক্ষের থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ দখল করেছে। এরা দরিদ্র অঞ্চলের দৈনন্দিন বিষয়গুলি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে। ইসলামিক জিহাদের এমন কোনও দায়িত্ব নেই। তাই এরা অনায়াসে জঙ্গিপনা চালাচ্ছে। মাঝে মাঝে হামাসের কর্তৃত্বকেও ক্ষুন্ন করছে।
ইসলামিক জিহাদ ১৯৮১ সালে ইসলামিক প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র তৈরির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে। এটা পশ্চিম তীর, গাজা অঞ্চলে সক্রিয়। মার্কিন বিদেশ দফতর, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সরকার ইসলামিক জিহাদকে জঙ্গি সংগঠনের তকমা দিয়েছে। হামাসের মতো ইসলামিক জিহাদও ইজরায়েলকে ধ্বংস করার শপথ নিয়েছে।
ইরানের সম্পর্ক
ইসরায়েলের চিরশত্রু ইরান ইসলামিক জিহাদকে প্রশিক্ষণ এবং অর্থ সরবরাহ করে। তবে ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর বেশিরভাগ অস্ত্র স্থানীয়ভাবে উত্পাদিত হয়। সম্প্রতি, এটি হামাসের সমতুল্য অস্ত্রাগার তৈরি করেছে, মধ্য ইজরায়েলের তেল আবিব মেট্রোপলিটন এলাকায় আঘাত হানতে সক্ষম, এমন দূরপাল্লার রকেটও এদের কাছে আছে।
শুক্রবার তেল আবিবের ঠিক দক্ষিণে শহরতলিতে বিমান হামলার সাইরেন বারবার বেজে উঠেছে। যদিও ইজরায়েলের এয়ার ডিফেন্সের কারণে কোনও রকেট ওই এলাকায় আঘাত হানতে পারেনি। অন্যতম ঘাঁটি গাজা হলেও ইসলামিক জিহাদের বেইরুট এবং দামাস্কাসেও কার্যালয় আছে। সেখানকার নেতৃত্ব ইরানের কর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। শুক্রবারই যখন ইজরায়েল গাজায় তাদের অভিযান চালাচ্ছিল, সেই সময় ইসলামিক জিহাদ গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা জিয়াদ আল-নাখালাহ ইরানি প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে তেহরানে বৈঠক করছিলেন।
কমান্ডারদের নিশানা করা
গাজায় ইসলামিক জিহাদের নেতাদের হত্যার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। শুক্রবার যে কমান্ডারকে হত্যা করেছে ইজরায়েল, সেই তাইসির আল-জাবারি আবার বাহা আবু এল-আত্তারের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। আত্তার, ২০১৯ সালে ইজরায়েলের বিমানহানায় প্রাণ হারিয়েছিলেন। গাজা উপত্যকায় ২০১৪ সালের যুদ্ধের পর থেকে ইজরায়েল হামলায় সেই প্রথম ইসলামিক জিহাদের কোনও হাই প্রোফাইল ব্যক্তিত্বের প্রাণহানি ঘটেছিল।
আল-জাবারি (৫০) আবার ইসলামিক জিহাদের 'সামরিক পরিষদ'-এর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থার সদস্য ছিল। ২০২১ সালের যুদ্ধের সময় গাজা শহর এবং উত্তর গাজা উপত্যকায় ইসলামিক জিহাদের জঙ্গি কার্যকলাপের দায়িত্বেও ছিল। ইজরায়েল জানিয়েছে, আল-জাবারি ইজরায়েলের বিরুদ্ধে অ্যান্টি-ট্যাংক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
এই সপ্তাহের শুরুতে পশ্চিম তীরে ইসলামিক জিহাদের একজন সিনিয়র কমান্ডারকে ইজরায়েল গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর তার মৃত্যু হয়। বাসাম আল-সাদি (৬২) নামে ওই কমান্ডার উত্তর-পশ্চিম তীরে ইসলামিক জিহাদের বহুদিনের কর্তা ছিল। ইজরায়েলি গণমাধ্যমের মতে, আল-সাদি পশ্চিম তীরে ইসলামিক জিহাদের সংগঠন আরও দৃঢ় করতে কাজ করছিল।
সক্রিয় ইসলামিক জিহাদ সদস্য হওয়ায় আল-সাদি ১৫ বছর ইজরায়েলের কারাগারেও ছিল। ইজরায়েল ২০০২ সালে অন্য একটি সংঘর্ষে সাদির দুই ছেলেকে হত্যা করেছিল। ওই ছেলেরাও ইসলামিক জিহাদের জঙ্গি ছিল। সেই বছরই জেনিনের পশ্চিম তীরের শহরে একটি ভয়াবহ যুদ্ধে সাদির বাড়ি ধ্বংস হয়েছিল। ইজরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান জভিকা হাইমোভিচ বলেছেন, 'আপনি একবার কমান্ডারদের আঘাত করলে, তা জঙ্গি সংগঠনের সমস্ত সংগঠনকে প্রভাবিত করে। এটি জিহাদে বাধা দেয়।'
সূক্ষ্ম ভারসাম্য
২০০৭ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে, হামাস ইজরায়েলের সঙ্গে চারটি যুদ্ধ করেছে। এই সব যুদ্ধে, হামাসকে সমর্থন করেছে ইসলামিক জিহাদের জঙ্গিরা। চলতি বছরের গোড়ার দিকে একটি অগ্নিসংযোগ ছাড়া, গত বছর ১১ দিনের যুদ্ধের পর থেকে সীমান্তটি অনেকাংশে শান্ত ছিল। বর্তমানে হামাসও ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনকে নিয়ে বিব্রত। যার জেরে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের সর্বাত্মক যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, ইসলামিক জিহাদের জঙ্গিরা রকেট ছুড়ে হামাসকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তবে, সেই হামলার দায় স্বীকার করেনি।
প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে তাদের প্রভাব বাড়াতে হামাস যুদ্ধবিরতি বজায় রেখেছে। কিন্তু, ইসরায়েল গাজা থেকে আসা সব রকেট হামলার জন্য হামাসকেই দায়ী করছে। এই পরিস্থিতি থেকে বেরোতে গেলে হামাসকে অবশ্যই ইজরায়েলে ইসলামিক জিহাদের হামলা নিয়ন্ত্রণের মত শক্ত পথে হাঁটতে হবে। পাশাপাশি, প্যালেস্তিনীয়দের ক্ষোভও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে শক্ত হাতে। কারণ, ইসলামিক জিহাদ যতই শক্তিশালী হোক, হামাসই শেষ পর্যন্ত বলে দেবে কতক্ষণ এবং কতটা হিংসাশ্রয়ী হবে বর্তমানে হাঁটা শুরু করা এই সংঘর্ষ।
আরও পড়ুন- আর দলীয় কার্যালয়ে নয়, সোমেই এসএসসির চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে শিক্ষা দফতরে বৈঠকে ব্রাত্য
তত্ত্বাবধায়ক নেতা
বর্তমান লড়াই এমন একটা সময়ে শুরু হয়েছে, যখন ইজরায়েল দীর্ঘ রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত। চার বছরেরও কম সময়ে এখানে ভোটাররা পঞ্চমবারের মত নির্বাচনের মুখোমুখি হবেন। তত্ত্বাবধায়ক নেতা ইয়ার ল্যাপিড এই গ্রীষ্মের শুরুতে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আদর্শগতভাবে বিভিন্নতায় পরিপূর্ণ এক সরকার তিনি গঠন করেছেন। যা নতুন নির্বাচনের সূত্রপাত ঘটিয়েছে।
ল্যাপিড, একজন মধ্যপন্থী প্রাক্তন টিভি সঞ্চালক এবং লেখক। ইজরায়েলের অনেকেই তাঁকে যোগ্য নেতা বলে মনে করেন না। তাঁর রাজনৈতিক ভাগ্য বর্তমানে লড়াইয়ের ওপর নির্ভর করছে। এই লড়াইয়ে হয় তিনি নিজেকে একজন যোগ্য নেতা হিসেবে তুলে ধরতে পারবেন। অথবা তাঁকে সরে যেতে হবে। ল্যাপিডকে আসন্ন নির্বাচনে লড়তে হবে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে। যিনি সামরিক বাহিনীর এক বড়মাপের আধিকারিক ছিলেন। তবে, বর্তমানে দুর্নীতির অভিযোগে বিচারধীন। নেতানিয়াহুর অবশ্য আশা, তিনি ল্যাপিডকে হারিয়ে দিতে পারবেন।
Read full story in English