বুধবার মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল ঘটিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেশে করোনা ছড়ানো নিয়ে সমালোচনায় লাগাম দিতেই কি এই রদবদল? মোদী-ব্র্যান্ড রক্ষা কি প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উদ্দেশ্য? লিখছেন সিনিয়র সাংবাদিক নীরজা চৌধুরী।
এপ্রিল থেকে প্রধানমন্ত্রী ব্যাকফুটে। কোভিড নাইনটিনের দ্বিতীয় তরঙ্গে অনেকেই অক্সিজেন এবং সরকারি প্রস্তুতির অভাবে মারা গেলেন। মৃত্যুমিছিল মেরুদণ্ড দিয়ে হিম স্রোত বইয়ে দিল। সেই সঙ্গে আরও একটা ঘটনা ঘটল। মরিয়া চেষ্টা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি হেরে গেল। চিন্তার পাহাড়ে উঠে গেলেন প্রধানমন্ত্রী। মোদী ব্র্যান্ড টোল খেল। মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়-- এই স্লোগান প্রশ্নের মুখে পড়ল। তা-ই এক ডজন মন্ত্রীকে ছাঁটলেন প্রধানমন্ত্রী, বলছেন অনেকেই। অনেকের মত, মন্ত্রীদের প্রধানমন্ত্রী এই যে সরালেন, তাতে গণ্ডগোল একটা যে আগে থেকেই চলছিল, তা-ই প্রমাণ হচ্ছে।
কিন্তু কোভিড বা ভোটে পরাজয়-- এখানে তো থেমে গেলে চলবে না! যো ডর গ্যায় উও মর গ্যায়া, পোড়-খাওয়া মোদীজির চেয়ে আর কে ভাল বোঝেন এটা। ব্যাকফুট থেকে ফ্রন্টফুটে এসে নতুন করে ইনিংস শুরু তো করতেই হবে। মারতে হবে ছক্কা-চার। উত্তর প্রদেশ সহ অনেক ক'টা ভোট দোরগোড়ায়। ফলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্যের নবীকরণ ঘটালেই এই ভাবে, মন্ত্রিসভার রদবদল করে। মত রাজনৈতিক শিবিরের অনেকের।
রদবদলে কী বোঝালেন মোদীজি?
যাঁদের জন্য সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছেন, তাঁদের দায় নিতে হবে। নির্বাচনে হারার দায় নিয়েও সরতে হবে। হর্ষ বর্ধনকে যেমন স্বাস্থ্যমন্ত্রিত্ব হারাতে হয়েছে, তেমনই বাবুল সুপ্রিয়, দেবশ্রী চৌধুরীদেরও টাটা জানাতে হয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কয়েকজন মন্ত্রীকে এই ভাবে সরিয়ে দিয়ে নিজের ভাবমূর্তি বাঁচানোর চেষ্টাকে অনেকে ভাল চোখে দেখছেন না। দায় কি শুধু এঁদের নাকি? অভিযোগ উঠেছে, পশ্চিমবঙ্গে করোনা ছড়ানোর জন্য দায়ী নির্বাচন কমিশন, তাদের অপরিণামদর্শিতার জন্য কোভিড ক্রাইসিস চরমে উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী কি তখন কোনও পদক্ষেপ করতে পারতেন না? তিনি বার বার প্রচারে এসেছেন বাংলায়, তাই দায় থেকে মোদীজি নিজে কি মুক্ত? কিন্তু ওই যে বললাম মোদী ব্র্যান্ড-- সবই তার স্বার্থে। এগোনোর পথে ওই ব্র্যান্ডই সম্বল। বিজেপি নেতারাও বোঝেন মন্ত্রিত্ব না থাকলে না থাকুক, ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেলে তো-- সব গেল। নিজেদের আত্মবলিদানের মাধ্যমে ব্র্যান্ড মোদী বাঁচাতে তাঁদের কোনও আপত্তি নেই, থাকার কথাও ছিল না।
আরও পড়ুন, কোভিডে উদাসীন বিভিন্ন দেশ, নতুন ভয়ে কাঁটা হু, কেন তাদের ধারাবাহিক সতর্কতা?
২০২২ থেকে থেকে ২০২৩ সাল-- লাইন দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে ভোট। উত্তরপ্রদেশের কথাই ধরুন, যোগী সেখানে তুমুল চাপে। আবার ধরুন উত্তরাখণ্ড, বিজেপি খুবই নড়বড়ে অবস্থায়। রাজ্যগুলিতে নির্বাচন ঝড়ের পর ২০২৪ সালে লোকসভা ভোট। উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড সহ বেশির ভাগ রাজ্যেই মোদী ছাড়া কার্যত মুখ নেই। লোকসভা তো প্রধানমন্ত্রীরই অগ্নিপরীক্ষা। এখন রাজ্যগুলির ফল থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলবে কী হতে চলেছে সেই অগ্নিপরীক্ষার রেজাল্ট। তা-ই মোদী-ব্র্যান্ডের পুনর্জীবনে আর দেরি করলে চলত না। মন্ত্রিসভার বদল অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল পুরো দস্তুর।
প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করেছেন প্রত্যেকটি রাজ্য থেকে মন্ত্রিসভায় কাউকে না কাউকে রাখতে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে অঞ্চল ভিত্তিক প্রতিনিধি রাখতে প্রধানমন্ত্রী চেষ্টা করেছেন। আবার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের (যেমন ওবিসি, দলিত, আদিবাসী) প্রতিনিধিও মন্ত্রিসভায় রেখেছেন নরেন্দ্রভাই। যেহেতু উত্তরপ্রদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা-ই সে রাজ্য থেকে মন্ত্রিসভায় মুখের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫। উত্তরপ্রদেশে ওবিসিরা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর, সে রাজ্যের লডাইয়ে মোদীর প্রয়োজন ওবিসি-শক্তি। ব্রাহ্মণ্যবাদী বানিয়ার দল বিজেপি, এই তকমা এত কিছুর পরও তাদের গা থেকে সরেনি, সেই চেষ্টাও করেছেন নরেন্দ্র মোদী। মন্ত্রিসভায় তা-ই ওবিসি মুখ ২৭ জন, যা রেকর্ড বটে।
মোদীর মসনদ-আরহণের মধ্য দিয়ে বাজপেয়ী-আডবাণী জামানার শেষ ঘোষণা হয়েছিল। তার পর ২০১৯ সালে জেন-এক্স নেতাদের জামানা শেষ হল। অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, অনন্ত কুমাররা প্রয়াত হয়েছেন। মন্ত্রিসভায় রাজনাথ সিং, নিতিন গড়করি ছাড়া পুরনো বিজেপির বড় নেতা আর নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের টিম আরও গুছিয়ে নিয়ে আগামীর লড়াইয়ে নামতে চাইছেন, স্পষ্ট রদবদল থেকে।
তবে ১০০ পার করা পেট্রোলের দাম, প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি মানুষের দারিদ্রসীমার নীচে চলে যাওয়া, লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, সংঘটিত ক্ষেত্রে প্যানডেমিকের শুরু থেকেই ধীরে ধীরে যে প্যান্ডামোনিয়ামের সূত্রপাত, তা-ই ঝড় হয়ে ওঠা। তার উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে তৃতীয় তরঙ্গের ভয়। শুধু মন্ত্রিসভা বদল করলেই কি চলবে? প্রতীকের চেয়ে বেশি কিছু করে দেখাতে হবে। মানুষের কষ্ট ঘোচানোই হতে হবে একমাত্র লক্ষ্য। অন্তত ভাল করে শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া, অবাধ দিনযাবনের আশায় এখনও রয়েছেন দেশবাসী।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন