গত সপ্তাহে গোয়াবাসীদের সম্পত্তি সংক্রান্ত এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট গোয়াকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির এক উজ্জ্বল উদাহরণ বলে বর্ণনা করে বলেছেন, সংবিধান প্রণেতারা দেশে সকলের জন্য এক আইনের কথা আশা ও প্রত্যাশা করেছিলেন, কিন্তু তেমনটা প্রণয়নের কোনও চেষ্টা করেননি।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কী?
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির অর্থ সারা দেশের সকলের জন্য এক আইন, যা সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত বিষয়, যেমন বিবাহ, উত্তরাধিকার, দত্তক ইত্যাদি সমস্ত ব্যাপারেই লাগু হবে। সংবিধানের ৪৪ নং অনুচ্ছেদে বলা রয়েছে, রাষ্ট্র সারা দেশের নাগরিকদের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি আইন লাগু করার প্রচেষ্টা করবে।
৪৪ নং অনুচ্ছদে নির্দেশাত্মক নীতির কথা বলা হয়েছে। ৩৭ নং অনুচ্ছেদে দেওয়া সংজ্ঞা মোতাবেক এ বিষয়টি কোনও আদালতে দ্বারা লাগুযোগ্য নয়, এর নীতিগুলি প্রশাসনের মৌলিক ভিত্তি। মৌলিক অধিকার আদালত দ্বারা লাগু করা যেতে পারে। ৪৪ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র প্রচেষ্টা করবে, নির্দেশাত্মক নীতি সম্পর্কিত অন্যান্য অনুচ্ছেদগুলিতে বিশেষ ভাবে প্রয়াস, নির্দিষ্ট ভাবে এই নীতির লক্ষ্যে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব ইত্যাদি বলা হয়েছে। ৪৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র নির্দিষ্ট আইন প্রয়নের চেষ্টা করবে, কিন্তু ৪৪ নং অনু্চ্ছেদে নির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কথা নেই। এ থেকে স্পষ্ট ৪৪ নং অনুচ্ছেদে যে নির্দেশাত্মক নীতির কথা বলা হয়েছে, তার তুলনায় অন্য নির্দেশাত্মক নীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্তব্য গুরুতর।
নির্দেশাত্মক নীতি না কি মৌলিক অধিকার, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
মৌলিক অধিকার যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ১৯৮০ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ভারতীয় সংবিধান মৌলিক অধিকার ও নির্দেশাত্মক নীতির ভারসাম্যের উপর ভিত্তি করে গঠিত। একটির চেয়ে অন্যটিকে বেশি গুরুত্ব দিলে সংবিধানের সমন্বয়ের সমস্যা হবে।
দেওয়ানি বিষয়ে ভারতে অভিন্ন বিধি ইতিমধ্যেই নেই?
প্রায় সমস্ত দেওয়ানি বিষয়েই, যেমন ভারতীয় চুক্তি আইন, দেওয়ানি কার্যবিধি, পণ্য বিক্রয় আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, এভিডেন্স অ্যাক্টের ক্ষেত্রে ভারতীয় আইন অভিন্ন। তবে বিভিন্ন রাজ্য নির্দিষ্ট বিষয়ে বহু সংশোধনী এনেছে, ফলে এই ধর্মনিরপেক্ষ দেওয়ানি আইনগুলিতেও এখন বৈচিত্র্য দেখা যায়। সম্প্রতি বেশ কিছু রাজ্য ২০১৯ সালের মোটির ভেহিকেল আইন লাগু করতে অস্বীকার করেছে।
সংবিধান প্রণেতাদের উদ্দেশ্য যদি একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রস্তুত করাই হত, তাহলে ব্যক্তিগত আইনকে সংসদের হাতে রাখা হত, কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু ব্যক্তিগত আইন যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত। গত বছর আইন কমিশন সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছে যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সম্ভবপরও নয়, কাঙ্ক্ষিতও নয়।
কোনও একটি সম্প্রদায়ের জন্য এমন কোনও ব্যক্তিগত আইন রয়েছে যার আওতায় সে সম্প্রদায়ের সকলেই পড়েন?
এ দেশের সব হিন্দুদের জন্য একটি আইন নেই, মুসলমান বা খ্রিষ্টানদের জন্যও নেই। ব্রিটিশ আইনই শুধু নয়, এমনকী পর্তুগিজ ও ফরাসি আইনও দেশের কোনও কোনও জায়গায় লাগু।
২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট পর্যন্ত জম্মু কাশ্মীরে স্থানীয় হিন্দু আইন কেন্দ্রীয় আইনের থেকে আলাদা ছিল। ১৯৩৭ সালের শরিয়া আইন কয়েক বছর আগে অবধি জম্মু কাশ্মীরে লাগু ছিল। কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য ছিল প্রথাগত আইন, যা বাকি দেশের মুসলিম ব্যক্তিগত আইন থেকে অনেকটাই আলাদা, অনেকটাই হিন্দু আইনের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। মুসলিমদের বিবাহের নথিভুক্তির আইনও একেক জায়গায় একেক রকম। জম্মু কাশ্মীরে (১৯৮১ সালের আইনানুসারে) নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক, কিন্তু বাংলা, বিহার, আসাম ও ওড়িশায় বাধ্যতামূলক নয়।
উত্তরপূর্ব ভারতে ২০০-র বেশি জনজাতি নিজস্ব বিভিন্ন প্রথাগত আইন মেনে চলেন। সংবিধানেই নাগাল্যান্ডে স্থানীয় প্রথাকে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। একই সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে মেঘালয় ও মিজোরামকে। এমনকি হিন্দু আইন সংস্কারের পরেও প্রথাগত পদ্ধতিকে সুরক্ষা দিয়েছে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির সঙ্গে ধর্মের মৌলিক অধিকারের সম্পর্ক কী?
২৫ নং ধারায় বলা হয়েছে ব্যক্তির মৌলিক ধর্মীয় অধিকারের কথা, ২৬ (বি) অনুচ্ছেদে ধর্মীয় সংগঠনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, ২৯ নং ধারায় বিভিন্ন সংস্কৃতিকে রক্ষা করবার কথা বলা হয়েছে। ২৫ নং ধারায় যে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে জনশৃঙ্খলা, স্বাস্থ্য, নৈতিকতা এবং মৌলিক অধিকারের অন্য বিধির আওতায় এই স্বাধীনতা। কিন্তু ২৬ নং অনুচ্ছেদে কোনও গোষ্ঠীর স্বাধীনতা মৌলিক অধিকারের আওতায় রাখা হয়নি।
গণ পরিষদে মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে মতানৈক্য ছিল। বিষয়টি ভোটাভুটিতে সমাধিত হয়। ৫-৪ ভোটে স্থির হয়ে যায় এ বিষয়টি মৌলিক অধিকার আওতাধীন নয় এবং তার ফলে ধর্মীয় স্বাধীনতার তুলনায় অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। মৌলিক অধিকার সাব কমিটির শীর্ষে ছিলেন সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল।
গণ পরিষদে মুসলিম সদস্যদের বক্তব্য কী ছিল?
কিছু কিছু সদস্য মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে রাষ্ট্রের নিয়মের আওতার বাইরে রাখতে চেয়েছিলেন। মুসলিম ব্যক্তিগত আইনকে ৪৪ নং অনুচ্ছেদের আওতার বাইরে রাখার ব্যাপারে মহ্ম্মদ ইসমাইলের তিনবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ব্যক্তিগত আইনে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। বি পোকার সাহেব বলেন, তিনি অভিন্ন বিধি নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের আপত্তির কথা জানতে পেরেছেন। হুসেন ইমাম প্রশ্ন তোলেন ভারতের মত বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশে ব্যক্তিগত আইন আদৌ থাকতে পারে কিনা তা নিয়েই।
বি আর আম্বেদকর বলেছিলেন, কোনও সরকার এমন কোনও আইন বানাতে পারে না যার জেরে মুসলিমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। অল্লাদি কৃষ্ণস্বামী, যিনি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে ছিলেন, তিনিও বলেন কোনও সম্প্রদায়ের ব্যাপক আপত্তির মাঝে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কার্যকর করা ভুল হবে। এই বিতর্কে অবশ্য লিঙ্গগত ন্যায়ের প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়নি।
সাধারণ আইন নিয়ে হিন্দুদের ভূমিকা কী?
১৯৪৮ সালের জুন মাসে গণ পরিষদের সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ জওহরলাল নেহরুকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ব্যক্তিগত আইনে মৌলিক বদল আনার চেষ্টা আসলে আণুবীক্ষণিক এক গোষ্ঠীর মধ্যে প্রগতিশীল ভাবনা নিয়ে আসার জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা। হিন্দু আইনের সংস্কারের বিরোধীদের মধ্যে ছিলেন সর্দার প্যাটেল, পট্টভি সীতারামাইয়া, এম এ আয়েঙ্গার, মদন মোহন মালব্য এবং কৈলাসনাখ কাটজু।
হিন্দু বিল নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। ২৮ জন বক্তার মধ্যে ২৩ জন এর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৫১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ হুমকি দিয়েছিলেন তিনি নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিল সংসদে ফেরত পাঠাবেন বা ভেটো দেবেন। আম্বেদকরকে পদত্যাগ করতে হয়। নেহরু এই আইনের ত্রিভাগ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন এবং বেশ কিছু বিধি বাদও দিয়েছিলেন।