Advertisment

তালিবান: এক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও নৈরাজ্যের পত্তন

আফগান মুলুকে এই তালিবানেরই এক সময় বারোটা বেজে গিয়েছিল, কিন্তু রক্তবীজ থেকে নতুন জন্ম তাদের, এটাই কি কাবুলিদের দেখার কথা ছিল নাকি?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

তালিবানের মূলের খোঁজে গেলে, পৌঁছে যেতে হবে আফগানিস্তানের সোভিয়েত শাসনে।

ছোটবেলায় মনে করতাম তালি মানে হাততালি মারায় যারা পারদর্শী, তারাই তালিবান। বড় হতে বুঝেছি তালিবান হল খুনখার জঙ্গিদলের নাম, যারা আবারও ক্ষমতায় এসেছে আফগানিস্তানে। আফগান রাজধানী কাবুলে জাঁকিয়ে বসেছে রবিবার, এখন তারা কাবুলের কান্না, আর্তনাদ… আর প্রেসিডেন্ট আশরফ ঘানি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আফগান মুলুকে এই তালিবানেরই এক সময় বারোটা বেজে গিয়েছিল, কিন্তু রক্তবীজ থেকে নতুন জন্ম তাদের, এটাই কি কাবুলিদের দেখার কথা ছিল নাকি? কোনও আন্তর্জাতিক সাহায্য, সে দেশের সরকারের মেরুদণ্ডের এই হাল, কোথায় প্রতিরোধ!

Advertisment

জেলের ঘানি এড়ানো, মৃত্যুর থেকে পালানো আশরফ ঘানির দিকে এমনই অনেক প্রশ্ন এ কে ফর্টিসেভেনের লাগাতার গর্জনের মতো উড়ে যাচ্ছে এখন। যদিও পালিয়ে যেতে যেতে সদ্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান, রক্তপাত এড়াতে পালানো ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। উনি স্পষ্ট বুঝিয়েছেন-- য পলায়তি স জীবতি… তবে একটু ইমোশনালি! কাবুল জয়ের আনন্দে তালিবানরা যখন আতরের খুশবু হয়ে উঠেছে, যে খুশবু আসলে রক্তের ভারী গন্ধই, যে আনন্দ আসলে হত্যার উল্লাস, তখন তালিবানদের নিয়ে একটু চর্চা করা যেতে পারে।

তালিবান কারা?

তালিবানের মূলের খোঁজে গেলে, পৌঁছে যেতে হবে আফগানিস্তানের সোভিয়েত শাসনে। ১৯৭৯ সালে সে দেশের দখল নিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। তখন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ জিয়া উল হক ভয় পেয়ে গেলেন, কারণ তাঁর আশঙ্কা, পাকিস্তানের বালোচিস্তানে না ঢুকে পড়ে লাল ফৌজ! তখন তিনি পাকিস্তান সেনার অন্যতম কর্তা জেনারেল আখতার আবদুল রহমানকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সমর্থন আদায়ে পাঠালেন সৌদি আরব। এর পর সৌদি এবং পাকিস্তান এক সঙ্গে তৈরি করল গেমপ্ল্যান। তার সঙ্গে এল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। কারণ আমেরিকার শত্রু সোভিয়েত, শত্রুর শত্রু আমার বন্ধুর তত্ত্ব প্রয়োগ হল। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ, সৌদি আরবের জেনারেল ইন্টালিজেন্স ডিরেক্টরেট বা জিআইডি-র যৌথ অর্থে, আর পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টালিজেন্স ইজেন্সির পাঠানো অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণে তৈরি হল সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদিন বাহিনী বা মৌলবাদী জঙ্গি দল। সে সময়, ৯০ হাজার আফগান পাকিস্তানের আইএসআইয়ের ট্রেনিংয়ে কিছু দিনের মধ্যে হয়ে উঠেছিল দক্ষ জঙ্গি বাহিনী। সেই দলেই ছিলেন মহম্মদ ওমর। ওমরই তালিবান আন্দোলনের জন্মদাতা হবেন পরে।

আরও পড়ুন কাবুলের পতন! এবার কি মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-তুরস্কের উত্থান, না চিন-রাশিয়ার প্রভাববৃদ্ধি?

অবশ্য ততদিনে সোভিয়েত শাসন আর নেই আফগানিস্তান ঘটেছে। ১৯৯৪ সাল সেটা। পাশতুন অঞ্চলে ধর্মীয় ছাত্রদের নিয়ে তৈরি ওমর গড়ে তুললেন তালিবানি আন্দোলন। তালিব শব্দটি থেকে এসেছে তালিবান, অর্থ ধর্মীয় ছাত্র। আফগানিস্তানের পূর্ব ও দক্ষিণের ইসলামিক স্কুলের ছাত্রদের নিয়েই এই রাষ্ট্রবিরোধী দলটি তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরের ওমরের নেতৃত্বে তালিবানরা দক্ষিণ ও পশ্চিম আফগানিস্তান দখল করে নিল। কিছু পর দখল করে ফেলল কবুলও। ওমর তখন দেশের সর্বেসর্বা, আমির অফ আফগানিস্তান। নারী বিরোধী, অনুদার, অরাজক, অযোগ্য প্রশাসক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করল তারা। বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ভেঙে ফেলা সেই পথেই একটি মাইলস্টোন বটে।

তালিবান শাসন কেমন ছিল?

পাঁচ বছর আফগানিস্তানে ক্ষমতায় থাকাকালে শরিয়তি আইনের কট্টর প্রয়োগ করেছিল তালিবানরা। মহিলাদের উপর নেমে এসেছিল খাঁচার অত্যাচার। তাদের প্রায় সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় তুড়ি মেরে। কাজে যাওয়া এবং পড়াশুনোয় প্রাথমিক ভাবে লাগানো হল শিকল। গৃহবন্দিত্ব, ছটফাটানো ছাড়া আর কোনও অধিকার নেই। তালিবানরা বলল, পুরুষের সঙ্গ ছাড়া মেয়েদের পথে বেরনো গুনহা। নতুন করে তালিবানের কাবুল দখলে সেই দিনগুলির আতঙ্ক ফিরিয়ে আনছে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ায় কোথাও কোথাও নাকি ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। তবে, তালিবানদের একাংশ নাকি এই পথে হাঁটতে রাজি নয়, শোনা যাচ্ছে এমনও।

তালিবান ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

চারটি দেশ তালিবানকে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্যে রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান। বাকি তিনটি-- সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, তুর্কমেনিস্তান এবং সৌদি আরব। তবে বেশির ভাগ দেশই তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। আবার চিনের মতো কয়েকটি দেশ কার্পেটের নীচ দিয়ে সমর্থন করে গিয়েছে এই জঙ্গি সরকারকে। অর্থনীতিক এবং রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রেই তালিবানের সঙ্গে কমিউনিস্ট ড্রাগনের সম্পর্ক আনঅফিশিয়াল, কিন্তু গলায় গলায় ছিল তখন। ভারত কিন্তু তালিবানের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই খড়গহস্ত। আফগানিস্তানে সোভিয়েতের আশীর্বাদধন্য প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লার সঙ্গে এ দেশের সুসম্পর্ক ছিল। নাজিবুল্লাকে যে ভাবে হত্যা করেছিল তালিবানরা, তার প্রবল সমালোচনাও করেছিল ভারত সরকার। নাজিবুল্লার মৃত্যু সত্যিই নিষ্ঠুরতার এক ভয়ঙ্কর হেডলাইন বটে।

আরও পড়ুন নাজিবুল্লার মতো মরতে চাননি, তাই হয়তো পালিয়ে বাঁচলেন ঘানি!

কী ভাবে মৃত্যু হল নাজিবের? দেশ তালিবান দখলে চলে গেলে, নাজিবুল্লা চেয়েছিলেন ভারতে পালাতে, কিন্তু হল না, গেলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের হেফাজতে। ভাবলেন-- যদি বাঁচা যায়! কিন্তু সেখানে থেকেও মুক্তি মিলল না। রাষ্ট্রপুঞ্জের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে চরম অত্যাচারে নাজিবুল্লাকে খুন করল তালিবানরা। তার পর তাঁর মৃতদেহ ট্রাকের পিছনে বেঁধে কাবুলের রাস্তায় টেনে-হিঁচড়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল আফগান রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে। দেহ লাইটপোস্টে ঝুলিয়ে দেওয়া হল সেখানেই। শাহপুর আহমদজাই, নাজিবুল্লার ভাই, তাঁরও দশা হয়েছিল ওই একই। অনেকেই মনে করছেন, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আশরফ ঘানি, ১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন সে দেশের, পালিয়ে গিয়েছেন আফগানিস্তান থেকে। রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০৯ সালে সাধারণের মৃত্যুর ৭৬ শতাংশের জন্য দায়ী তালিবান ও তার সঙ্গীরা, ২০১০ সালে যা ৭৫ শতাংশ, ২০১১ সালে ৮০ শতাংশ।

ক্ষমতা থেকে বিদায়

২০০১ সাল। আমেরিকার নেতৃত্বে তালিবান বিরোধী যুদ্ধ শুরু হলে চিত্রটা পাল্টাতে শুরু করল আফগানিস্তানে। ২০০১-এর ৭-৮ অক্টোবর রাত-- ওমরের বাড়িতে মার্কিন বোমা পড়ল, একটুর জন্য ওমর বাঁচলেন। যদিও ওমরকে আমেরিকার সেনা মারতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। ডাচ সাংবাদিক বেট দাম বলেছেন, ওমর শেষ দিনগুলিতে মার্কিন সেনা-ঘাঁটি থেকে মাত্র তিন মাইল দূরে কাবুলের উওলভেরাইনে থাকতেন। অনেকের দাবি, একটি মাটির বাড়িতে থাকতেন এই তালিবান কিং, গ্রামের লোকরা তাকে নানা রকম ভেটও পাঠাতেন বলে শোনা যায়।

শেষের বেলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল ওমর, যা গুরুতর হয়ে ওঠে, তিনি হাসপাতালে যেতে চাইতেন না, বাড়ি থেকে বেরতে চাইতেন না ভয়ে, মারা যান ২০১৩ সালে। অবশ্য ২০১৫ সালে আফগান সরকারের তরফে জানানো হয় ওমরের মৃত্যুসংবাদ, জানানো হয়, এই তালিবান প্রথম পুরুষ মারা গিয়েছেন ২০১৩-এ। ওমরের পর এই জঙ্গি সংগঠনের মাথায় বসলেন মোল্লা আখতার মনসুর, যিনি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন ২০১৬ সালে। এর পর তালিবান-কুরসিতে বসলেন মওলানা হিবাতুল্লা আখুন্দজাদা।

ফের কাবুল দখলের পর তালিবানরা অভয়বাণী দিচ্ছে। বলছে, 'ভয় পেয়ো না…' বলছে, 'তোমায় আমি চিবিয়ে খাবো এমন আমার সাধ্যি নেই'। কিন্তু… তার পর 'সবাই মিলে কামড়ে খাওয়ার ভয়টা তো বাড়ছেই'… মেরুদণ্ড দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে আফগানবাসীর, মৃত্যুর পরোয়ানাটার জন্যই এখন অপেক্ষা। কখন যে কী হয়…

Taliban Afghanistan
Advertisment