প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার ঘোষণা করে কৃষকের জয়গান লিখেছেন। কৃষকদের আন্দোলন কিন্তু শেষ হয়নি। সোমবারই কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত জানিয়ে দেন, দাবি আদায়ের এখনও বাকি। আর সে ব্যাপারেই আলোচনা করুক কেন্দ্র। না হলে তাঁরা ফিরবেন না বাড়ি। রবিবার সংযুক্ত কিসান মোর্চার তরফে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে চিঠি যায়। সেখানে দাবি, উৎপাদনের মোট খরচের উপর ভিত্তি করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সমস্ত কৃষককে দিতে হবে এবং সব ফসলেই তা চালু করতে হবে। লখনউতে এই দাবিতে মিছিলও হয় সোমবার। অর্থাৎ নব-আন্দোলনে তাঁরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই মত, উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে কৃষকদের দাবি মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে টেক্কাটি ফেলেছেন, তার সুফল বিজেপিকে ঘরে তুলতে দিতে মোটেই চান না কৃষক বিক্ষোভকারীরা। এক বছর ধরে এত মৃত্যু সত্ত্বেও আন্দোলনের যে রাশ ধরে রেখেছেন তাঁরা, আগামী লোকসভায় তার ফলাফল বিরোধীদের ভোটবাক্সে ফলুক, তারই সুচারু পরিকল্পনা। সলতে পাকানোর কাজ তো শেষ। তাতে প্রদীপশিখায় ষোলকলা পূর্ণ হওয়াটা তাঁরা দেখতে চান। যে তিনটি কৃষি আইন বিজেপি সংসদে পাশ করিয়ে ছিল, এবং প্রত্যাহারের ঘোষণা সেগুলি আন্দোলনের পুনর্নবীকরণের এই মরসুমে একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। তিন আইন হল-- ১. কৃষিপণ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য আইন, ২. অত্যাবশ্যক পণ্য সংশোধনী আইন এবং ৩. কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কৃষিপরিষেবা সংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন।
কৃষিপণ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন
সরকার দাবি করেছিল, এই আইনে কৃষক স্বাধীন হবে। কী ভাবে? এই আইনের ফলে তাঁরা মান্ডির বাইরে যেখানে খুশি, যাকে খুশি ফসল বিক্রি করতে পারবেন। কৃষকদের বক্তব্য, এর মধ্যে নতুন কিছু নেই। কারণ একটা বড় অংশের ফসলই মান্ডির বাইরে বিক্রি হচ্ছে এখনওই। ফসলের প্রাথমিক যে দাম বেঁধে দেয় সরকার, তার ভিত্তিতেই কৃষি মান্ডিতে ফসলের নিলাম হয় প্রতিদিন। এখন এই আইনের মাধ্যমে দু'রকম নিয়মের জন্ম হবে। কৃষি মান্ডিতে ন্যূনতম দাম এবং মান্ডির বাইরে আর এক দাম। তা ছাড়া, এই আইনে মান্ডি-ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যেতে পারে। কালক্রমে মান্ডি উঠে যেতে পারে। যদিও সরকার মান্ডি মানে এপিএমসি (agricultural produce market committee)থাকবে বলে আশ্বাস দিয়ে গিয়েছে, কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হননি কৃষক ও বিরোধীরা।
আইনে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা নেই। প্যান কার্ড থাকলেই কেউ ফসল নিজ-নির্ধারিত মূল্যে কিনতে পারবেন এবং তা মজুত করতে পারবেন। এই সব ব্যবসায়ীকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আবার এই আইনের বদলে রাজ্যের কোর্টে ফেলতে চাইছে কেন্দ্র। এ সম্পর্কে কৃষক-কেন্দ্র বৈঠকেগুলিতে একটি সংশোধনীর প্রস্তাবও তারা করেছিল, কাজ যদিও হয়নি। কৃষকদের বক্তব্য, প্রস্তাবিত সংশোধনীতেও বাজারের সীমায় স্পষ্টতা আসেনি।
এই আইনের ফলে বেসরকারি মান্ডিগুলির রমরমা হবে। এখনকার সরকারি মান্ডিগুলির স্থলাভিষিক্ত হবে সেগুলি। বড় ব্যবসায়ী, কর্পোরেটদের হাতে চলে যাবে কৃষিপণ্য ক্রয়ের নিয়ন্ত্রণ। পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ (মার্কেটিং) প্রোফেসর সুখপাল সিং বলছেন এমনই। এও বক্তব্য তাঁর-- এই আইনে রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকা খাটো করে দেওয়া হয়েছে। ডিঙিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের। যে কথা প্রথম থেকেই কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে বলে চলেছে বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির মুখিয়ারা। তা ছাড়া, যদি ফসল কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তা হলে কৃষকরা আদালতের দরজা খটখটাবেন কী ভাবে? না, তার কোনও ব্যবস্থা রাখা হয়নি আইনে। বলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তাঁরা এসডিএম বা ডেপুটি কমিশনারের কাছে যেতে পারবেন। পরে কেন্দ্র যে সংশোধনীর প্রস্তাব দেয়, সেখানে সিভিল কোর্টে আবেদন জানানোর কথা বলা হয়েছিল।
কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কৃষিপরিষেবা সংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন
সরকারের দাবি, এই আইনের মাধ্যমে মধ্যস্থকারীদের থেকে কৃষিব্যবস্থা মুক্তি পাবে। যদিও কৃষকদের দাবি, এতে নতুন চেহারায় মিডলম্যানের দল আবির্ভূত হবেন। তাদের থেকে রক্ষা মিলবে কী করে? কৃষকদের বক্তব্য, আইনের ধারা ২ (জি), ২ (ডি), ৩ (১) ডি), ৪ (৩), এবং ৪ (৪) অনুযায়ী নানা ধরনের মিডল ম্যান তৈরি হওয়ার আশঙ্কা।
যেমন, ধারা ২ (জি) বলছে, ফসলের উৎপাদনের আগে কৃষক ও কোনও ব্যবসায়ী (sponsor)বা তৃতীয় কোনও পক্ষের মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তির চুক্তি হবে। কৃষকদের পাল্টা সওয়াল, ওই যে তৃতীয় পক্ষের কথা বলা হয়েছে, ওই পথেই ঢুকে পড়বে মিডলম্যান।
ধারা ২ (জি) (২)-তে স্পনসর এবং ধারা ৩ (১)-এ যে 'কৃষি পরিষেবা প্রদানকারী'র কথা বলা হয়েছে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করা হয়নি আইনে। কৃষকদের এমনও মত, ধারা ৪ (১)-এ এমন ধরনের বেশ কিছু শব্দ লেখা হয়েছে, যেগুলি মধ্যস্বত্বভোগীদের ডেকে আনার পথ প্রশস্ত করবে। ধারা ১০ অনুযায়ী, 'কোনও কৃষি-গোষ্ঠী (Aggregator) কিংবা কোনও কৃষি পরিষেবা প্রদানকারী চুক্তির অংশিদার হতে পারবেন।' তাদের কৃষক এবং ব্যবসায়ী বা স্পনসরের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ সমূহ সুযোগ থাকছে। বলছেন কৃষক আন্দোলনের নেতারাই। তাঁরা এও বলছেন, বিহারে এপিএমসি আইনের (কৃষক মান্ডি) বাইরে যে কাজ শুরু হয়েছে, এতে করে গ্রামীণ স্তরে বহু টাউটের জন্ম হয়েছে। ছোট এবং বড় ব্যবসায়ীরা কৃষকদের থেকে ফসল কেনার আগাপাশতলা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে দিয়েছেন।
অত্যাবশ্যক পণ্য সংশোধনী আইন
কৃষকরা বলছেন, এই আইন শুধু কৃষক-বিরোধী নয়, মানব-বিরোধীও। গরিব-বিরোধী এবং ক্রেতাসুরক্ষা-বিরোধী। এই আইনটি বাস্তবায়িত হলে মানুষ না খেতে পেয়ে মরত। কৃষকের চাপে পড়ে, এই আইন অন্তত দু'বার বদল করেওছিল কেন্দ্রীয় সরকার। গত এক বছরে। কিন্তু বদল নয়, কৃষকরা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় ছিলেন।
১৯৬৬ সালের অত্যাবশ্যক পণ্য আইন কৃষকদের আয়ের কথা বলেনি, কিন্তু এই আইনে চাষির আয় বৃদ্ধি হবে। ভারি সুন্দর কথা বলেছে এই আইনের মুখবন্ধ। কিন্তু এই আইনের অস্ত্রে সজ্জিত ব্যবসায়ীরা যত খুশি খাদ্যপণ্য মজুত করতে পারবেন। মানে সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হয়েছে এতে। মানে, কৃষক নন, ব্যবসায়ীই স্বাধীন। ফলে বেআইনি মজুতদারির রমরমা হওয়ার আশঙ্কা দেখেছে কৃষক আন্দোলন। এই আইনকে বেআইনি মজুতদারি আইনও বলা যেতে পারে। কটাক্ষ করেছে সারা ভারত কিসান সংঘর্ষ কমিটি (AIKSCC)। এও তোপ, বড় কোম্পানিগুলিই কৃষকদের ভাগ্য নির্ধারক হয়ে উঠবে।
ভারত কিসান ইউনিয়নের নেতা জগমোহন সিং পাতিয়ালা বলছেন, আইন বাস্তবের মুখ দেখলে গ্রামীণ এবং শহুরে ক্রেতারা এর কুপ্রভাবে জর্জরিত হতেন। কারণ তাঁদের কাছেই তো গণবণ্ঠন বা পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে (PDS) খাদ্যপণ্য পৌঁছয়। এই আইন মানে তাঁদের না খেতে পেয়ে মরা। যদিও সরকার এদিকটায় গুরুত্বই দিতে রাজি ছিল না। তারা শুধু বলে যাচ্ছে এমএসপি-তে কোনও সমস্যা হবে না। আইন কিন্তু বলছে না যে গণবণ্টন বা রেশন ব্যবস্থা যেমন চলছে, চলবে। শুধু বলেছে, রেশন কিংবা সে-সম্পর্কিত কোনও নির্দেশে এই আইনে কোনও বাধা নেই। বলছেন জগমোহন।
এমএসপি ব্যবস্থার মুখ থুবড়ে পড়া, বেআইনি মজুতদারি, রেশন ব্যবস্থার অন্তর্জলির আশঙ্কা, আইন সংসদে প্রত্যাহারে তার মূলচ্ছেদ হবে। তাই কৃষকদের জয়ের প্রকৃত মাপটা সত্যিই ম্যামথ। ভারত এমনিতেই ক্ষুধার্ত। ২০২০-র গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা আন্তর্জাতিক ক্ষুধা-সূচকে ভারতের স্থান ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪। তা ছাড়া রেশন ব্যবস্থার সুফল তো আমরা লকডাউনে মজ্জায় মজ্জায় বুঝেছি। আপনার আমার রেশন বাঁচিয়েছেন তাই কৃষক আন্দোলনকারীরা। বলিদানের মিছিলে। তবে, তাঁরা বলছেন-- না-আঁচালে বিশ্বাস নেই। এবং দাবির সড়কে এগিয়েও যেতে হবে আরও। চরৈবেতির চক্কর থেকে তাঁরা মুক্তি চান না এখনই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন