অটিজম এখন অনেক বেড়েছে। নানা জাতীয় হয় এই জড়তা। সময় মতো ফুটছে না কথা, বা দেরিতে বাকস্ফূর্তি, এমন হচ্ছে কোনও কোনও শিশুর ক্ষেত্রে। গাড়িতে দেরিতে স্টার্ট নিলেও, তার পর হাউইয়ের মতো এগিয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। প্রতিভাধর হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটছে তাদের কারও কারও।
কিন্তু এমনও দেখা যাচ্ছে, অনেকের ভাগ্যে সেই শিকে ছিঁড়ছে না। চরম জড়তায় তারা জেরবার। বাবামেয়েরা তাই অন্ধকার দেখছেন। সব মিলিয়েই এই অস্বাভাবিকতাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে বলা হয়-- অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার। বা এএসডি। চোখে অন্ধকার দেখা অ্যাকিউট অটিজমে ভুগছে যারা, তাদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক বা ব্রেনের বিকাশে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকে, যা মাতৃগর্ভেই ঘটে গিয়েছে।
এখন এই অ্যাকিউট এএসডি চিকিৎসায় যুগান্তকারী একটি অগ্রগতি ঘটে গিয়েছে। যে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে সোমবার, ২ মে, নেচার কমিউনিকেশন্স জার্নালে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান দিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাটি করেছেন। বিজ্ঞানীরা অর্গানয়েডের সাহায্যে দেখিয়ে দিয়েছেন কী ভাবে জিনের মিউটেশন বা পরিবর্তনের সঙ্গে চরম অটিজম সম্পর্কিত, এবং কী ভাবে তা স্নায়ুর বিকাশকে ব্যাহত করছে।
তাঁরা দেখিয়েছেন, জিন থারাপির মাধ্যমে জিনের এই বিকাশের সমস্যাটি দূর করে দেওয়া যায় কী ভাবে। আপনারা হয়তো পড়তে গিয়ে অর্গানয়েড শব্দটিতে এসে ঠোক্কর খেয়ে থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে বলি, অর্গানয়েড হল সেই বস্তু, যা মানুষের কোষ (এমব্রায়োনিক স্টেম সেল বা প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেল) থেকে গবেষণাগারে তৈরি করা টিস্যু, যারা স্বনিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন অঙ্গের জন্য এমন টিস্যু তৈরি করা হয়। যার সাহায্যে চেষ্টা করা হচ্ছে অঙ্গসমস্যা দূর করার। ওষুধ বা অঙ্গপ্রতিস্থাপনের বদলে।
বিজ্ঞানীরা এই অর্গানয়েডের মাধ্যমে গোটা একটি অঙ্গ তৈরির কাজেও লেগেছেন। যদি পরীক্ষাগারে আপনার একটি ব্রেন তৈরি করে ফেলা যায়, এবং পুরনো ক্লান্ত অবষণ্ণ ব্রেনটি বাদ দিয়ে সেইটি লাগিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে নিশ্চয়ই ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ হয়ে যাবে। জেনে রাখুন, দিল্লি বহু বহু দূর এখনও। এ পর্যন্ত ব্রেনের অর্গানয়েড তৈরি করা গিয়েছে, যাকে বলা হয়ে থাকে মিনি ব্রেন।
অটিজম, স্কিজোফ্রেনিয়া সহ নানা নিউরোসাইক্রিয়াট্রিক অসুখ অনেক সময়তেই ব্রেন তৈরিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিন ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর ফোর বা টিসিএফ ফোর-এর মিউটেশনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী। যদিও এই জিনটির বিকাশ নিয়ে এখনও খুবই কম জানা গিয়েছে। তবে এটা জানা গিয়েছে যে, এই ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টরের মাধ্যমে কোনও জিনের কাজ শুরু কিংবা কাজ বন্ধ হয়ে থাকে। ফলে এর উপস্থিতি কিংবা অনুপস্থিতি ভ্রুণের বিকাশের উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
বিজ্ঞানীরা এই জিনটি নাড়াচাড়া করতে করতে পিট হপকিন্স সিনড্রোমের উপর কড়া নজর ফেলেছেন। অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডারের এটি অ্যাকিউট বা চরম অবস্থা। এই জেনেটিক সমস্যায় ভোগা শিশুরা চারপাশটা একেবারেই বুঝতে পারে না, স্নায়বিক চরম দৌর্বল্য থাকে, কথা বলতে পারে না।
বিজ্ঞানীরা পিট হপকিন্স সিনড্রোমের যে ইঁদুর মডেলটি রয়েছে, তার উপর নির্ভর করেননি। তাঁরা এ ক্ষেত্রে মানব গবেষণা মডেল তৈরি করেছেন। রোগীর ত্বকের কোষ থেকে স্টেম সেল তৈরি করেছেন প্রথমে, তার পর তা থেকে ত্রিমাত্রিক ব্রেন অর্গানয়েড বা মিনি ব্রেন তৈরি করা হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের দল দুটি আলাদা জিন থেরাপির কৌশল নিয়েছিলেন এই পিট হপকিন্স সিনড্রোম সারাতে, বা ব্রেন মেরামত করে এটি দূর করতে। দেখা গিয়েছে দুটি পদ্ধতিতেই টিসিএফ-ফোর বেড়েছে, এবং এই জিনের বৃদ্ধিতে পিট হপকিন্স সিন্ড্রোম সারছে। যা হচ্ছে আণবিক, কোষীয় এবং ইলেক্ট্রোফিজিওলজিকাল স্তরে।
মোদ্দা কথাটা হল, এই প্রবল অটিজম থেকে মুক্তির আলো দেখা যাচ্ছে এই গবেষণায়। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো স্কুল অফ মেডিসিনের প্রোফেসর অ্যালিসন আর মুওত্রি, যিনি আবার ইউসি সান দিয়েগো স্টেম সেল প্রোগ্রামের ডিরেক্টরও, বলছেন, 'এটা বাস্তব আমরা এই জিনটির (TCF4) সংশোধন ঘটিয়ে দেখতে পাচ্ছি পুরো স্নায়ুতন্ত্র নতুন করে কাজ শুরু করছে। এটা অবাক করার মতোই।'
আরেক অধ্যাপক ফ্যাবিও পেপস প্রায় একই রকম বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তবে তাঁরা বলছেন, জন্মানোর আগের অবস্থায় জিনের বদল ঘটানো হয়েছিল এই কাজে। এখন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের মাধ্যমে দেখতে হবে যে, পরবর্তীকালে এই বদল ঘটানো হলে তা সুরক্ষিত ও কার্যকর কিনা।
বিজ্ঞানীদের এই দলটি সেই প্রস্তুতিতেই এখন ব্যস্ত রয়েছেন। তবে তাঁদের প্রবল আশা, মেরুদণ্ডে এই জেনেটিক ইনজেকশন মুমূর্ষু টিসিএফ-ফোরের কাজকর্ম চাঙ্গা করে তুলবে। ভাষা পেয়ে যাবে জড়তায় নির্বাক কোনও শিশু। চার পাশটা তার কাছে বাঙ্ময় হয়ে উঠবে। এবং শান্তির আরাম পাবেন তাদের বাবা-মায়েরা।