২০১৯ সালে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা সিএএ)-বিরোধী প্রতিবাদ, বিশেষ করে সিএএ-র সঙ্গে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস বা এনআরসি) সংযুক্তিকরণের বিরুদ্ধে। এই আইন কোন শ্রেণীর ওপর কী প্রভাব ফেলবে, এবং দেশের মুসলিম নাগরিকরা কেন এই আইন নিয়ে বিশেষভাবে ভাবিত, তা নিয়ে চলছে দেশজোড়া বিতর্ক।
আপনার জন্য এনআরসি-র তাৎপর্য কী?
সেটা নির্ভর করছে আপনি আসামের বাসিন্দা কিনা, তার ওপর। তার কারণ আসামে ইতিমধ্যে নাগরিকপঞ্জিকরণ প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার সূচনা হয় ১৯৫১ সালে, এবং যা সম্পূর্ণ হয় ২০১৯-এ। আসামই একমাত্র রাজ্য, যেখানে নাগরিকপঞ্জি গঠিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রস্তাবিত দেশজোড়া এনআরসি-র কোনও আইনসিদ্ধ দৃষ্টান্ত এখনও নেই।
আরও পড়ুন: CAA: বড় প্রতিশ্রুতি রক্ষার পথে কেন্দ্র? কিছুক্ষণ পরেই ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী মোদীর
গত ৯ ডিসেম্বর সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, দেশজোড়া এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করার তোড়জোড় চলছে, তবে তিনি নতুন নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে এনআরসি-র তফাৎ করে দেন এই বলে যে, এনআরসি-র ক্ষেত্রে কোনোরকম ধর্মীয় বিধিনিষেধ থাকবে না। দেশজোড়া এনআরসি চালু করতে সরকার কোনও নতুন আইন আনবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ভারতের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) একটি 'FAQ' বা 'সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্নের' তালিকা প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়েছে "এটা মনে রাখা জরুরি যে রাষ্ট্রীয় স্তরে এনআরসি শুরু করার কোনও ঘোষণা হয়নি"। উল্লেখ্য, শাহ বরাবরই বলে আসছেন যে এনআরসি প্রক্রিয়া ভারতীয় নাগরিক এবং অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে ফারাক করে দেবে।
বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় এনআরসি নিয়ে সুর নরম করতে আরম্ভ করে সরকার। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিষন রেড্ডি বলেন, কবে এই প্রক্রিয়া শুরু হবে, এবং কীভাবে তা পরিচালিত হবে, তা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয় নি সরকার। "এখনও খসড়াও তৈরি হয়নি। ক্যাবিনেট বা আইনি বিভাগ তাদের অনুমোদন দেয়নি। এক্ষুনি এনআরসি হচ্ছে না। কিছু লোক এনআরসি-র নাম করে ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা করছে," বলেন মন্ত্রী।
আসাম কেন আলাদা?
২০১৩ সালে আসামে এনআরসি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আসামের ইতিহাস অনেকাংশেই অভিবাসীদের আসা-যাওয়া ঘিরে গড়ে উঠেছে, এবং সেখানে প্রতিবাদ মূলত সিএএ-র বিরুদ্ধে, এনআরসি নয়। আসাম এবং ভারত সরকার, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AASU), এবং অল আসাম গণ সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে ১৯৮৫ সালে ছয় বছরের গণ আন্দোলনের শেষে স্বাক্ষরিত আসাম চুক্তি অনুযায়ী, আসামের যে কোনও বাসিন্দা যদি ২৫ মার্চ, ১৯৭১-এর আগে আসামে নিজের, অথবা পূর্বপুরুষের, বসবাসের প্রমাণ দিতে পারেন, তবে তিনি ভারতীয় নাগরিক গণ্য হবেন। এনআরসি-র এই সময়সীমা সিএএ-র দৌলতে বেড়ে দাঁড়াবে ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪, তবে শুধুমাত্র তিনটি দেশ থেকে আসা অ-মুসলিম অভিবাসীদের ক্ষেত্রে।
১৯৭১ সালের আগে আসামে নিজেদের অথবা পূর্বপুরুষদের বসবাসের প্রমাণ দিতে সেরাজ্যের আবেদনকারীদের ১৪টি সম্ভাব্য নথির যে কোনও একটি দেখাতে বলা হয়েছিল:
১. ১৯৫১ এনআরসি; অথবা
২. ২৪ মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত ভোটার তালিকা; অথবা
৩. আরও ১২ রকমের নথির যে কোনও একটি, যথা জমির বা প্রজাস্বত্বের দলিল; নাগরিকত্বের দলিল; পাসপোর্ট; বোর্ড/ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট
জমা দেওয়া কোনও নথি যদি কোনও পূর্বপুরুষের নামে হয়ে থাকে, তবে তাঁর সঙ্গে আবেদনকারীর সম্পর্ক প্রমাণ করার জন্য কিছু অতিরিক্ত নথিও জমা দিতে হয়েছে - যেমন র্যাশন কার্ড, এলআইসি/ব্যাঙ্কের দলিল, অথবা শিক্ষা সংক্রান্ত এমন কোনও সার্টিফিকেট যাতে আবেদনকারী এবং তাঁর অভিভাবক/পূর্বপুরুষ উভয়েরই নাম রয়েছে।
আসামের বাইরে এনআরসি হলে কী কী নথিপত্র প্রয়োজন?
তাদের FAQ-এর তালিকায় প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো জানায়: "যদি এটি বাস্তবায়িত হয়, তার অর্থ এই নয় যে কাউকে ভারতীয় হওয়ার প্রমাণ দিতে হবে...ঠিক যেমন ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করাতে অথবা আধার কার্ড করাতে আমরা পরিচয়পত্র জমা দিই, সেই ধরনেরই নথি এনআরসি-র জন্য জমা দিতে হবে, যখন যেমনভাবে তা চালু করা হবে।"
প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো আরও জানিয়েছে যে বাবা-মায়ের নামে বা তাঁদের দিয়ে কোনোরকম নথি জমা করানোর বাধ্যবাধকতা নেই। গ্রহণযোগ্য নথি সংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্ত এখনও নেওয়া হয়নি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে: "তালিকায় সম্ভবত থাকবে ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট, আধার, নানারকমের লাইসেন্স, বীমার কাগজ, বার্থ সার্টিফিকেট, স্কুল ফাইনালের সার্টিফিকেট, বাড়ি বা জমি সংক্রান্ত দলিল বা কোনও সরকারি আধিকারিকের জারি করা ওই ধরনের দলিল। যাতে কোনও ভারতীয় নাগরিকের অনাবশ্যক হয়রানি না হয়, তাই নথির তালিকায় আরও কিছু সংযোজন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।"
কেউ যদি নিরক্ষর হন, এবং তাঁর কাছে কোনোরকম নথিপত্র না থাকে, তিনি কাউকে সাক্ষী হিসেবে সঙ্গে আনতে পারেন। এছাড়াও অন্যান্য প্রমাণ এবং সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায় দ্বারা যাচাইকরণও অনুমোদিত হবে বলে জানিয়েছে ব্যুরো।
কোনও ভারতীয় নাগরিককে অযথা হয়রান হতে হবে না বলে ঘোষণা করেছে প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো। কিন্তু যেখানে এনআরসি-র কাজই হলো নাগরিকদের চিহ্নিত করা, সেখানে FAQ-এর তালিকায় "ভারতীয় নাগরিক" বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
দেশজোড়া এনআরসি হলে তার সময়সীমা কী হতে পারে?
এর কোনও উত্তর এখনও না পাওয়া গেলেও, নাগরিকত্ব আইন যথাস্থানেই রয়েছে। সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট ১৯৫৫ (১৯৮৬ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, ১ জুলাই, ১৯৮৭ পর্যন্ত ভারতে যিনিই জন্মগ্রহণ করেছেন, তিনিই ভারতীয় নাগরিক। ১ জুলাই, ১৯৮৭ বা তার পরে কেউ জন্মালে একটি বাড়তি শর্ত রয়েছে: বাবা-মায়ের মধ্যে অন্তত একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতে হবে। এই আইন ফের সংশোধিত হয় ২০০৩ সালে, যখন বলা হয়, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৪-এর পর যারা জন্মেছে, তাদের বাবা-মায়ের একজনকে ভারতীয় নাগরিক হতেই হবে, এবং অন্যজনও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হলে চলবে না।
বলা বাহুল্য, এই শর্তাবলী আসামে প্রযোজ্য নয়, যেহেতু সেখানে সময়সীমা ১৯৭১ সাল। দেশের অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০-এর পর ভারতের বাইরে জন্মগ্রহণ করেছেন, এবং বৈধ নথিপত্র ছাড়াই ভারতে বসবাস করছেন, এমন কেউ থাকলে তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হবেন।
কেন বলা হচ্ছে যে হিন্দুদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা?
অমিত শাহ যদিও বলেছেন যে এনআরসি প্রক্রিয়ায় ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করা হবে না, সিএএ + এনআরসি প্রক্রিয়া কিছু হিন্দুর ক্ষেত্রে অন্যরকম হতে পারে।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার আগে পর্যন্ত শাহ বারবার জোর দিয়ে বলেছিলেন যে আগে আইন পাশ হবে, তারপর এনআরসি লাগু করা হবে। এই ঘটনাক্রম কিছু হিন্দুর পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাঁদের পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থান বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, বা পাকিস্তান। যদি সারা ভারতে এনআরসি প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, তবে বাতিল তালিকায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বেশ কিছু হিন্দুরও। যেমন হয়েছে আসাম এনআরসি-র ক্ষেত্রে, যেখানে ৩.২৯ কোটি আবেদনকারীর মধ্যে চূড়ান্ত তালিকায় পৌঁছেছেন ৩.১ কোটি। যে ১৯ লক্ষ বাদ পড়েছেন, তাঁদের অধিকাংশই হিন্দু।
দেশজোড়া এনআরসি হলে তা থেকে যদি ৫ শতাংশও বাদ পড়েন, তাহলেও সেই সংখ্যাটা দাঁড়ায় অন্তত ৬.৫ কোটি মানুষ। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমবঙ্গ, এবং কিছু ক্ষেত্রে গুজরাট, দিল্লি, রাজস্থান এবং পাঞ্জাবে এমন অনেক হিন্দু রয়েছেন, যাঁদের আদি নিবাস নাগরিকত্ব আইনে উল্ললিখিত তিনটি দেশের একটিতে। সংসদে অমিত শাহ বলেছিলেন, নতুন আইনের আওতায় কেউ নাগরিকত্বের আবেদন জানালে তাঁর কাছে কোনও নথিপত্র চাওয়া হবে না। এর ফলে সম্ভাব্য এনআরসি তালিকা থেকে যেসব হিন্দু বাদ পড়বেন, তাঁদের কয়েকজনের বাঁচার রাস্তা খুলে যেতে পারে।
কিন্তু দেশের সমস্ত হিন্দুর কাছে এই রাস্তা খোলা নেই। যেমন ধরুন, অন্ধ্রপ্রদেশ বা কেরালায় কেউ তাঁদের বংশলতিকার সূত্র ধরে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বা বাংলাদেশে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা "নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ" ছিলেন বলে দাবি করতে পারবেন না। বিরোধী নেতাদের অভিযোগ, সিএএ লাগু করে, এবং দেশজোড়া এনআরসি-র জোরালো দাবি তুলে, তাদের বাঙালি হিন্দু ভোট ব্যাঙ্ককে তোষণ করতে চাইছে বিজেপি।
এনআরসি থেকে বাদ পড়লে কোনও হিন্দু কি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন?
সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাম এনআরসি থেকে বাদ পড়া হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই ঢালের প্রস্তাব দিয়েছেন বটে। তাঁর কথায়, সিএএ-র আওতায় নাগরিকত্বের আবেদন জানালে বাকি সবরকমের আইনি প্রক্রিয়া বাতিল হয়ে যাবে। সিএএ লাগু না হলে এনআরসি থেকে বাদ পড়লে আসামের ফরেন ট্রাইব্যুনালের মতো আদালত ছাড়া গতি নেই।
কিন্তু অন্যান্য রাজ্যেও এনআরসি থেকে বাতিল হওয়া হিন্দুদের কাছে এই ঢাল থাকবে কিনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়। আসামেও এক্ষেত্রে অসঙ্গতি দেখা দিয়েছে। রাজ্যসভায় এই প্রসঙ্গ তুলে কংগ্রেস সাংসদ কপিল সিব্বল প্রশ্ন করেন, আসামে কোনও হিন্দু যদি এনআরসি থেকে বাদ পড়ে থাকেন, তবে কীভাবে তিনি নাগরিকত্ব আইনের ঢাল ব্যবহার করবেন? তাঁর বক্তব্য, "এইসব মানুষ তাঁদের উত্তরাধিকার দলিলপত্রে (legacy papers) কী লিখেছিলেন জানেন? যে তাঁরা ভারতের নাগরিক। আপনারা আইন করে তাঁদের এই মিথ্যেটা বলতে বাধ্য করছেন যে তাঁরা নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন।"
কিন্তু এই ঢাল কি কর্ণাটকের চিকমাগালুর, বা মধ্যপ্রদেশের চান্দেরি, বা কেরালার কোঝিকোড়ের কোনও হিন্দু বাসিন্দার কাছে উপলব্ধ করা যায় না?
এর উত্তর এখনও অজানা। নিজেদের এনআরসি এবং সিএএ-র আবেদনে দু'রকম তথ্য সরবরাহ করা ছাড়াও আরও একটি বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। আসামে অথবা বাংলায় একজন বাঙালি হিন্দু দাবি করতে পারেন যে তিনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। মধ্য অথবা দক্ষিণ ভারতে প্রশ্ন উঠছে, সিএএ-র অধীনে কি কোনও আবেদনকারী দাবি করতে পারেন যে তিনি বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে এসেছেন?
যেহেতু সিএএ-র কোনও নিয়মাবলী এখনও গঠিত হয়নি, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, বা আফগানিস্তান থেকে আসা অ-মুসলিমদের 'ফাস্ট-ট্র্যাক' নাগরিকত্বের আবেদন করতে হলে কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে, তা এখনও অস্পষ্ট।
এই কারণেই কি সিএএ এবং দেশজোড়া এনআরসি-র সংযুক্তিকরণ নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন?
তাঁদের কাছে সিএএ-র রক্ষাকবচ নেই, এটা অবশ্যই তাঁদের উদ্বেগের একটি বড় কারণ। এনআরসি-তে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাব্য যোগ্যতা যদি কোনও মুসলিমের না থাকে, তবে চূড়ান্ত তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশিত না হলে নাগরিকত্ব হারাবেন তিনি।
দ্বিতীয় চিন্তা এনআরসি প্রক্রিয়া নিয়েই - যদি নথির অভাব, বা জমা দেওয়া নথিতে কোনোরকম খামতির ফলে তালিকা থেকে বাদ পড়তে হয়। এমন আশঙ্কা রয়েছে যে মুসলিম সম্প্রদায়, যার অনেকেই পিছিয়ে পড়া বর্গের মানুষ, নথিতে বানান ভুলের মতো অসঙ্গতির ফলে বাদ পড়ে যাবেন। বাস্তবে এই ঘটনা আসামে অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তিনি হিন্দু হোন বা মুসলিম, যদিও সেরাজ্যের আদতে অভিবাসী মুসলিমরা পুরুষানুক্রমে নিজেদের নথিপত্র সামলে রাখার ব্যাপারে সাধারণত অত্যন্ত সতর্ক।
এছাড়াও যা মুসলিমদের ভাবাচ্ছে, তা হলো বর্তমান এবং আসন্ন ডিটেনশন সেন্টার বা আটক কেন্দ্র, যেখানে ঠাঁই হবে এনআরসি তালিকা থেকে বাদ পড়া সকলের। ইতিমধ্যেই ছ'টি জেল-সংলগ্ন আটক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে আসামে, এবং একটি পৃথক কেন্দ্র তৈরি হচ্ছে গোয়ালপাড়ায়। এবছর মুম্বই এবং বেঙ্গালুরুতেও খোলা হয় আটক কেন্দ্র।
তাঁর বিভিন্ন মন্তব্যে দেশজোড়া এনআরসি-র কথা বলতে গিয়ে মুসলিমদের উল্লেখ করেন নি অমিত শাহ। পশ্চিমবঙ্গে ১১ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি বলেন, "আমরা (বিজেপি) দেশ থেকে বৌদ্ধ, হিন্দু, এবং শিখ বাদে আর সমস্ত অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াব।" টুইটারে বিজেপি'র একটি অ্যাকাউন্ট থেকে এই মন্তব্য টুইট করা হলেও পরে তা মুছে ফেলা হয়।
কোনও মুসলিম রাজনৈতিক নেতা কী এইসব উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন?
লোকসভায় আইন পাশ হওয়ার আগে বিতর্ক চলাকালীন অল ইন্ডিয়া মজলিস-এ-ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমিন (AIMIM) নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি অভিযোগ তোলেন যে এই আইনের প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো মুসলিমদের রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া। তাঁর কথায়, "এই বিল যদি অনুমোদন পায়, তবে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে শুধুমাত্র মুসলিমদের মামলা নিয়েই কারবার হবে।"
সমাজবাদী পার্টির সাংসদ এস টি হাসান নাগরিকত্ব আইনকে এনআরসি-র অগ্রদূত বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, "মুসলিমদের কাছে পাঁচ বছর বসবাসের প্রমাণ পর্যন্ত নেই...মুসলিমরা ভয় পাচ্ছেন যে তাঁদের নাম এনআরসি-তে উঠবে না, এবং তাঁরা অনুপ্রবেশকারী ঘোষিত হবেন।"
চারজন সাংসদ সম্বলিত ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ সুপ্রিম কোর্টে সিএএ এবং দেশজোড়া এনআরসি-কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন এই ভিত্তিতে যে, এর ফলে নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে না পারলে সরাসরিভাবে নিশানা হয়ে পড়বেন ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা, যা কিনা ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করছে।
মুসলিমদের ভয় কাটাতে সরকার কী বলেছে?
'ইন্ডিয়া টুডে'-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সিএএ-র সঙ্গে এনআরসি-র কোনও যোগ নেই। তাঁর কথায়, "কোনও ভারতীয় নাগরিকের চিন্তা করার কোনও কারণ নেই, কাউকে বহিষ্কার করা হবে না। আমরা বিশেষ সংস্থান রাখব যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও ভারতীয় নাগরিক এনআরসি প্রক্রিয়ার শিকার না হন। কিন্তু আমরা তো সীমান্ত খোলা রাখতে পারি না। ওভাবে কোনও দেশ চলে না।"
শাহ আরও বলেন, "এটা সকলের বোঝা দরকার যে অনুপ্রবেশকারী বা অবৈধ অভিবাসীরা শুধুমাত্র হিন্দুদের সম্পদ বা সুযোগের ক্ষতি করে না, মুসলিমদেরও করে। এনআরসি-র ফলে একজন সংখ্যালঘু ভারতীয়েরও কোনও ক্ষতি হবে না, কিন্তু একজন অনুপ্রবেশকারীকেও ছাড়া হবে না।"
পিআইবি'র FAQ তালিকাতেও এই আশঙ্কা প্রসঙ্গে কিছু কথা রয়েছে:
"ভারতীয় মুসলিমদের কি সিএএ + এনআরসি নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে? কোনও ধর্মের ভারতীয় নাগরিকেরই সিএএ অথবা এনআরসি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।"
"এনআরসি থেকে কি ধর্মের ভিত্তিতে কেউ বাদ পড়বেন? না, এনআরসি একেবারেই ধর্ম-সংক্রান্ত নয়। যেখানেই এনআরসি লাগু হবে, না তা ধর্মের ভিত্তিতে চালু হবে, না ধর্মের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত করা যাবে। শুধুমাত্র কোনও একটি ধর্মের অনুগামী বলে কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না।"
দেশজোড়া এনআরসি না হলে কি সিএএ নখদন্তহীন হয়ে পড়বে?
লোকসভায় একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনে ওয়েইসি বলেন, সমস্ত নির্যাতিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এর উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রতিপন্ন করা যে দেশজোড়া এনআরসি হলে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্য করবে না সিএএ। আবার উল্টোটাও সত্যি: দেশজোড়া এনআরসি না হলে অন্তত ভারতীয় মুসলিমদের ক্ষেত্রে নখদন্তহীন হয়ে পড়বে সিএএ।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পূর্বতন খসড়ার বিরোধিতা করতে গিয়ে বলছিলেন, বাংলাদেশকে সমীকরণের বাইরে রাখলে এই আইনকে স্বাগত জানানো হতো, এবং আসামের কাছেও এটি গ্রহণযোগ্য হতো।
কিন্তু সুপ্রিম কোর্টে এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষেত্রে সম্ভবত আইনটির সাংবিধানিক বৈধতার খতিয়ান নেওয়া হবে। দেশজোড়া এনআরসি-র সম্ভাবনার নিরিখে সিএএ-কে কী চোখে দেখবে সুপ্রিম কোর্ট, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
অনেক ভারতীয়ই কি অ-নথিভুক্ত?
UIDAI-এর ওয়েবসাইট অনুযায়ী, এবছরের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২৪.৯৫ কোটি ভারতীয়কে আধার কার্ড জারি করা হয়েছে। টেলিকম নিয়ন্ত্রক TRAI বলছে, ভারতে ২০১৮ সালে ১০২.৬ কোটি সক্রিয় মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ছিলেন। দেশের জনসংখ্যার হিসেব করলে (২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী যা ছিল ১২১ কোটির বেশি, এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের হিসেবে ২০১৭ সালে যা ছিল ১৩৩.৯ কোটি) একথা বলাই যায় যে দেশের বেশিরভাগ বাসিন্দাই হয় আধার কার্ড, নয় মোবাইল ফোন কানেকশনের মাধ্যমে নথিভুক্ত।
মুশকিল হলো, এর কোনোটিই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর যদিও বলেছেন যে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে আধার কার্ডই যথেষ্ট, আধার আইনের ৯ নম্বর ধারা বলছে যে আধার কার্ড নম্বর অথবা তার প্রমাণীকরণ না নাগরিকত্বের অধিকার প্রদান করে, না তা এককভাবে নাগরিকত্ব অথবা বাসস্থানের প্রমাণ।
এবছরের লোকসভা নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন জানায় যে দেশে ৯০ কোটি নিবন্ধভুক্ত অথবা রেজিস্টার্ড ভোটার রয়েছেন। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ৬০ কোটির বেশি নাগরিক (সেসময়ের জনসংখ্যার ৫৯ শতাংশ) ছিলেন ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী, কিন্তু সময়ের তারতম্যের ফলে এই তথ্যের ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল।
একাধিক রাজ্য দেশজোড়া এনআরসি-র অংশ হবে না বলে জানিয়েছে। এই মনোভাবের অর্থ কী?
তাদের রাজ্যে এনআরসি প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে না, একথা বলে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে বিরোধী-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং পাঞ্জাব। নাগরিকত্ব, বহিরাগত, এবং রাষ্ট্রের নাগরিক অধিকারদান, এই বিষয়গুলির ওপর সংবিধানের সপ্তম তফসিলের লিস্ট ১ অনুযায়ী সংসদের একচেটিয়া অধিকার।
বাংলার সঙ্গে এ বিষয়ে হাত মিলিয়েছে কেরালা, এবং ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার (এনপিআর) আপডেট করার প্রক্রিয়া আপাতত মুলতুবি রাখবে বলে ঘোষণা করেছে। যদিও এনপিআর-কে বলা হয়েছে ২০২১ সালের জনগণনার প্রারম্ভিক পদক্ষেপ, এটি কার্যত এনআরসি-র পথে "প্রথম পদক্ষেপ", এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে।
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন ও ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব (নাগরিকের নথিভুক্তিকরণ ও জাতীয় আইডেন্টিটি কার্ড জারি) বিধি অনুসারে এনপিআর তৈরি করা হচ্ছে। ভারতের প্রত্যেক সাধারণ বাসিন্দার এনপিআরে নাম নথিভুক্তিকরণ বাধ্যতামূলক। এনআরসি-তে যেমন নাগরিকত্বের বিষয় রয়েছে, এনপিআর তেমন কিছু নয়। ছ'মাসের বেশি সময় ধরে কোনও ভিনদেশি কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় বসবাস করলে তাঁর নামও তালিকায় নথিভু্ক্ত হবে।
যেসব ভারতীয় নথিভুক্ত
ভারতের জনসংখ্যা: ১৩৪ কোটি
এটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী। ২০১১ সালের জনগণনায় ভারত সরকারের পরিসংখ্যান ছিল ১২১ কোটি।
আধারের সংখ্যা: ১২৫ কোটি
এই সংখ্যা চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নেওয়া তথ্য অনুযায়ী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখেও বলতে হয়, এটি একটি বিপুল সংখ্যা।
নথিভুক্ত ভোটার: ৯০ কোটি
অন্তত ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সময় পর্যন্ত। উদাহরণ স্বরূপ, ২০০১ সালে দেশের জনসংখ্যার ৫৯ শতাংশের (৬০ কোটি মানুষের বেশি) ভোট দেওয়ার বয়স হয়ে গিয়েছিল।
র্যাশন কার্ড: ২৩ কোটি
জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীনে, নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত
পাসপোর্ট: ৬.৬০ কোটি
২১ ডিসেম্বর, ২০১৯ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী
আয়কর দাতা: ৪২ কোটি
ফেব্রুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত এই সংখ্যক প্যান কার্ড জারি করা হয়েছে, বলেছেন সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ডিরেক্ট ট্যাক্সেস বা CBDT-র চেয়ারম্যান সুশীল চন্দ্র।
মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী: ১০২ কোটি
২০১৮ সালে এতজন সক্রিয় মোবাইল ব্যবহারকারী ছিলেন, জানাচ্ছে টেলিকম নিয়ন্ত্রক TRAI