Bharat Biotech Covaxin: আর্য-জমানায় বাড়িতে অতিথি এলে বাছুর বলি দিয়ে তার ঝোল খাওয়ানোর রেয়াজ ছিল। এই ভাবে অতিথিসৎকার করে গৃহস্থ গর্বিত হতেন। বাছুর বলি দিয়ে ওই সৎকারের জন্য অতিথির আরেক নাম গোধ্ন। ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাচ্ছে। এই লেখা গরু-বাছুর নিয়ে হলেও অতিথি নেই, আছে হামলাকারী করোনা ও তার ভ্যাকসিন। মঙ্গলবার কংগ্রেস নেতা গৌরব পাঁধীর একটি টুইটে অনেকের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়। গৌরব ওই টুইটে লেখেন, তাঁর একটি আরটিআইয়ের জবাবে মোদী সরকার জানিয়েছে, 'নবজাতক বাছুরের সিরাম থাকে কোভ্যাক্সিনে। ২০ দিনের কম বয়সি সেই বাছুর। এটা ভয়ঙ্কর, এই তথ্য আগেই উচিত ছিল জনসমক্ষে আনা।' শোরগোল-জাগানো এই টুইটের পর নড়ে চড়ে বসা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের তরফে প্রেস বিবৃতি দিয়ে দিয়ে বলা হয়, কোভ্যাক্সিনের চূড়ান্ত যে অবস্থাটি দেখা যাচ্ছে, তার মধ্যে নবজাতক বাছুরের সিরামের চিহ্ন নেই। তাদের সেই প্রেস বিবৃতির শিরোনাম: ভ্যাকসিনের মিথ বনাম সত্য।
ভ্যাকসিনের উড়ো কথা
মাছের বাজারে সে দিন হঠাৎই ভেসে এল: 'মরে গেলেও ভ্যাকসিন নেবনি ভাই, ওতে অসুখী পেত্নির অশরু (অশ্রু) আছে।' দিন কুড়ি আগে ভ্যাকসিন নিয়েছি, নিজেকে প্রেতের মতো মনে হতে লাগল এই শুনে। হাতে মাছের ব্যাগ নিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে গেলাম, প্রমাণ সাইজের রুইমাছ ব্যাগে, চুঁইয়ে টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকল। প্রতিষেধক নিয়ে আরও কত এতোল-বেতোল কথা চার দিকে, কান পাতলে সেঁদিয়ে যাবে। কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের আতঙ্ক যখন আড়মোড়া ভেঙে উঠছে, যখন ভ্যাকসিন প্রত্যেককে নিতেই হবে বলা হচ্ছে। তখন এ সব কথায় সংশয় তৈরি হলে বিরাট বিপদ!
আরও পড়ুন, করোনার চিকিৎসায় সুগারের ওষুধ কাজ করে কী ভাবে?
কী ভাবে ভাইরাস থেকে ভ্যাকসিন
প্রতিষেধক শরীরে নিলে রক্তে বাড়ে প্রতিরোধ শক্তি। ভ্যাকসিন বডিকে চেনায় ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া। অ্যান্টিবডি তৈরি করে সে। এর ফলে ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া থেকে তার জন্ম হতেই হবে। কিন্তু এই দুয়ের মাঝখানে বিরাট বদলের রাস্তা আছে একটা। ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল যেন!
ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ভাইরাসের এই রূপ-বদল প্রক্রিয়াটা কেমন? বেশ জটিল পথ। ভাইরাসকে প্রথমে বড় করতে হয়, সে জন্য ল্যাবরেটরিতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ভাইরাসের পুষ্টির জন্য উপাদান বা নিউট্রিয়েন্ট দিয়ে এক দ্রবণ প্রস্তুত করেন বিজ্ঞানীরা। ঘোড়া, গরু, ছাগল, বা ভেড়ার মতো কোনও পশুর সিরাম থাকে তাতে। আবার, চিন-নুনের মতো পদার্থও থাকে। ওই সব প্রাণীর টিস্যু থেকে যা নেওয়া হয়। দ্রবণে ভাইরাসটি প্রয়োজন মতো বড় হয়ে যাওয়ার পর ভ্যাকসিনের লক্ষ্যে আরও কয়েকটি ধাপ পেরতে হয় তাকে। এর ফলে যে দ্রবণে ভাইরাসের বৃদ্ধি হয়েছে, তার গায়ে সেটির চিহ্ন থাকে না ।
আরও পড়ুন, কিডনির কোষে কোভিডের কামড়! জানুন কী ভাবে?
কেন বাছুরের সিরাম?
প্রথমে সিরাম কী, একটু জেনে নিই। সিরাম হল এক ধরনের হলুদাভ প্রোটিন মেশা প্রায় স্বচ্ছ তরল, যা রক্ত জমাট বাঁধলে আলাদা হয়ে পড়ে। জীবাণু অথবা টক্সিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করে সিরাম। এতে থাকে অ্যান্টিবডি, অ্যান্টিজেন, হরমোন। থাকে না লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা, অনুচক্রিকারা। এবার গরুর সিরামে আসি, তবে সে জন্য মার্কিন মুলুকে যেতে হবে একটু। আমেরিকার ফুড ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওয়েবসাইটে লেখা: ভ্যাকসিনে গরুর উপাদান ব্যবহারের কারণ হল, এই কাজে অতি দরকারি রাসায়নিক পদার্থগুলি এবং এনজাইম রয়েছে গরুর শরীরে। গরু মেলেও সহজে। ওয়েবসাইট আরও বলছে, 'গরুর চর্বিতে প্রতিষেধক তৈরির উপকরণ রয়েছে। গো-পাকস্থলিতে পাওয়া যায় গ্লিসেরল, তাও ভ্যাকসিন উৎপাদনে লাগে। ভাইরাস বৃদ্ধির জন্য যে দ্রবণ তৈরি করা হয়, তাতে প্রয়োজন হয় গরুর কঙ্কালের পেশি। তাতে (গো-রক্তের) সিরাম মেশানো হয়।'
সিরাম এবং অন্যান্য ভাইরাস-পুষ্টির উপাদান কৃত্রিম ভাবেও বানানো যায়। তবে এই সব রাসায়নিক পদার্থের প্রস্তুতকারক আন্তর্জাতিক সংস্থা থের্মো ফিশার সায়েন্টিফিক-এর বক্তব্য, নবজাতক বাছুরের সিরামই কিন্তু আদর্শ, সবচেয়ে কার্যকর। ভ্যাকসিন তৈরিতে যা ৫০ বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে।
নানা প্রাণীর সিরাম ভ্যাকসিনে
শুধু গরু বা নবজাতক বাছুরের নয়, বিভিন্ন প্রাণীর সিরাম ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজে লাগে। একশ বছরের বেশি সময় ধরে ডিপথেরিয়ার ভ্যাকসিন বানাতে ব্যবহার করা হয় ঘোড়ার সিরাম। ঘোড়ার শরীরে সামান্য ডোজোর ডিপথেরিয়ার ব্যাক্টেরিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তার শরীরে এই মারণ রোগের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এর পর সেই ঘোড়ার সেরাম থেকে থেকে অ্যান্টিবডি নিয়ে ডিপথেরিয়ার ভ্যাকসিন বানানো হয়।
ভারত সত্যিই এক আজব দেশ। এখানে তিল থেকে তেলাপিয়া মাছ হয়ে যায়। গোঁফ চুরি গিয়েছে বলে চিৎকার জুড়ে দেন হেড অফিসের বড়বাবু। এখানেই গণেশ দুধ খায় প্রায় ঢকঢক করে। তাই এত কিছু ভাবনায় দাঁড়ি টেনে ভ্যাকসিনটা কুট করে নিন। করোনাদেবীর তৃতীয় তির ছুটে আসতেই পারে, তাই না!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন