চলতি সপ্তাহের শুরুতে তাঁর রাজনৈতিক দল 'তমিজহাগা ভেট্রি কাজাগাম' চালু করেছেন তামিল তথা দক্ষিণী অভিনেতা 'থালাপতি' বিজয়। তামিল অভিনেতাদের রাজনীতিতে যোগদানের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই ঐতিহ্য কয়েক দশকের। এখানকার পাঁচ জন মুখ্যমন্ত্রীর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সেই তালিকায় সাম্প্রতিকতম নাম বিজয়। জনগণের প্রতি বার্তায় বিজয় বলেছেন, তাঁর দল ২০২৬ সালের তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। এই ব্যাপারে বিজয় বলেছেন, 'আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। রাজনীতি কোনও পেশা না। এটা জনগণের প্রতি সেবার অংশ। দলীয় কর্মকাণ্ডে কোনও ব্যাঘাত না-ঘটিয়ে আমি জনসেবার জন্য রাজনীতি করতে চাই। নিজে সম্পূর্ণরূপে রাজনীতিতে নিমজ্জিত হতে চাই। একেই আমি তামিলনাড়ুর জনগণের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও কর্তব্য বলে মনে করি।'
- থালাপতি বিজয় নতুন দল গঠন করেছেন।
- সিনেমার জগত থেকে তামিল রাজনীতিতে পা রাখার দীর্ঘ ইতিহাস আছে।
- তামিলনাড়ুর পাঁচ জন মুখ্যমন্ত্রী রাজনীতিতে পা রেখেছেন সিনেমার জগত থেকে।
প্রচারমাধ্যম, আন্নাদুরাই এবং সিনেমা
আন্নাদুরাই, দ্রাবিড়ভূমে সিনেমা জগত থেকে রাজনীতিতে আসা তামিলনাড়ুর প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। তিনি দ্রাবিড় মুনেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) তৈরি করেন। তিনি জাতপাত বিরোধী, ধর্ম বিরোধী 'আত্ম-সম্মান আন্দোলন' করেন। চলচ্চিত্রকে ব্যবহার করে হিন্দু ধর্মের বিরোধিতা করেছিলেন। নল্লাথাম্বি (১৯৪৮) এবং ভেলাইকারি (১৯৪৯)-র মতো স্ক্রিপ্ট লিখে আন্নাদুরাই ব্রাহ্মণ্যবাদের সমালোচনা করেছিলেন। সিনেমা ছিল যেন আন্নাদুরাইয়ের উত্তরাধিকার। থিয়েটার ছিল তাঁর শিকড়। রবার্ট এল হার্ডগ্রেভ জুনিয়র তাঁর 'পলিটিক্স অ্যান্ড দ্য ফিল্ম ইন তামিলনাড়ু' প্রবন্ধে লিখেছেন, 'দ্রাবিড় কাজাগামের একজন তরুণ লেফটেন্যান্ট হিসেবে, আন্নাদুরাই সামাজিক সংস্কার এবং অ-ব্রাহ্মণ আত্মসম্মানের বাহক হিসেবে বেশ কিছু নাটক লিখেছিলেন। ডিএমকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আন্নাদুরাই, ইভিকে সম্পথ ও কেআর রামাস্বামী (তৎকালীন তামিলনাড়ুর সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র তারকা) দলের সুবিধার জন্য নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন।' এই ব্যাপারে হার্ডগ্রেভ আরও লিখেছেন যে, দ্রাবিড়দের তামিলকে 'সংস্কৃত থেকে মুক্ত করা হয়েছিল'। আর, সেটা করা হয়েছিল আত্মসম্মানের দাবিকে সামনে রেখে। সেই থেকে তামিল ভাষার প্রতি 'আত্মসম্মান' কয়েক দশক ধরে অব্যাহত আছে। চলচ্চিত্রগুলোর মাধ্যমে, তামিল রাজ্যের স্বর্ণযুগ (বিশেষ করে চোলযুগ) রুপোলি পরদায় তুলে ধরা হয়েছে। সিনেমায় ব্রাহ্মণদের প্রায়ই খলনায়ক বা বোকা চরিত্র হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
আন্নাদুরাইয়ের উত্তরাধিকার অব্যাহত রাখেন করুণানিধি
এম করুণানিধি ডিএমকে প্রধান এবং তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আন্নাদুরাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি শিবাজি গণেশন-অভিনীত পরাশক্তি (১৯৫২)-র চিত্রনাট্য লিখেছেন। যাকে এস থিওডোর বাস্করানের বই, 'The Eye of the Serpent: An Introduction to Tamil Cinema (১৯৯৬)-এ তামিল সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি' বলে বর্ণনা করা হয়েছে। একটি মন্দিরে একজন পুরোহিত একজন মহিলাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিলেন। তারপরই তুলে ধরা হয়েছে চলচ্চিত্রের বিতর্কিত সংলাপ। যেখানে নায়ক কাউকে মন্দিরের মূর্তির কাছে প্রার্থনা করতে দেখে এসে প্রশ্ন করেছেন, 'আপনি নাম জপ করতে গিয়ে পাথরে ফুল দিয়েছেন। তাহলেই কি পাথর দেবতা হয়ে গেল?' প্রাথমিকভাবে ছবিটি নিষিদ্ধও হয়েছিল। এক সাক্ষাত্কারে করুণানিধি বলেছিলেন, 'আমার উদ্দেশ্য ছিল চলচ্চিত্রগুলোতে সমাজ সংস্কার ও ন্যায়বিচারের ধারণা এবং নীতিগুলো তুলে ধরা। তামিল ভাষার মর্যাদা তুলে ধরা। প্রচার হওয়া উচিত মানুষের জন্য, সমাজের জন্য।' পরাশক্তির প্রধান অভিনেতা ছিলেন শিবাজি গণেশন। তিনি ডিএমকে-র একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও। মন্দির শহর তিরুপতিতে সফরের জন্য তিনি সমালোচিত হন। এর পরে ১৯৫৬ সালের দিকে তিনি দলত্যাগ করেন। তাঁর সমালোচকরা বলেছিলেন যে এই দলত্যাগ ছিল, 'যুক্তিবাদের বর্ণিত আদর্শের বিরোধী।' দ্রাবিড় মতাদর্শের একটি মূল নীতিই ছিল যুক্তিবাদী আদর্শবাদ। তিনি কংগ্রেস এবং জনতা দলে যোগদান করেন। এমনকী, নিজের দলও গঠন করেছেন। তবে, তাঁর চলচ্চিত্র জীবন যতখানি সফল হয়েছে, তাঁর রাজনৈতিক জীবন ততটা সাফল্য পায়নি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৩ সালে তিনি রাজনীতিই ছেড়ে দেন।
এমজিআর, জয়ললিতা এবং এআইএডিএমকে
এমজি রামচন্দ্রন (এমজিআর) ছিলেন তামিল সিনেমার অন্যতম বড় তারকা। তিনি ডিএমকে পার্টির কোষাধ্যক্ষও ছিলেন। দলের নির্বাচনী সাফল্যে তিনি বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। অফস্ক্রিনে এমজিআর অনাথ আশ্রমে অর্থায়ন করেছেন। দুর্যোগ ত্রাণ ব্যবস্থার মত কার্যক্রমেও অংশ নিয়েছেন। হার্ডগ্রেভ তাঁর চলচ্চিত্র সম্পর্কে লিখেছেন, 'এমজিআর নিজেকে সাধারণ মানুষের রক্ষক হিসেবে দেখেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রের নৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত।' এই ব্যাপারে এমজিআর ১৯৬৭ সালে বলেছিলেন, 'একজন মানুষকে কীভাবে বাঁচতে হবে এবং কী বিশ্বাস করতে হবে তা দেখানোই আমার উদ্দেশ্য।' তিনি বলেছিলেন, 'শিল্প এবং রাজনীতি একই মুদ্রার দুটি দিক।' ডিএমকে ধারাবাহিকভাবে দেখিয়েছে যে সিনেমা সমাজে সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করতে পারে এবং করবে। তাঁর এক সময়ের বন্ধু করুণানিধির সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৭২ সালে ডিএমকে থেকে বহিষ্কারের পর, এমজিআর 'অল ইন্ডিয়া আন্না মুনেত্রা দ্রাবিড় কাজাগাম (এআইএডিএমকে)' গঠন করেন। এরপর তিনি দলের বার্তা ছড়িয়ে দিতে, 'নেত্রু ইন্দ্রু নালাই (১৯৭৪)' এবং 'ইধায়ক্কানি (১৯৭৫)'-র মত ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। ১৯৮৭ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ওই পদেই ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ভিএন জানকী রামচন্দ্রন এবং তাঁর উত্তরাধিকারী জে জয়ললিতার মধ্যে উত্তরাধিকার সংগ্রাম শুরু হয়। জয়ললিতা নিজেও একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে রামচন্দ্রনের সহ-অভিনেতা ছিলেন। শেষ পর্যন্ত জয়ললিতার দলই 'আসল' এআইএডিএমকে হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৯১ সালের তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে রীতিমতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর জয়ললিতা মুখ্যমন্ত্রী হন। পরবর্তী পাঁচ মেয়াদে তিনি তামিলনাডুর মুখ্যমন্ত্রী পদে ছিলেন। যদিও জয়ললিতা সিনেমার মাধ্যমে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের চেষ্টা চালাননি। তবে তাঁর জনপ্রিয়তা এমজিআরের অন-স্ক্রিন সাফল্যের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছিল। এমজিআরের সঙ্গে জয়ললিতা বেশ কয়েকটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে 'আয়িরাথিল ওরুভান (১৯৬৫)' এবং 'নাম নাডু (১৯৬৯)'।
বিজয়কান্ত ও কমল হাসান
২০০৫ সালে চলচ্চিত্র শিল্পে প্রায় তিন দশক পর, 'ক্যাপ্টেন' বিজয়কান্ত তাঁর রাজনৈতিক দল দেশিয়া মুরপোক্কু দ্রাবিড় কাজগাম (ডিএমডিকে) শুরু করেন। শুরু থেকেই বিজয়কান্ত তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। তিনি একটি নীল ভ্যানে করে সমাবেশে যান। সেই ভ্যান একবার এমজিআর তাঁর রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করেছিলেন। সেই কারণে বিজয়কান্তকে 'কারুপু এমজিআর (ডার্ক এমজিআর)' বলে ডাকা হয়েছিল। তিনি তাঁর সিনেমায় প্রান্তিক সমাজের লোকেদের তুলে ধরেছেন। তাঁর জনহিতকর প্রচেষ্টা বিজয়কান্তকে 'জনগণের নেতা' বানিয়ে তুলেছিল। ডিএমডিকে ২০০৬ সালে তাঁর প্রথম বিধানসভা নির্বাচনে ৮% ভোট পেয়েছিল। শুধুমাত্র বিজয়কান্তই বিধায়ক হন। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়কান্তর দল ৪১টি আসনের মধ্যে ২৯টি-তে জয়লাভ করে। এরপর অভিনয় জগৎ থেকে তামিল রাজনীতিতে আসেন অভিনেতা-পরিচালক কমল হাসান। তিনি ২০১৮ সালে তাঁর 'মক্কল নিধি মিয়াম' চালু করেছিলেন। দলের প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান কমল হাসান বলেছিলেন, 'আমি কখনও বিনামূল্যে অভিনয় করিনি। আমি যে ছবিতে অভিনয় করেছি, সেগুলিতে আপনি অর্থ দিয়েছেন। যা আমার বেতন হয়ে উঠেছে। কিন্তু, বিনিময়ে কী করলাম? এটা ভেবেই একটা অপরাধবোধ (ভিতরে তৈরি হয়েছিল)। তারপরই, আমি আপনার জন্য বাঁচার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই কারণেই আমি তাড়াহুড়ো করছি। আর, আমি একটি রাজনৈতিক দল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যেটা জীবন শেষ হওয়ার আগে আমি দেখে যেতে চেয়েছি।' কমল হাসানের দল ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তার সবকটিতেই হেরেছিল। এই দল ২০২১ তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সেখানেও সব আসনে হেরেছিল। এমনকী, কমল হাসান যে (কোয়ম্বাটোর দক্ষিণ)-এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, সেখানেও হেরেছিলেন।
আরও পড়ুন- এবার তামিল রাজনীতিতে সিনে দুনিয়ার আরেক সুপারস্টার, বিজয়ের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা কতটা?
থালাপতি বিজয়
তামিল ভাষায় থালাপতি শব্দের অর্থ কমান্ডার। বিজয়কে এভাবেই দেখেন তামিলনাড়ুর সিনেমাপ্রেমী জনগণ। সেই বিজয় বহু বছর ধরেই রাজনীতিতে প্রবেশের ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন। বিজয়ের ছবি- অ্যাটলি'স মেরসাল (২০১৭)-এ, এমজিআরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জনপ্রিয়তা এবং ব্যাপক ফ্যানবেসের পরিপ্রেক্ষিতে দু'জনের তুলনা করা হয়েছে। বিজয় বলেছেন যে তাঁর দল স্বচ্ছতা এবং নির্দলীয় শাসনের প্রতিশ্রুতিতে মনোনিবেশ করবে। তামিল সংস্কৃতি এবং ভারতীয় সংবিধানের মূল্যবোধকে মেনে চলবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র পথ তৈরির লক্ষ্যে বিজয় তাঁর সংলাপকে সাবধানে বেছে নিয়েছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। বিজয় বলেছেন, 'একদিকে, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অনাচারে রাজনীতির সংস্কৃতি কলঙ্কিত হয়েছে। অন্যদিকে, একটি বিভক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে, যা বর্ণ ও ধর্মীয় পার্থক্যের মাধ্যমে আমাদের জনগণকে খণ্ডিত করার চেষ্টা করছে।' বিজয়ের ফ্যান ক্লাবের সদস্যরা, 'থালাপতি বিজয় মক্কাল আইয়াক্কাম (টিভিএমআই)' এর আগে নির্বাচনী রাজনীতিতে সাফল্যের স্বাদ পেয়েছে। তামিলনাড়ুজুড়ে টিভিএমআইয়ের সদস্যরা ২০২১ সালে গ্রামীণ বা স্থানীয় নির্বাচনে শতাধিক আসনে জয়ী হয়েছে।