পঁচাত্তর বছর আগে এই সেই দিন (৩০ জানুয়ারি)। মহাত্মা গান্ধী দিল্লির বিড়লা হাউসে প্রার্থনা মণ্ডপের দিকে হাঁটছিলেন। আচমকা এগিয়ে আসেন বছর ৩৫-এর নাথুরাম গডসে। একেবারে সামনে এসে পকেট থেকে বের করেন পিস্তল। পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তিনটি গুলি ছোড়েন গান্ধীর দিকে। মহাত্মা গান্ধীর বুকে, পেটে এবং কুঁচকিতে আঘাত করেছিল গুলিগুলো। ১৫ মিনিটের মধ্যেই প্রয়াত হন 'জাতির পিতা'। ঘটনাস্থলে উপস্থিত সামরিক বিভাগের কর্মীরা গডসেকে আটক করেন। তাঁর পিস্তল ছিনিয়ে নেন। পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার আগে ঘাতক গডসেকে উপস্থিত উত্তেজিত জনতা মারধর করে। পরে তুঘলক রোড থানায় গডসের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের হয়।
লালকেল্লায় বিচার
১৯৪৮ সালের মে মাসে দিল্লির লালকেল্লায় একটি বিশেষ আদালতে গডসের বিচার শুরু হয়। তার আগে লালকেল্লায় শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিচার হয়েছিল। সেই বিচারের পর বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। তার প্রায় নয় দশক পরে, এই লালকেল্লায় বিচার হয়েছিল নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীর জওয়ানদের। তার পর ছিল নাথুরাম গডসের পালা।
বিচারের দায়িত্বে
ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের বিচার বিভাগীয় শাখার প্রবীণ সদস্য বিশেষ বিচারক আত্মা চরণের সামনে বিচার হয়েছিল। সরকারপক্ষের আইনজীবীদের নেতৃত্বে ছিলেন বোম্বাইয়ের তৎকালীন অ্যাডভোকেট জেনারেল। যিনি পরে ভারতের সলিসিটর জেনারেল। তারও পরে ভারতের অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন। নারায়ণ আপ্তে এবং বিনায়ক সাভারকর-সহ অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে গডসেকেও পছন্দের আইনজীবীর সাহায্য নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
গডসেও আইনি সাহায্য পেয়েছিল
তাঁর লেখা বই, 'কেন তারা গান্ধীকে হত্যা করেছে: মতাদর্শ এবং ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন'-এ অশোককুমার পাণ্ডে লিখেছেন, 'আইন তার নিজের পথে চলেছিল। সরকারি খরচে গডসেকে আইনি সাহায্য দেওয়া হয়েছিল। জেলে থাকাকালীন তাঁর বেশিরভাগ চাহিদাই পূরণ করা হয়েছিল।' শুনানির দ্বিতীয় দিনে গডসে স্বীকার করে নেন যে আটক থাকাকালীন সবাই তাঁর সঙ্গে নাগরিকের মতই আচরণ করেছিল। ১৯৪৮ সালে জুন থেকে নভেম্বরের মধ্যে বিশেষ আদালত ১৪৯ জন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান শোনে। সরকারি আইনজীবী আদালতে ৪০৪টি তথ্যচিত্র এবং ৮০টি অন্যান্য প্রমাণ পেশ করে।
অন্যতম ষড়যন্ত্রকারীই সাক্ষী
পরবর্তীতে গডসে এবং অন্যান্যদের আবেদনের শুনানি হয়েছিল পঞ্জাব হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চে। এই বেঞ্চের সদস্য ছিলেন বিচারপতি জিডি খোসলা। তিনি তাঁর বই 'দ্য মার্ডার অফ দ্য মহাত্মা'য় লিখেছেন, সরকারপক্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন দিগম্বর ব্যাজ। 'ষড়যন্ত্রকারীদের একজন ছিলেন ব্যাজ। হত্যার পরিকল্পনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল।' তাঁর গ্রেফতারের পর, ব্যাজ নিজের অপরাধ স্বীকার করে নেন। বিচারপর্বে সহযোগীদের দোষারোপ করতে (অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে) রাজি হন।'
আরও পড়ুন- ‘আমি ক্ষুদ্র মানুষ, সমালোচনা থেকেই শিখি’, বইমেলায় বললেন মমতা
সাজা ও উচ্চ আদালতে আবেদন
১৯৪৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বিচারক আত্মা চরণ অভিযুক্ত গডসে, আপ্তে এবং অন্য পাঁচ জনকে অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেন। গডসে এবং আপ্তে উভয়কেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সাভারকর খালাস পান। বিচারক আরও ঘোষণা করেন যে দোষীরা আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারে। চার দিন পরে, সাজাপ্রাপ্তরা সবাই রায়ের বিরুদ্ধে পঞ্জাব হাইকোর্টে আবেদন জানায়। সেই সময় পঞ্জাব হাইকোর্ট ছিল পূর্ব পাঞ্জাব হাইকোর্ট নামে পরিচিত। আর, এই হাইকোর্ট ছিল সিমলায়।
আবেদনে গডসের ভূমিকা
মজার বিষয় হল, গডসে তার সাজার বিরুদ্ধে আবেদনের পরিবর্তে অন্য বিষয়ে আবেদন করেছিল। আদালত তদন্ত চালিয়ে দেখতে চেয়েছিল গান্ধী হত্যায় গডসে কি একাই জড়িত ছিল? নাকি গান্ধী হত্যার পিছনে ছিল বৃহত্তর কোনও ষড়যন্ত্র? নিজের সাজা মকুবের বদলে আদালতের এই তদন্তের চেষ্টার বিরুদ্ধেই আবেদন করেছিল গডসে।
হাইকোর্টে গডসে
বিচারপতি খোসলা, বিচারপতি এএন ভান্ডারি ও বিচারপতি আছরু রাম-সহ একটি বেঞ্চ আপিলের শুনানি করেছিল। বিচার চলাকালীন, গডসে তাঁর পক্ষে কোনও আইনজীবী নিতে অস্বীকার করেন। আর, নিজেই আবেদনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরার অনুমতি চান। আদালত তাঁর আবেদন গ্রহণ করে।
বিচারপতির চোখে গডসে
বিচারপতি খোসলা লিখেছেন যে আদালতে বক্তব্য পেশ করার সময়, ঘাতকের মধ্যে তাঁর অপরাধের জন্য কোনও অনুশোচনা দেখা যায়নি। 'নিজেকে নির্ভীক দেশপ্রেমিক এবং হিন্দু মতাদর্শের একজন উত্সাহী নায়ক' হিসেবে তুলে ধরার সুযোগ গডসে ব্যবহার করেছিলেন। বিচারপতি খোসলা লিখেছেন, 'নিজের নৃশংস অপরাধের জন্য তিনি কোনওরকম অনুতপ্ত ছিলেন না। নিজের বিশ্বাসের প্রতি গভীর বিশ্বাস থেকেই হোক বা শুধুমাত্র জনসাধারণের কাছে শেষবারের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার জন্যই হোক, বিস্মৃতিতে বিলীন হওয়ার আগে তিনি নিজের প্রতিভা প্রদর্শনের এই সুযোগটি চেয়েছিলেন।'
হাইকোর্টের রায়
হাইকোর্টের বেঞ্চ ১৯৪৯ সালের ২১ জুন রায় দেয়। দত্তাত্রয় পারচুরে এবং শংকর কিস্তায়্যারের বিষয়টি ছাড়া হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল রাখে। দত্তাত্রয় পারচুরে এবং শংকর কিস্তায়্যার সমস্ত অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস ঘোষিত হয়েছিলেন।
চূড়ান্ত আবেদন
অভিযুক্তরা প্রিভি কাউন্সিলের কাছে আবেদন করার জন্য বিশেষ ছুটির জন্য একটি আবেদনপত্রও দাখিল করেছিল। তবে, আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। এই প্রিভি কাউন্সিল ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ছিল। পরে, ১৯৫০ সালে প্রিভি কাউন্সিলের স্থান নেয় সুপ্রিম কোর্ট। ভারতের গভর্নর-জেনারেল তাদের করুণাভিক্ষার আবেদন প্রত্যাখ্যান করার পর গডসে ও আপ্টের ফাঁসি অনিবার্য হয়ে ওঠে। এত কিছুর পরও অবশ্য গডসের হয়ে করুণার আবেদন তার বাবা-মা দায়ের করেছিলেন। গডসে করেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালের ১৫ নভেম্বর, অম্বালা জেলে দুজনকেই ফাঁসি দেওয়া হয়।
Read full story in English