Advertisment

ভাঙচুর-সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা, কী হচ্ছে ত্রিপুরায় এবং কেন?

ত্রিপুরার শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র নবেন্দু ভট্টাচার্য এই অশান্তিতে সিপিএমের হাত দেখছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
HC takes suo motu cognizance of violence in Tripura

বিজেপি শাসিত উত্তর-পূর্বের রাজ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মিছিল ঘিরে উত্তেজনা ছড়ায়।

অক্টোবরের ১৫ তারিখ বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি দুর্গাপুজো প্যান্ডেল এবং মন্দিরে ভাঙচুর চলে। কারণ খুঁজতে গিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল একটি ছবি কাঠগড়ায় ওঠে। কীসের ছবি সেটা? ছবিতে দেখা গিয়েছে, একটি প্যান্ডেলে গণেশের মূর্তির পায়ের কাছে রাখা কোরান। অনেকেই বলেছেন, ছবিটি নির্জলা ফেক। কিন্তু ফেকেরই রমরমা, মাহাত্ম্য। আমাদের এই প্রতিবেশি দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর সন্ত্রাস ফেক-মাহাত্ম্যেই চলেছে। এরই বিরুদ্ধে ভারতে প্রতিবাদ হয়েছে সব স্তরে। কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন মিছিল বার করেছিল ত্রিপুরায়। অভিযোগ, মিছিল থেকে ছড়িয়েছে উত্তেজনা। পুলিশের সঙ্গে মারামারি, সংখ্যালঘুদের বাড়ি-দোকান ভাঙচুর, পরিস্থিতি হয়ে ওঠে ঘোরাল।

Advertisment

অশান্তির ঘটনা

১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ যা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সে দেশের সরকার পদক্ষেপ করেছে। যাঁরা এই কার্যালাপের সঙ্গে যুক্ত, তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। বাংলাদেশের আঁচ-লাগা ত্রিপুরায় হিন্দু এবং মুসলমান-- দু'পক্ষই ওই ঘটনায় প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। দু'তরফের প্রতিনিধিরাই আগরতলায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে প্রতিবাদপত্র জমা দিয়ে এসেছেন।

না, এখানেই শেষ নয়, যদিও হলে ভাল হল। বাংলাদেশে ভাঙচুরের প্রতিবাদে মিছিল বার করেছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং হিন্দু জাগরণ মঞ্চ (এইচজেএম)। মিছিল হয়েছিল আরও কয়েকটি সংগঠনেরও। এর কয়েকটি মিছিল থেকে দুষ্কৃতীরা বেশ কিছু বাড়ি-দোকান-মসজিদ ভাঙচুর করেছে বলে খবর হয়েছে। অক্টোবরের ২১ তারিখ উদয়পুরে ভিএইচপি এবং এইচজেএমের যে মিছিল বেরোয়, তা থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে, কারণ, মিছিলের অনুমতি ছিল না মিশ্র ধর্মীয় জনবসতি এলাকাগুলিতে ঢোকার, আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে ওই সব এলাকায় মিছিল ঢুকতে পুলিশ বাধা দিলে সংঘর্ষ। তিন পুলিশ কর্মী সহ ১৫ জন এই ঘটনায় আহত। আগরতলায় একই ধরনের একটি মিছিল থেকে কিছু দুষ্কৃতী মসজিদের সিসিটিভি ক্যামেরা ভেঙে দিয়েছে বলে অভিযোগ। উত্তর ত্রিপুরার ধর্মনগরে ২১ অক্টোবর ১০ হাজার মানুষের মিছিল বেরোয়, ভিএইচপি-এইচজেএমের মতো বেশ কয়েকটি সংগঠনই এর উদ্যোক্তা ছিল।

অক্টোবরের ২৬ তারিখ প্রতিবাদ মিছিল বেরোয় উত্তর ত্রিপুরার পানিসাগরে। চামটিলা, জালেবাসা, রোয়া বাজারের মতো এলাকাগুলি ঘোরে মিছিল। অভিযোগ, প্রতিবাদীদের একাংশ রোয়া বাজারে কিছু দোকান এবং বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। কিছু প্রতিবাদী চামটিলার একটি মসজিদে ভাঙচুরও চালায় বলেও অভিযোগ, ওই মসজিদটি রোয়া বাজার থেকে বেশি দূরে নয়। এর পর রাতে সংখ্যালঘুদের তরফে ত্রিপুরা-অসমের সীমানাবর্তী এলাকায় বিশাল একটি জমায়েত করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের তরফে আলোচনা চালিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরত পাঠানো হয় তাদের। পানিসাগর ও ধর্মনগরের ১৪৪ ধারা জারি করে যাতায়াতে লাগাম দেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি যাতে না ঘটতে পারে, তার জন্য এই কড়া পদক্ষেপ না নিলে চলত না, বলেছে প্রশাসন।

ঘটনা আরও। এবং অন্য রকমও ঘটেছে। অজানা দুষ্কৃতীরা কালিয়াশহরের কালীমন্দিরের খড়ের দেওয়াল ভেঙে দিয়েছিল, ২৯ অক্টোবর, দুপুরবেলায়। কালিয়াশহর থানার ওসি জানিয়েছেন, হিন্দু-মুসলিম এক সঙ্গে সেই দেওয়াল গড়ে দিয়েছে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।

কী বলছে সরকার?

ত্রিপুরা সরকার সাম্প্রদায়িক হিংসার বিরুদ্ধে সক্রিয়। শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখতে তারা বার বার আবেদন জানিয়েছে, গুজবে কান না দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তথ্যসংস্কৃতি মন্ত্রী সুশান্ত চৌধুরি শুক্রবার পানিসাগরে মসজিদ পোড়ানোর খবর নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাইরে থেকে আসা কয়েকটি দল এই কাজ করেছে, সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা এর উদ্দেশ্য। মন্ত্রী জানিয়েছেন, পুলিশ এই ঘটনার চুলচেড়া তদন্ত করছে।পাশাপাশি, অশান্তিতে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পাবেন বলেও ঘোষণা করেছে ত্রিপুরা সরকার।

গুজব ছড়ানো

গুজবেরই জের। দু'ভাবেই গুজব ছড়িয়েছে। ইন্টারনেটে যেমন, সেই সঙ্গে মুখে-মুখেও। তিল থেকে এর ফলে তাল হয়েছে, যেমন গুজবের ধর্ম। উত্তর ত্রিপুরায় মসজিদে অগ্নিসংযোগের গুজব যেমন ছড়ানো হয়েছে, তেমনই গুজব রটেছে সে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় মন্দির ভাঙচুরের। অক্টোবরের ২৩ তারিখ ভাঙা শিবমূর্তির ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ায়। দাবি করা হয়, জিহাদিরা এই কাজ করেছে। পরে পুলিশ জানতে পারে, একটি পরিত্যক্ত স্থানে ওই শিবমূর্তিটি রয়েছে অনেক দিন। একটি টিলার উপর, জনবসতি থেকে ৪৫ মিনিট ঘন জঙ্গুলে এলাকার মধ্য দিয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়।

পুলিশের বক্তব্য, কী ভাবে মূর্তিটি ভেঙেছে, তা বলা যাবে না। তবে, কোনও রকম সাম্প্রদায়িক অশান্তি ওই এলাকায় হয়নি। এর কিছু দিন পর, দক্ষিণ ত্রিপুরার কামালসাগর এলাকার একদল দাবি করে বসে, পরিত্যক্ত একটি কালীমূর্তি পুড়িয়ে দিয়েছে কিছু দুষ্কৃতী। পুলিশ এই দাবি নস্যাৎ করে দিয়ে জানায়, পুজোর পর কালীমূর্তির সামনে জ্বলন্ত মোমবাতি রেখেই চলে গিয়েছিল কিছু লোক, যেমনটা হয়ে থাকে, মূর্তির চুল সেই মোমের আগুনে পুড়েছে। এবং পানিসাগরের ঘটনায় পুলিশ সবচেয়ে চিন্তায়। ২৬ অক্টোবর, এক ভিডিওয় দাবি করা হয়, পানিসাগরের একটি মসজিদে আগুন লাগানো হয়েছে। তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়, পুলিশ জানায়, মসজিদে অগ্নিসংযোগের ছবি এবং ভিডিও ফেক, ত্রিপুরার বাইরের কোনও ঘটনা কারচুপি করে তৈরি।

সতর্কতা, চিন্তা

পুলিশ টুইট করে বলেছে, 'কিছু মানুষ ফেক আইডি থেকে ত্রিপুরা সম্পর্কে গুজব রটাচ্ছে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক।' ত্রিপুরার পুলিশ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, 'আমরা এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছি, যারা ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

ত্রিপুরা জমিয়ত উলেমা হিন্দ এবং ত্রিপুরা ইমামস' কমিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় সংগঠন এই ধরনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, দুষ্কৃতীদের অত্যন্ত ছোট একটি দল রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। রাজ্য সরকারের ছবিতে কালি দিতে চাইছে। অক্টোবরের ২২ তারিখ মুখ্যমন্ত্রীর অফিসে একটি স্মারকলিপি জমা দেয় ত্রিপুরা রাজ্য জমিয়ত উলেমা হিন্দ। তাদের অভিযোগ, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় হামলা হয়েছে, মসজিদে হামলা হয়েছে। তারা মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব ও ত্রিপুরা পুলিশের ডিজি ভিএস যাদবের হস্তক্ষেপ চেয়েছে। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি মুফতি তায়েবুর রহমান বলেছেন, প্রন্তিক অঞ্চলের সংখ্যালঘু মানুষজন বাড়ি থেকে বেরোতে ভয় পাচ্ছেন।

অল ত্রিপুরা ইমামস' কমিটির দাবি, বাংলাদেশের অশান্তির পর অন্তত দশটি জায়গায় হামলার খবর হয়েছে। তারা প্রশাসিক ব্যর্থতার অভিযোগ করেছে। যারাই এ ধরনের কিছু করার চেষ্টা করুক, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছে ওই কমিটি। ত্রিপুরার বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রধান সভাপতি পূর্ণচন্দ্র মণ্ডল দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন, অশান্তিতে তাদের সংগঠনের কোনও ভূমিকা নেই। পানিসাগরে যে বিশাল প্রতিবাদ মিছিল হয়েছিল, হতে পারে তাতে কিছু বহিরাগত ঢুকে পড়ে অশান্তি বাধিয়েছে। মণ্ডলের এও দাবি, সংখ্যালঘুদের কয়েক জন যুবক সশস্ত্র অবস্থায় এসে উসকানি দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

রাজনৈতিক দলগুলি কী বলছে?

ত্রিপুরার শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র নবেন্দু ভট্টাচার্য এই অশান্তিতে সিপিএমের হাত দেখছেন। বলেছেন, 'আমাদের বিশ্বাস সিপিএমের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে। সিপিএমের মূল লক্ষ্য, এখানে অস্থিরতা তৈরি করা।' ভট্টাচার্যের বক্তব্য, তাঁর দল ঘটনায় সতর্ক নজর রেখেছে, সংখ্যালঘু মোর্চার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। যাতে আর কোনও সমস্যা তৈরি না হয়, তা নিশ্চিতকরণে সব চেষ্টা হয়েছে।' বিরোধী দলনেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার বলেছেন, 'দুর্গাপুজোর সময় বাংলাদেশে নিন্দাজনক ঘটনা ঘটেছিল। তারই প্রতিবাদে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মিছিল বার করে ত্রিপুরার বিভিন্ন জায়গায়। উসকানিমূলক ঘটনাও ঘটেছে কিছু জায়গায়। পানিসাগর তারই একটা।' সব স্তরের মানুষকে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য আবেদন জানিয়েছেন মানিকবাবু। পুলিশ এবং প্রশাসন যাতে এই ধরনের ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপ করে, সেই আবেদন জানিয়েছেন তিনি। নতুন তৈরি সংগঠন ত্রিপুরা ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট টিডিএফও এই সাম্প্রদায়িক অশান্তির তীব্র নিন্দা করেছে। তারা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবকে চিঠি লিখে হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়েছে।

হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ

পানিসাগরের ঘটনায় ত্রিপুরা হাইকোর্ট সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্টের ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি জনস্বার্থ মামলা করেছে। এবং রাজ্যকে আদালত নির্দেশ দিয়েছে, ১০ নভেম্বরের মধ্যে এ ব্যাপারে হলফনামা জমা দিতে। সাম্প্রদায়িক অশান্তি ও উস্কানি রুখতে কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে রাজ্য সরকার, তাই জানাতে হবে হলফনামায়। আদালত বলেছে, রাজ্য সরকার শান্তি ফেরাতে পদক্ষেপ করেছে। কিন্তু এমন পদক্ষেপের পরিসর আরও বাড়াতে হবে। শান্তি কমিটি শুধু জেলা স্তরে গড়লেই চলবে না, প্রয়োজন হলে, পঞ্চায়েত স্তরেও তা গঠন করতে হবে। শান্তিশৃঙ্খলার প্রশ্নে সব দলকে এক হয়ে কাজ করতে বলেছে ত্রিপুরা হাইকোর্ট।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Tripura Violence
Advertisment