গত বুধবার লোকসভায় মহাত্মা গান্ধীর খুনি নাথুরাম গডসের প্রশংসা করে ঝড় তুলে দিয়েছেন বিজেপি সাসংদ প্রজ্ঞা ঠাকুর। এখন আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি বলছেন, তিনি কথাটা গডসের উদ্দেশে বলেননি, বলেছিলেন উধম সিংয়ের সম্পর্কে। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী বুধবারই বলেছেন, "ওঁর মাইক অন ছিল না। উধম সিংয়ের নাম নেওয়ায় উনি আপত্তি তুলেছিলেন। সে কথা উনি ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে জানিয়েছেন।" এ বছরই প্রজ্ঞা ঠাকুর গডসেকে দেশপ্রেমিক বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং তারপর ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
প্রজ্ঞা ঠাকুর মহাত্মা গান্ধীর খুনির প্রশংসা করেছিলেন ডিএমকে সদস্য এ রাজার এসপিজি সম্পর্কিত বিতর্কের মধ্যে। এ রাজা নিজের কথা বোঝানোর তাগিদে উধম সিংয়ের হাতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ওই হত্যাকাণ্ডের নায়ক ও ডায়ারের হত্যার কথা উল্লেখ করেছিলেন। রাজা বলেছিলেেন, "কোনও একজনের মৃত্যুর সঙ্গে ঝুঁকির অবসান হয় না। ফলে নিরাপত্তা সরানোর আগে নৈর্বক্তিক পরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে।"
আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: নাথুরাম গডসের মতাদর্শ ও তাঁর ভক্তকুল
বৃহস্পতিবার প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং, প্রজ্ঞা ঠাকুরের মন্তব্যের নিন্দা করেন। তিনি বলেন, "নাথুরাম গডসেকে দেশপ্রেমিক বলা তো দূরের কথা, যাঁরা গডসেকে দেশপ্রেমিক মনে করে, আমরা তাদের মতাদর্শেরই নিন্দা করি। গান্ধীর মতাদর্শ আগেও প্রাসঙ্গিক ছিল, এখনও প্রাসঙ্গিক রয়েছে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। গান্ধীজী দেশের একজন পথপ্রদর্শক।"
প্রজ্ঞা ঠাকুরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন সংসদীয় উপদেষ্টা কমিটি থেকে সরিয়ে দেবার অনুরোধ করেছেন বিজেপি কার্যকরী সভাপতি জেপি নাড্ডা। শীতকালীন অধিবেশনে বিজেপির সংসদীয় বৈঠকে যোগ দেবার ব্যাপারে প্রজ্ঞার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞা ঠাকুরকে প্রতিরক্ষা প্যানেল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কে ছিলেন উধম সিং?
উধম সিংয়ের প্রসঙ্গ এই প্রথম সংসদে উল্লিখিত হল, এমন নয়। এর আগে গত বেশ কয়েক বছর ধরে সংসদের বাইরে এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে তাঁর মূর্তি বসানোর দাবি উঠেছে। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে পাঞ্জাবের সাংসদ প্রেম সিং সংসদে উধম সিংয়ের ছবি টাঙানোর দাবি করেন। ২০১৮ সালে এই দাবিসমূহের একাংশ পূরণ হয়। বৈশাখির সময়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে উধম সিংয়ের মূর্তি স্থাপিত হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবার জন্য উধম সিংকে অনেকে নায়কোচিত মর্যাদা দিয়ে থাকেন। গান্ধী নিজে অবশ্য উধম সিংয়ের প্রতিশোধকে পাগলামি বলে অভিহিত করেছিলেন।
উধম সিংয়ের জন্ম হয় ১৮৯৯ সালে পাঞ্জাবের সাংরুর জেলায়। আমেরিকায় থাকার সময়ে তিনি গদর পার্টির সংস্পর্শে আসেন। বহু জাতিক এই দলের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯১৩ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সোহন সিং বাকনা। এ দল কিছুটা কমিউনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত ছিল। এ দলের সদর দফতর ছিল ক্যালিফোর্নিয়ায়। ভারত থেকে ব্রিটিশদের উৎখাত করাই ছিল গদর পার্টির লক্ষ্য। ১৯৩৪ সালে উধম সিং লন্ডন যান জেনারেল ও ডায়ারকে হত্যা করতে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড যখন ঘটে তখন পাঞ্জাবের লেফটেন্যান্ট গভর্নর ছিলেন ও ডায়ার। স্বভাবতই ও ডায়ারকেই এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেছিলেন উধম সিং।
আরও পড়ুন, লোকসভার অধ্যক্ষ এবং বিশৃঙ্খল সাংসদ
অনিতা আনন্দ লিখিত “A Patient Assassin” বইয়ে বলা হয়েছে ও ডায়ার এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেবার আগে দুশ্চিন্তায় ছিলে যে এর ফলে দ্বিতীয় সিপাহি বিদ্রোহের সূচনা হতে পারে।
লোকবিশ্বাস অনুসারে ওই হত্যাকাণ্ডের সময়ে উধম সিংয়ের বয়স ছিল ১৯। সে দিন তিনি আহত হয়েছিলেন, এবং মৃতদেহ দিয়ে ঘেরা অবস্থায় পরদিন সকাল পর্যন্ত পড়েছিলেন। এরপর তিনি নাকি রক্তভেজা মাটি তুলে নিয়ে কপালে মেখে হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেবার শপথ নেন।
ও ডায়ার হত্যাকাণ্ড
১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ ও ডায়ার কাক্সটন হিলসের রয়্যাল সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটিতে ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের এক বৈঠকে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর উপর হুলি চালান উধম সিং। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে গ্রেফতার করে ব্রিক্সটন জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। জেলে উধম সিং ৩৬ দিন অনশন করেন। পুলিশের কাছে বিবৃতিতে এবং আদালতে, তিনি নিজেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক হিসেবে নিজের নাম বলেন মহম্মদ সিং আজাদ। উধম সিংয়ের মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯৪০ সালের ৩১ জুলাই পেন্টনভিল জেলে তাঁর ফাঁসি হয়। ১৯৭৪ সালে তার দেহাবশেষ ভারতে নিয়ে আসা হয়। নিজের গ্রাম সুনামে তা সমাধিস্থ করা হয়।
উত্তরাখণ্ডের উধম সিং নগর জেলার নামকরণ করা হয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামীর নামে।