তিন সপ্তাহের প্রবল লড়াইয়ের পর রাশিয়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধবিরতির আলোচনায়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির অফিসের এক আধিকারিক বলেছেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলে রাশিয়ার সেনা থাকবে কি না যুদ্ধের পর, কী হবে সীমান্তরেখা, তা নিয়ে আলোচনা চলছে এখন। ইউক্রেন চাইছে, পশ্চিম ইউরোপের পরমাণু শক্তিধর দেশগুলির একটি অন্তত এই আলোচনা প্রক্রিয়ায় থাকুক এবং নিরাপত্তা নিয়ে আইনি নথিপত্রে তাদেরও সিলমোহর পড়ুক। বদলে ইউক্রেন নিউট্রাল মিলিটারি স্টেটাস বা পক্ষপাতহীন সামরিক অবস্থান নিয়ে আলোচনায় রাজি, অ্যাসোসিয়েট প্রেসকে ইউক্রেনের ওই অফিসার এমনই বলেছেন।
রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরোভ এবং তাদের প্রধান মধ্যস্থতাকারী ভ্লাদিমির মেডিনস্কি বৃহস্পতিবার প্রথম বলেন যে, ইউক্রেনের পক্ষপাতহীন সামরিক অবস্থানের বিষয়টি রয়েছে আলোচনার টেবিলে। তবে, এ ব্যাপারে কোনও চুক্তিতে পৌঁছানো যাবে কি না, তা মোটেই স্পষ্ট হয়নি এখনও। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের বড় অংশের মতে, রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইন এবং তাদের অঙ্গীকার ভেঙে ইউক্রেনে ঢুকে পড়েছে। পাল্টা, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্য, পূর্ব ইউরোপে নেটো যাতে আর ডাল না মেলতে পারে সেটা দেখা তাঁদের কর্তব্য।
এখানে বলে নিতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, তখন প্রবল শক্তিধর, ১৯৪৯ সালের ৪ এপ্রিল নেটো আত্মপ্রকাশ করে। মূলত সোভিয়েতের এই দবদবায় সুরক্ষাসঙ্কটে ভোগা দেশগুলো এক হয়ে এটি গঠন করেছিল। নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন, এটা হল নেটোর (NATO) পুরো কথা। ১০টি ইউরোপীয় দেশ এবং আমেরিকা ও কানাডা মিলে এটি গঠন করে। সম্মিলিত নিরাপত্তার চুক্তি হয়েছিল এতে। মানে, নেটোর কোনও দেশ আক্রান্ত হলে, নেটোভুক্তদেশগুলি মিলিত ভাবে তা প্রতিহত করবে।
নেটোর হেডকোয়ার্টার হল বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে। পূর্ব ইউরোপে ঢুকবে না নেটো, প্রাথমিক এমন চুক্তি থাকলেও, তা ভঙ্গ করা হয়েছে। গঠনের পর আরও ১৮টি দেশ নেটোয় যোগ দিয়েছে। যদিও নেটোয় অন্য সব দেশ যা সামরিক খরচ করে, তার যোগফলেরও চেয়েও বেশি আমেরিকার খরচখরচা। এ নিয়ে সমালোচনাও হয়, কিন্তু আমেরিকা তাতে তা পাত্তা দেয় না। এ সব মিলিয়েই রাশিয়ার সুরক্ষাসঙ্কট বেড়েছে। এখন ইউক্রেন যদি নেটোয় ঢোকে তা হলে তো সেই সঙ্কট চরমে উঠবে, ফলে সেই সম্ভাবনা ঘনিয়ে ওঠায় এই রুশ হামলা।
রাশিয়া থেকে বাঁচতে ইউক্রেন নেটোকে চাইছে, আবার, নেটো থেকে বাঁচতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করেছে। ইউক্রেন যাতে পক্ষপাতহীন অবস্থায় থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়, মানে নেটোয় না ঢোকে, তা হলে রাশিয়ার কার্যসিদ্ধি হবে। ফলে ওই নিউট্রাল মিলিটারি স্টেটাসের এই সামরিক ও কূটনৈতিক চাপ। পক্ষপাতহীন সামরিক অবস্থান বলতে ঠিক কী বোঝানো হয় এখন? নাম থেকেই স্পষ্ট, বিবদমান পরিস্থিতিতে যে দেশ কোনও পক্ষে থাকবে না, সেই দেশের সামরিক অবস্থানকে পক্ষহীন বলা হয়ে থাকে।
সুইৎজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, যাদের সংবিধানেই পক্ষহীন অবস্থানের কথা লেখা রয়েছে। এছাড়াও সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডও এই তালিকায়। বেলজিয়াম, যার রাজধানী ব্রাসেলসে নেটোর সদর দফতর, তারাও এক সময় নিউট্রাল দেশ ছিল। সুইৎজারল্যান্ডকে এই পথে একটি স্মারক হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। কারণ, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ না দিয়ে এই ইউনিয়নের বিরুদ্ধে থাকা দেশগুলির হয়ে মধ্যস্থকারীর ভূমিকা পালন করেছিল। তারা রাষ্ট্রপুঞ্জেও যোগ দিয়েছে মাত্র ২০ বছর আগে। যদিও রাষ্ট্রপুঞ্জের ইউরোপীয় সদর দফতর সে দেশে রয়েছে বহু কাল।
আরও পড়ুন- চরম আক্রমণ শুরু রাশিয়ার, পরপর বিস্ফোরণে ইউক্রেনে মৃত্যুমিছিল
কিন্তু সেই সুইৎজারল্যান্ড রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের জারি করা নিষেধাজ্ঞার পক্ষে রয়েছে। প্রতিবেশী নরওয়েতে নেটোর শীতকালীন সেনা মহড়ায় অংশ নিতে দেখা গিয়েছে সুইডিশ সেনাকে। ফিনল্যান্ডও অনেক দিন নেটো যোগের বিরুদ্ধে ছিল, কিন্তু রাশিয়ার ইউক্রেন হামলায় তারাও নিজেদের অবস্থান বদল করছে। রাশিয়ার বন্ধু বলে পরিচিত দেশগুলির অনেকেই এই ভাবে নেটোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তার কারণ তারা আশঙ্কিত পুতিন তাদের পুঁতে না দেন। দখল রাশিয়ার হাতে চলে না যায়।
ফলে যে আশঙ্কা থেকে পুতিনের ইউক্রেন হামলা, তা হয়তো ছলে-বলে-কৌশলে এখন মিটে যাবে, নেটোর নাগাল থেকে ইউক্রেনকে সরিয়েও আনা যাবে আপাতত, কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে ইউরোপ জুড়ে, তাতে নেটো আসলে এই রুশ হামলায় অনেক গুণ শক্তি সঞ্চয় করে ফেলছে। পুতিন সামরিক ভাবে সফল হবেন হয়তো, কিন্তু কূটনৈতিক পথে তাঁর ব্যর্থতা সীমাপরিসীমাহীন, যা হয়তো রাশিয়াকে দুর্বল এবং অস্তিত্বের সঙ্কটে আরও ভোগাবে আগামীতে।
Read story in English