সম্প্রতি চণ্ডীগড়ের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া এক প্রস্তাব নিয়ে হুলুস্থূল পড়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যে উর্দু বিভাগকে অন্য যে বিদেশি ভাষা বিভাগ (ফরাসি, রাশিয়ান, জার্মান, চিনা ও তিব্বতি)গুলি রয়েছে তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হোক।
এ প্রস্তাবের ব্যাপক বিরোধিতা ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের মধ্যে থেকেই। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংও এই প্রস্তাবের সমালোচনা করেন এবং বলেন, উর্দুও অন্য যে কোনও ভারতীয় ভাষার মতোই একান্ত ভারতীয়।
উর্দু ভাষার উৎস কী?
উর্দু ভাষাবিশারদদের মতে, বেশ কয়েক শতক আগে ভারতেই উর্দু ভাষার উদ্ভব হয়। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের অধ্যাপক আলি আব্বাস বলেন উর্দুর উদ্ভব যে ভারতে তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। বিশিষ্ট কবি আমির খুসরু তাঁর বইয়ে একাদশ শতাব্দীর লাহোরের এক কবি, মাসুদ আল সালমান ওরফে মাসুদ লাহোরির কথা লিখেছেন। মাসুদের কবিতা লেখা হয়েছিল হিন্দ্বি (উর্দু) ভাষায়, যা দেহলভি বলেও পরিচিত ছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে উর্দুর উৎপত্তি হয়েছিল পাঞ্জাবের লাহোর প্রদেশে, যা দেশভাগের আগে বৃহত্তর পাঞ্জাবের অংশ ছিল। উর্দু ব্যাকরণের সঙ্গে হিন্দির মিল প্রচুর। আলি আব্বাসের কথায়, যদি এ কথা ধরেও নেওয়া হয় যে কিছু মূল শব্দ পার্সি এবং আরবি থেকে এসেছে, তাহলেও সেগুলি ভারতে এসে উর্দুতে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন, হিন্দি কি ৭০ বছর আগেই রাষ্ট্রভাষা হতে পারত?
তাঁর মতে উর্দু নামে পরিচিত হওয়ার আগে এ ভাষাকে হিন্দুস্থানি, হিন্দাই, দেহলভি ও রেখতা নামেও ডাকা হত।
উর্দু যেমন ডান দিক থেকে বাঁ দিকে লেখা হয়, তেমনই পাঞ্জাবের শাহমুখী ভাষাও একইভাবে ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখা হয় বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। পারসি হরফে লেখা হলেও উর্দুকে সে কারণে অভারতীয় বলে চিহ্নিত করা যাবে না বলে দাবি করেছেন এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, পাঞ্জাবি শাহমুখী ভাষাও পার্সি হরফে লেখা হয়ে থাকে।
উর্দু ভাষা কীভাবে, কোথায় বিকশিত হয়ে উঠল?
বিশেষজ্ঞরা বলেন উর্দু বাষার উৎপত্তি পাঞ্জাবে হলেও উর্দুর বিকাশ ঘটেছিল, দিল্লি, হরিয়ানার একাংশ এবং দক্ষিণ ভারতে, যেখানে এ ভাষাকে দখনি বা দক্ষিণি বলে ডাকা হত।
দিল্লির সুলতানি আমলে, অর্থাৎ দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে এবং মুঘল আমলে, অর্থাৎ ষোড়শ থেকে উনিশ শতক পর্যায়ে উর্দু ভাষার বিকাশ ঘটে। এ সময়ে বহু সভাকবিরা তাঁদের কবিতা এবং লেখা লিখতেন এই ভাষাতেই। এবং এরপর দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে এ ভাষার বিকাশ ঘটে।
উর্দুর সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের সম্পর্ক কী?
দিল্লির সুলতানরা এবং মুঘলরা যখন দক্ষিণে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন, সে সময়ে কর্নাটক, বর্তমান তেলেঙ্গানা, কেরালা ও তামিল নাড়ুর কিছু অংশ এবং মহারাষ্ট্রেরও কিছু ভাগে এ ভাষা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির বেশ কিছু স্থানীয় শব্দ উর্দুর মধ্যে প্রবেশ করে যাওয়ায় তা আর দিল্লির উর্দু ভাষায় আটকে থাকে না, হয়ে যায় দখনি ভাষা। ১৩২৭ সালে দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে নিজের রাজ্যের রাজধানী দৌলতাবাদ বা দেবগিরি বা দেওগিরি (বর্তমান ঔরঙ্গাবাদ)-তে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে দিল্লির বহু মানুষও ঔরঙ্গাবাদে যান। ১৩৩৪ সালে দিল্লিতে রাজধানী ফিরিয়ে নিয়ে আসেন তিনি। মধ্যবর্তী ৭ বছরে ঔরঙ্গাবাদেও উর্দু ভাষা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেও বেশ কিছু স্থানীয় শব্দ ঢুকে পড়ে এ ভাষার মধ্যে।
চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে বাহামণি শাসনকালে বিশেষত মহারাষ্ট্র, কর্নাটক এবং বর্তমান তেলেঙ্গানায় উর্দু প্রবাব বিস্তার করতে থাকে এবং অনেকেই স্থানীয় শব্দ সহযোগে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতে থাকেন। এ ভাষা ছড়িয়ে পড়ে আহমেদনগর, বিজাপুর, বিদার ও গোলকোণ্ডায়। অধ্যাপক আব্বাসের কথায়, ভারতের বাইরে উর্দুর উৎপত্তির কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না।
আরও পড়ুন, ভারতীয় নাগরিক কারা? কীভাবে তা স্থির করা হয়?
ভারতে উর্দু ভাষার সরকারি মর্যাদা কীরকম?
ভারতের সংবিধান অনুসারে এটি ভারতের অন্যতম সরকারি ভাষা। দেশের কারেন্সি নোটে যে ১৫টি ভাষায় মুদ্রার মান লেখা থাকে, উর্দু তার মধ্যে একটি। কাশ্মীর, তেলেঙ্গানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গে উর্দু সরকারি ভাষা।
পাঞ্জাবে রাজস্ব দফতরের পুরনো নথি যা মেলে, সেগুলি সবই লেখা উর্দু ভাষায়।
ভারতের প্রায় পঞ্চাশটি শহর এনং এলাকায় ব্যাপক মানুষ এ ভাষাতেই কথা বলেন, গোটা ভারতে এ ভাষায় কথা বলেন লাখ লাখ মানুষ।
স্বাধীনতা উত্তর পর্বে উর্দুর উপর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি এবং বেশ কিছু রাজ্যে, যেখানে আগে স্কুলে উর্দু শেখানো বাধ্যতামূলক ছিল, এখন আর তা নেই।
দৈনন্দিনতার উর্দু ভাষা
দরজা,
তারিখ,
হুকুম,
ইমারত,
কেতাব,
দিল,
হাওয়া বা
দোস্ত- এ ধরনের নিত্য ব্যবহৃত বহু কথারই আদত উৎস কিন্তু উর্দু, যা আমার মাঝেমাঝে খেয়ালও করি না।
Read the Full Story in English