উন্নাওয়ের ১৯ বছরের ধর্ষিতা তরুণীর রহস্যজনক দুর্ঘটনার দুদিন পর ধর্ষণে অভিযুক্ত বিজেপি বিধায়ককে সুরক্ষা দেওয়ার অভিযোগে সংসদে ব্যাপক বিক্ষোভে মুখে পড়েছে বিজেপি। এ ঘটনার জেরে বৃহস্পতিবার ওই বিধায়ককে বহিষ্কার করেছে দেশের শাসক দল।
উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার বঙ্গারমাউ কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক কুলদীপ সিং সেঙ্গার ২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল ধর্ষণের গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে জেলে রয়েছেন। রবিবার রায়বেরিলির গুরুবক্সগঞ্জের সড়কের উপর দুর্ঘটনায় মারা যান ধর্ষিতা তরুণীর দুই আত্মীয়া। এ ঘটনার পর ওই তরুণীর কাকার অভিযোগের ভিত্তিতে সোমবার পুলিশ সেঙ্গারের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে এফআইআর দায়ের করেছে।
সিবিআই ইতিমধ্যেই ওই বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে চার্জশিট দিয়েছে। তারা এবার এই সড়ক দুর্ঘটনারও তদন্ত করবে। রবিবার ওই গাড়িটিতে একটি ট্রাক ধাক্কা মারে। ওই ট্রাকের নম্বরপ্লেট কালো রং করা ছিল।
২০১৮ সালে তরুণীর বাবা জেল হেফাজতে মারা যান। রবিবারের দুর্ঘটনার কয়েকদিন আগে, ওই তরুণী ও তাঁর দুই আত্মীয় দেশের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখে জানান যে তাঁদের জীবনের আশঙ্কা রয়েছে।
এই গোটা কাহিনিতে ওঠাপড়া ও বাঁকগুলো ঠিক কীকী, যা দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠতে পারল?
আরও পড়ুন, উন্নাও মামলা দিল্লিতে স্থানান্তরের নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট
প্রথম অভিযোগ
২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল ওই তরুণী, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের লখনউয়ের বাড়ির সামনে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তাঁর অভিযোগ ছিল পুলিশের কাছে ধর্ষণের অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও বিধায়কের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
এর পর পুলিশ ওই মহিলা এব তাঁর পরিবারের আরও ৮ জন সদস্যকে গৌতম পালি থানায় নিযে যায়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ওই তরুণী মা ও ঠাকুমাও। তরুণী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন সেঙ্গার নিজের বাড়িতে ২০১৭ সালের জুন মাসে তাঁকে যৌন নিগ্রহ করেছেন এবং তাঁর পরিবারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
উন্নাও পুলিশ জানিয়েছিল তরুণীর পরিবার অভিযোগ করেছে যে গ্রামের দুই যুবক ওই তরুণীকে ২০১৭ সালের ১১ জুন অপহরণ করে এবং সে বছরের ২০ জুন সে সম্পর্কিত অভিযোগ দায়ের হয়। তরুণীর বয়ানের ভিত্তিতে শুভম সিং, নরেশ তিওয়ারি এবং ব্রিজেশ যাদব নামে তিনজনকে গণধর্ষণ ও পকসো আইনে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার সময়ে ওই তরুণীর বয়স ছিল ১৭ বছর।
সংশ্লিষ্ট থানার ওসি বলেছেন, মহিলার পরিবারের সন্দেহ অপহরণের ব্যাপারে ওই যুবকদের সাহায্য করেছিলেন বিধায়ক। ওসি এও বলেছেন যে ২০১৭ সালের ৪ জুন অভিযুক্ত শুভম সিংয়ের মা শশী সিং ওই তরুণীকে সেঙ্গারের বাড়িতে নিয়ে যান- যেখানে সেঙ্গার ওই তরুণীকে ধর্ষণ করেন।
পুলিশ এও বলছে যে নিগৃহীতার বাবা ও কাকা হল অপরাধী, তার বাবার নামে ২৮টি খুন ও লুঠতরাজের মামলা রয়েছে। কাকার বিরুদ্ধে মোট ১৫টি মামলা রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটি ১৯৯১ সালের।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে পরবর্তীকালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই তরুণী বলেছেন বিধায়ক তাঁদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন এবং তিনি নিজে ও তাঁর বোনেরা সেঙ্গারকে ভাই বলে ডাকতেন।
২০১৯ সালের ১৩ এপ্রিল প্রকাশিত ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "আমায় ঘরের ভিতর যেতে বলা হয়েছিল, যে ঘরে ও আমায় ধর্ষণ করে। তারপর আমায় বলা হয় যদি আমি এ নিয়ে মুখ খুলি তাহলে আমার বাবা ও পুরো পরিবারকে খুন করা হবে। আমি প্রথমে কাউকে কিছু বলিনি। এর পর ওর কিছু লোকজন ১১ জুন আমাকে অপহরণ করে। ওরা আমায় গণধর্ষণ করে আমাকে একজনের কাছে বিক্রি করে দেয়, যেখান থেকে আমায় উদ্ধার করা হয়।"
সেঙ্গার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর দাবি কেউ কেউ তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে কারণ তিনি কয়েকজন নিরপরাধ যুবককে ফাঁসানোর মামলা থেকে রেহাই পেতে সাহায্য করেছেন।
আরও পড়ুন, অভিযোগ করলে উন্নাওয়ের ধর্ষিতার মতো অবস্থা হবে? পুলিশকর্তাকে প্রশ্ন কিশোরীর
তরুণীর বাবার মৃত্যু
যেদিন ওই তরুণী লখনউয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন, তার পর দিন, ২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল উন্নাও জেলের মধ্যে তাঁর বাবা মারা যান। অভিযোগ বিধায়কের সমর্থকদের ৬ দিন ধরে নির্দয় প্রহারের জেরেই মারা যান তিনি। এ ব্যাপারে তরুণীর পরিবারের পক্ষ থেকে ৩ এপ্রিল যে এফআইআর দায়ের করা হয়, তাতে বিনীত, বাউয়া, শৈলু এবং সোনু- বিধায়কের এই চার সমর্থকের নাম রয়েছে।
সেঙ্গারের দায়ের করা এফআইআরের ভিত্তিতে তরুণীর বাবাকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির অস্ত্র আইনে অভিযোগ আনা হয়েছিল। তরুণীর পরিবারের অভিযোগ, বিধায়ক ও তাঁর সমর্থকরা নিগৃহীতার বাবাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছেন।
জানা গিয়েছে তরুণীর বাবাকে গ্রেফতার করা হয় ঘটনার দিনই। তিনি জেলে মারা যাওয়ার পর বিধায়কের চার সহচরকে গ্রেফতার করা হয়। ৬ পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ডও করা হয়। বিধায়কের ভাই অতুল সিংকে পর দিন (১০ এপ্রিল, ২০১৮) গ্রেফতার করা হয়। তরুণীর বাবার পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে শরীরে ১৪টি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছে। মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে সেপ্টিসিমিয়া অথবা রক্তে বিষক্রিয়া।
২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল ধর্ষণের অভিযোগের তদন্তে বিশেষ তদন্ত দল (সিট) গঠিত হয়। এরই মধ্যে একটি ভিডিও সামনে আসে, যাতে দেখা যায় তরুণীর বাবা অভিযোগ করছেন, পুলিশের উপস্থিতিতেই বিধায়করে ভাই তাঁকে মেরেছেন। সেদিনই সেঙ্গারের স্ত্রী সঙ্গীতা স্বামীর জন্য ন্যায় বিচার প্রার্থনা করে উত্তর প্রদেশ পুলিশের ডিজি-র সঙ্গে দেখা করেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সেঙ্গার রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন।
আরও পড়ুন, উন্নাওকাণ্ড: ভারী বৃষ্টিতে ভুল দিক থেকে আসছিল ট্রাক, দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের
সিবিআই তদন্ত
২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল পুলিশ ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় এবং পকসো আইনে সেঙ্গারের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে। সেদিনই এলাহাবাদ হাইকোর্টের নির্দেশে এ মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পরদিন, অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল সিবিআই সেঙ্গারকে গ্রেফতার করে। আদালত তার নির্দেশে বলেছিল, "আইনশৃঙ্খলার মেশিনারি সরাসরি সেঙ্গারের শাগরেদদের দ্বারা প্রভাবিত"। ১৪ এপ্রিল সিবিআই শশী সিংকে গ্রেফতার করে। ২০১৭ সালের ১৪ জুন ওই তরুণীকে ফুঁসলিয়ে সেঙ্গারের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে এই শশী সিংয়ের বিরুদ্ধে।
২০১৮ সালের মে মাসে সিবিআই সেঙ্গার ও অন্যদেরর বিরুদ্ধে তরুণীর বাবাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ আনে এবং দুই পুলিশকর্মীকে গ্রেফতার করে। নিগৃহীতার তরফ থেকে হাইকোর্টে আবেদন দাখিলের পর সেঙ্গার ও শশীকে উন্নাও জেল থেকে সরিয়ে সীতাপুর জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।
তরুণীর বাবার মৃত্যু নিয়ে প্রথম চার্জশিট সিবিআই দাখিল করে ২০১৮ সালের ৭ জুলাই। চার্জশিটে সেঙ্গারের ভাই অতুল সিং ও অন্য চারজনের নাম ছিল। চার্জশিটে বলা হয়, বিধায়কের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলায় আদালতে শুনানিতে হাজির থাকার জন্য তরুণীর বাবা দিল্লি থেকে এসেছিলেন। সেদিনই সন্ধ্যায় তাঁকে নিজের বাড়ির সামনে অভিযুক্তরা গালাগাল দেয় ও মারধর করে।
১১ জুলাই সিবিআই লখনউয়ের বিশেষ বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে সিবিআই আরেকটি চারজশিট দাখিল করে। সে চার্জশিটে সেঙ্গারের বিরুদ্ধে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয় এবং শশী সিংকে এই অপরাধে সহায়তায় অভিযুক্ত করা হয়। অভিযোগ আনা হয় ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০বি (ষড়যন্ত্র), ৩৬৩ (অপহরণ), ৩৬৬ (অপহরণ অথবা জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা), ৩৭৬ (ধর্ষণ), ৫০৬ (হুমকি) এবং পকসো আইনে।
১৪ জুলাই সেঙ্গার ও আরও ৯ জনের বিরুদ্ধে তরুণীর বাবার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে ভুয়ো মামলা আনার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তৃতীয় চার্জশিট দাখিল করে সিবিআই।
আরও পড়ুন, উন্নাওকাণ্ডে বিজেপি বিধায়ক কুলদীপের নামে খুনের চেষ্টার মামলা সিবিআইয়ের
তরুণীর পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা
সিবিআই চার্জশিট দেওয়ার পাঁচ মাস পর মাখি থানায় নিগৃহীতা, তাঁর মা ও কাকার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। সেখানে অভিযোগ আনা হয়, পুলিশের কাছে জাল নথি দিয়ে তরুণীকে নাবালিকা বলে দেখানো হয়েছে। স্থানীয় এক আদালতের নির্দেশে শশীর স্বামী হরিপাল সিংয়ের বিরুদ্ধে এই এফআইআর নথিভুক্ত হয়।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে মহিলার কাকা ১৯ বছরের পুরনো একটি হত্যার চেষ্টার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন, এবং একটি জেলা আদালত তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয়। উল্লেখ্য ২০০০ সালে উন্নাওয়ের পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে এই অভিযোগ দায়ের করেছিলেন সেঙ্গারের ভাই অতুল সিং।
উন্নাওয়ের সরকারি কৌঁশুলি রামজীবন যাদবের বক্তব্য অনুযায়ী, অতুল সিং অভিযোগ করেন যখন তিনি ভোট দিতে যাচ্ছিলেন, সে সময়ে তরুণীর বাবা ও দুই কাকা স্থানীয় মানুষকে নিজেদের প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছিল।
রামজীবনের কথায়, "যখন অতুল সিং এ নিয়ে আপত্তি জানান, তখন তারা অতুলের উদ্দেশে গালিগালাজ করতে শুরু করে। অতুল সিং কোনও কথা না বলে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেন। বাড়ি থেকে তিনি যখন কয়েক মিটার মাত্র দূরে, সে সময়ে তিন ভাই পিছন দিক থেকে এসে তাঁকে হুমকি দিতে শুরু করে এবং তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। তবে অতুল সিংয়ের গায়ে কোনও আঘাত লাগেনি, তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।"
Read the Story in English