১৯৯০ থেকে শুরু। প্রতি দশকে এক বার আন্দোলনে গর্জে উঠেছে ইউক্রেন। রাশিয়ার ফৌজ যখন সে দেশে এগিয়ে চলেছে, রাজধানী কিয়েভকে ঘিরে ফেলেছে তিন দিক থেকে। কিয়েভের একাংশ ধ্বংসস্তূপ। তখন ইউক্রেনের আন্দোলন-কথায় নজর রাখা যেতে পারে।
গ্র্যানাইট আন্দোলন
অক্টোবর, ১৯৯০। তখনও ইউক্রেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ। প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হল সে দেশে। নেতৃত্বে এক দল ছাত্র। রাশিয়া থেকে মুক্তির দাবিতে তাঁরা সোচ্চার। কিয়েভের ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কোয়ারে তাঁরা তাঁবু খাটিয়ে বসে পড়ে। স্কোয়ারের গ্র্যানাইট পাথরের উপর সেই তাঁবু তৈরি হল বলে আন্দোলনের ওই নাম। ছাত্রদের স্লোগান ছিল, কমিউনিজম থেকে মুক্তি চাই। চার দিকে ভরে গিয়েছিল পতাকায়। লেখা ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাঁচার চেয়ে মৃত্যু ভাল। বিরাট বিরাট মিছিল হয়েছিল এই আন্দোলনের পক্ষে। ক্রেমলিন বুঝতে পারছিল না কী ভাবে এর মোকাবিলা করবে। সেই দাবিই মিটল, বেশি দিল লাগলও না। ১৯৯১ সালে, গণভোট হয়েছিল ইউক্রেনে, সেখানে ৯০ শতাংশই চেয়েছিল সোভিয়েত থেকে বেরিয়ে আসতে। যদিও গ্র্যানাইট আন্দোলন কথা আর তেমন শোনা যায় না।
কমলা আন্দোলন
নভেম্বর ২০০৪ থেকে জানুয়ারি ২০০৫। লাগাতার আন্দোলন চলেছিল ইউক্রেনে। ২০০৪ সে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিগিং হয়েছে, এই অভিযোগ। সেই বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ইনুকোভিক, যিনি ছিলেন রাশিয়ার হাতের পুতুল। নির্বাচন কমিশন তাঁকে জয়ী ঘোষণা করে দিয়েছিল, আমেরিকা এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও। তার পরই আন্দোলন শুরু হয়। সেই প্রতিবাদের জেরে নতুন করে নির্বাচনের নির্দেশ দেয় ইউক্রেনের সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়, ইউক্রেনে বিশাল বিভাজন। এক দল রাশিয়ার পক্ষে, এক দল বিরুদ্ধে।
মর্যাদার জন্য আন্দোলন
রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের দ্বন্দ্বের ফল এই মর্যাদার জন্য আন্দোলন বা ময়দান রেভোলিউশন। এরও কেন্দ্রে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইনুকোভিক। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ২০১০-এ জেতেন ইনুকোভিক, তিনি হারিয়ে দিয়েছিলেন তাইমোশেঙ্কোকে। সেই নির্বাচন বিদেশি পর্যবেক্ষকের মতে ছিল ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার। কিন্তু ক্রমে ছবিটা বদলাতে শুরু করল। ২০১৩ সালের নভেম্বরে বিরাট বিক্ষোভ দেখা গেল ইউক্রেনে। মুক্ত বাণিজ্য নিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে চুক্তি করতে অস্বীকার করেছিলেন, সেটাই আন্দোলনের তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে সামনে আসে। ২০১৪-র ফেব্রুয়ারিতে বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধল। ১৮ পুলিশ কর্মী সহ ১৩০ জন নিহত হলেন সংঘর্ষে।
ফেব্রিয়ারির ২১ তারিখ, প্রেসিডেন্ট ইনুকোভিক এবং সংসদের বিরোধীদের মধ্যে চুক্তি হয়। তাতে নির্বাচন এগিয়ে আনা এবং অন্তর্বর্তী ঐক্য সরকার গঠনের কথা বলা হয়। কিন্তু পরের দিনই তিনি ইউক্রেন ছেড়ে পালান। বলেন, তাঁর গাড়িতে গুলি চালানো হয়েছে। ক্রিমিয়া পেরিয়ে দক্ষিণ রাশিয়া, আশ্রয় নেন সেখানে। এ পর্যন্ত রুশ আশ্রয়েই তিনি রয়েছেন। ২০১৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, মানে বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর চুক্তির পর দিন, ইনুকোভিককে বরখাস্ত বা ইমপিচ করে ইউক্রেনের সংসদ। তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তোলা হয়। ইনুকোভিক ওই ইমপিচমেন্ট ভোটকে অস্বীকার করেন। রাশিয়াও করে।
রাশিয়ার সঙ্গে লাগাতার দ্বন্দ্ব। ইউক্রেনের বড় একটা অংশ রাশিয়ার সঙ্গে থাকার পক্ষে, আবার একটা বড় অংশ এর বিরুদ্ধে। সেই দ্বন্দ্বেই স্ফূলিং, স্ফুলিং থেকে বিদ্রোহের আগুন। যা এখন দাবানল। রাশিয়া সেই বিদ্রোহকে পুঁজি করেই ইউক্রেনকে হাতের মুঠোয় করতে মরিয়া।