দিন দু'য়েক হল কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরিয়েছে। কংগ্রেস জিতেছে। ২২৪ আসনের মধ্যে ১৩৫টি কংগ্রেসের ঝুলিতে। ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ১১৩ আসনের দরকার ছিল। তার চেয়ে ২২টি আসন বেশি পেয়েছে কংগ্রেস। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের অনুমান, দেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল সাম্প্রতিক নির্বাচনে তার সেরা ফর্মে ছিল না। জিতেছে স্রেফ স্থানীয় নেতাদের কৃতিত্বে আর, স্থানীয় সমস্যাগুলোর ওপর জোর দেওয়ার জন্যই। রাহুল গান্ধীর মত সর্বভারতীয় নেতার বদলে যে দুই প্রবীণ রাজ্য নেতা এবার কর্ণাটকে কংগ্রেসের প্রচারের মুখ ছিলেন- তাঁদের একজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দরামাইয়া। অন্যজন কর্ণাটক প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রধান ডিকে শিবকুমার। দুই নেতা প্রচারের দায়িত্বে।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লাগাম
যার অর্থই হল, দল কাউকে মুখ্যমন্ত্রী প্রজেক্ট না-করেই নির্বাচনে গিয়েছিল। প্রচারে শিবকুমার আর সিদ্দারামাইয়া একসঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন। ফলে, অন্তর্দ্বন্দ্ব বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও খবর কোথাও চাউর হয়নি। আপাতত দলের নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে ইঙ্গিত দিয়েছেন পাঁচ বছরের শাসনে আড়াই বছর করে মুখ্যমন্ত্রী থাকতে পারেন শিবকুমার ও সিদ্দারামাইয়া। যাঁদের নিয়ে এখন কর্ণাটকের রাজনীতিতে এত চর্চা, সেই-
কে সিদ্দারামাইয়া?
প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া ১৯৪৮ সালে কর্ণাটকের মাইসুরু জেলার বরুণা হোবলির এক প্রত্যন্ত গ্রাম সিদ্দারমনা হুন্ডিতে জন্মেছিলেন। মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি করে আইনের স্নাতক ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হন। সমাজতান্ত্রিক নেতা ড. রামমনোহর লোহিয়ার অনুগামী সিদ্দারামাইয়া ১৯৮৩ সালে ভারতীয় লোকদল পার্টির টিকিটে মহীশূর জেলার চামুণ্ডেশ্বরী বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে কর্ণাটকের রাজ্য রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এই ভারতীয় লোকদল ১৯৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের বিরোধী হিসেবে গঠিত হয়েছিল।
দেবেগৌড়ার দলেও ছিলেন
সিদ্দারামাইয়া কুরুবা ওবিসিদের নেতা হয়ে ওঠেন। অনগ্রসর জাতি, মুসলিম এবং দলিতদের স্বার্থকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। পরে, তিনি ক্ষমতাসীন জনতা পার্টিতে যোগ দেন এবং জনতা পার্টি বিভক্ত হওয়ার পরে, এইচডি দেবেগৌড়ার নেতৃত্বে জনতা দল (ধর্মনিরপেক্ষ) পার্টির নেতা হন। দেবেগৌড়ার সঙ্গে মতবিরোধের পর ২০০৬ সালে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। তার আগে বিভিন্ন সময়ে কর্ণাটকের অর্থমন্ত্রী এবং উপমুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন ছিলেন। তিনি কর্ণাটকে কংগ্রেস বিধায়ক দলের নেতা নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে ২০১৩ সালে কংগ্রেস ১২২টি আসনে জয়ী হয়। বিজেপিকে দূরে রাখতে পরবর্তী ২০১৮ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস ও জেডি (এস) জোট করে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন কংগ্রেস বিধায়কের সমর্থন নিয়ে বিজেপি কর্ণাটকের শাসনক্ষমতা দখল করে। সিদ্দারামাইয়া বিরোধী দলনেতা হন।
নিরাপদ আসনে প্রার্থী
কর্ণাটকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জননেতা এবং আটবারের বিধায়ক হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি সিদ্দারামাইয়া নিরাপদ আসন খুঁজতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, কুরুবা ভোক্কালিগা, বাল্মীকি উপজাতি এবং দলিতদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁর ভোটব্যাংক ক্ষুণ্ণ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি নিরাপদ বরুণা কেন্দ্রটি বেছে নেন। ২০১৮ সালে তাঁর ছোট ছেলে ড. যথীন্দ্র সিদ্দারামাইয়াকে তিনি এই আসনটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এবারের (২০২৩ সালে) বিধানসভা নির্বাচনে সিদ্দারামাইয়া বরুণার মোট ভোটের ৬০% পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
সিদ্দারামাইয়ার উত্তরসূরি
তিনি বরুণা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগেও বলেছিলেন, 'যেহেতু এটি আমার শেষ নির্বাচন হতে চলেছে, আমি তাই এখান থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি। আমি নির্বাচনী রাজনীতি থেকে অবসর নেব, যদিও আমি রাজনীতিতে থাকব।' তাঁর ছেলে ড. যথীন্দ্র এবং তাঁর নাতি ধাওয়ান রাকেশ (যার বাবা সিদ্দারামাইয়ার বড় ছেলে। তিনি ২০১৬ সালে মারা গিয়েছেন) তাঁর উত্তরসূরি হবেন বলেই সিদ্দারামাইয়া জানিয়েছেন।
ডিকে শিবকুমার
ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের নেতা ডিকে শিবকুমার। ৬০ বছর বয়সি এই নেতা ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের বাসিন্দা। তাদের মূল বাস দক্ষিণ কর্ণাটকে। দক্ষিণের এই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১৫% ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের। যৌবন থেকেই কংগ্রেসের সদস্য। কলেজে থাকাকালীন, দলের ছাত্র শাখা ভারতের জাতীয় ছাত্র ইউনিয়নে যোগদান করেছিলেন। তারপর থেকে, তিনি সংগঠনের একের পর এক পদে বসেছেন। সাতবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। ২৭ বছর বয়সে সাথানুর নির্বাচনী এলাকা থেকে প্রথম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে শিবকুমার খবরের শিরোনামে আসেন ৬১৮ কোটি টাকার সম্পদের ঘোষণা করে।
বিভিন্ন সময় মন্ত্রী
সিদ্দারামাইয়া মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি কর্ণাটক সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এছাড়াও, ২০১৮ সালে তিনি জেডি(এস)-কংগ্রেস সরকারে সেচ দফতরের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলাও রয়েছে। যার মধ্যে ৮ কোটি টাকারও বেশি অর্থ পাচারের অভিযোগে ইডি চার্জশিট দিয়েছে। পাশাপাশি, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদের জন্য সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে। ২০১৭ সালে শিবকুমার ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি আয়কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছিল। তার মধ্যে শিবকুমার নিজেই ৩৪ কোটি টাকা করফাঁকির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন।
সিবিআইয়ের এফআইআর
২০২০ সালের অক্টোবরে, সিবিআই শিবকুমারের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করেছিল। ২০১৭ সালের আগস্টে তাঁর সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৭০টি জায়গায় আয়কর দফতর অনুসন্ধান চালায়। সিবিআই অভিযোগ করেছে যে শিবকুমার কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কর্ণাটক সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী হিসেবে ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ৭৪.৯৩ কোটি টাকা বেআইনিভাবে রোজগার করেছিলেন।
আরও পড়ুন- কর্ণাটকে বিজেপির হারে কাঠগড়ায় ইয়েদুরাপ্পা, কেন তাঁর দিকেই আঙুল উঠছে?
শিবকুমার গ্রেফতার
শিবকুমারকে অর্থ পাচারের মামলায় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইডি গ্রেফতার করেছিল। এর একমাস বাদে তিনি জামিনে মুক্তি পান। তিনি ২০২০ সালে কর্ণাটক প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রধান হন। শনিবার কংগ্রেসের জয়ের খবর শুনে শিবকুমার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি বলেছেন, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী জেলে তাঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছেন। সেকথা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারবেন না। একইসঙ্গে বলেছেন, 'এই সমস্ত বিজেপির লোকেরাই আমাকে জেলে ঢুকিয়েছিল।' সিদ্দারামাইয়া এবং শিবকুমার, দুই নেতাই জানিয়েছেন, পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন তা দলের হাইকমান্ডই ঠিক করবে।