শিয়রে শমন। কোভিড-১৯। মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রাচীন ভারতের ‘হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো’ বা প্রাচীন চীনের ‘হামিন মাঙ্ঘ্যা’ ও ‘মিয়াওঝিগউ’-এর ইতিহাস। সম্ভবত যূথবদ্ধ ও ঘনিষ্ঠ বসবাসের দরুন, ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাবে অজানা মারণ রোগের শিকার হয়েছিল মানুষ। তাই কোভিড-১৯ এর নিদারুন সময়ে কতগুলি কথা সবার জানা উচিত, যা আমাদেরকে গৃহবন্দী থাকতে আস্বস্ত করবে, এবং এই অতিমারীকে জয় করতে আত্মস্থ করবে।
বর্তমান পৃথিবীর পারিবারিক সদস্য প্রায় ৮০০ কোটি। মানুষের শরীরে আছে এর হাজার গুণের বেশী জীবনের একক বা কোষ। অর্থাৎ প্রায় ৮০০ হাজার কোটি কোষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো এরা প্রকার ভেদে প্রায় ২১০ রকমের। সংখ্যা, আকার ও প্রকারভেদে আলাদা আলাদা। আমরা খালি চোখে যে কণা বা বিন্দু দেখতে সক্ষম (১০০ মাইক্রন) তার দশভাগের এক ভাগ আকারের কম-বেশী - আমাদের দেহকোষ (১০ মাইক্রন), যা খালি চোখে দেখা যায় না। আবার প্রত্যেক শ্রেণীর কোষের নিজস্ব জীবনধারা ও জীবনচক্র আছে। কেউ মাত্র কয়েক ঘন্টা, আবার কেউ মানুষের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে।
আমাদের দেহে এরকম গড়ে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ কোষ জন্মাচ্ছে ও মরছে। মানুষ সহ সমস্ত জীবই নিরন্তর তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পরিবেশের কুপ্রভাবের সঙ্গে পঞ্জা কষে চলেছে। তাই পরিবেশ-পরিজন ভালো হলে যেমন আমরা ভালো থাকি, অন্যথায় ভুগি, কোষ-সমাজেও এমনটাই ঘটে। বিপত্তিতে কোষের সংখ্যার হেরফের হয়। অন্যতম কারণগুলির একটি হলো - জীবাণুর সংক্রমণ। জন্মসূত্রে দেহকোষগুলি স্বজাতিদের সম্পর্কে শিক্ষিত ও অভিযোজিত হয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী শরীরকে একটা সুর-সঙ্গমের মধ্যে আবদ্ধ রাখে, এবং আমরা সুস্থ থাকি। কিন্তু বিজাতীয় কেউ শরীরে অনুপ্রবেশ করলে, বিশেষ কিছু কোষ তখন দেহের সাম্য বজায় রাখতে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে বিজাতীয়র উপর আক্রমণ শানায়। এরা মুলত অনাক্রম্য কোষ, থাকে দেহব্যাপী, প্রধানত রক্ত ও লসিকায়, নাম ও কাজের বিভিন্নতায় শ্বেত রক্তকোষ।
যুদ্ধের ফলস্বরূপ সামান্য হাঁচি, সর্দি, নাক দিয়ে জল পড়া, কাশি, জ্বর শুরু হয় - যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় 'ইনফ্লেমেশন' বা প্রদাহ বলা হয়। এই শ্রেণীর কোষবহুল সর্বদা আমাদেরকে পরিবেশের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করে যাচ্ছে। এরাই আমাদের দেহের প্রথম সারির সৈনিক কোষ বা পাহারাদার, সিবিআই। এবং এটাই জন্মগত বা সহজাত অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি। একটু অচেনা বুঝলেই লড়াই শুরু।
প্রাথমিক এই দশার উত্তরণের জন্য দেহের জওয়ান কোষগুলি সক্রিয় হয়ে, বিদেশী অজ্ঞাত শত্রুকে পরাস্ত করে। তাতে অবশ্য এক থেকে পাঁচ দিন লেগেই যায়। যদি দেহ সঙ্কেত পায় যে শত্রুকে প্রাথমিকভাবে কাবু করা গেল না, বশে আনা গেল না, তখন অভিযোজিত অনাক্রম্যতা সক্রিয় হয়ে পড়ে। তা শুরু হয় তিন থেকে সাতদিনের মাথায়। এবার বেশ শক্তিশালী হাতিয়ার - টি কোষ ও বি কোষ - যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথম ক্ষেত্রে বিশেষ অনাক্রম্য কোষ জীবানুকে গলাধঃকরন করে, কেটে-ছিঁড়ে, তার টুকরো বয়ে এনে টি কোষকে সঙ্কেত দিলে, টি কোষ উজ্জিবীত ও সক্রিয় হয়ে বহু রাসায়নিক সঙ্কেত সৃষ্টি করে। তা দিয়েই অনুপ্রবিষ্ট শত্রু (অ্যান্টিজেন) যথেষ্ট কাবু ও পরাস্ত হয়ে পড়ে। তা না হলে এই রাসায়নিক সঙ্কেতের ভাষায় উদ্দীপ্ত ও সৃষ্ট হয় জীবানু আগ্রাসী বিশেষ টি কোষ এবং পরাক্রমী বি কোষ - যারা তৈরি করে অ্যান্টিবডি এবং স্মৃতিধর বি ও টি কোষ। অনাক্রম্য কোষ সমূহের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সৃষ্ট রসায়ন সম্ভারের অনুশীলিত পরিচালনায়, মানবদেহ সুরক্ষিত থাকে।
আরও পড়ুন: করোনা সংক্রমণে চিনকে ছাড়াল ভারত, দ্বিতীয় তরঙ্গ আসন্ন?
আবার আমাদের বেঁচে থাকার জন্য চাই পরিবেশের বায়ু, জল ও খাদ্য। এদের মাধ্যমেই শরীরে অনুপ্রবেশের সুযোগ পায় অজানা, রোগদায়ী জীবাণুর দল। এছাড়া মানুষ সহ বহু কীটপতঙ্গ, পাখী, পশু-বাহিত জীবাণু আমাদের দেহে অনুপ্রবেশ করে। এবং অনাক্রম্য কোষেরা তাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে। যে জীবাণুগুলির অনুপ্রবেশে অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকে, তারা কিন্তু আমাদের কোষের স্বাভাবিক আকারের তুলনায় অনেক ছোট। এরা নামে ও সংখ্যায় বিপুল, সর্বত্র বিরাজমান। এরাই আমাদের এই প্রিয় গ্রহের আদিম জৈবিক সদস্য। এদের বেশীরভাগই আমাদের পাত্তা দেয় না, তাই আমাদেরও কিছু এসে যায় না। মুষ্টিমেয় আণুবীক্ষণিক জীবকুল ও জীবাংশই আমাদের বিপদে ফেলে। এরা ব্যাক্টিরিয়া (দেহকোষের দশ ভাগের এক ভাগ), ভাইরাস (নির্জীব রাসায়নিক বস্তু, ব্যাক্টিরিয়ার এক হাজার ভাগের এক ভাগ), ছত্রাক বা ছাতা ও পরজীবী নামে পরিচিত।
এদের মধ্যে যারা আমাদের আবহাওয়ায়, কাছেপিঠে বায়ু, জল বা খাদ্যে থাকে, তারা আমাদের প্রথম আক্রমণে পরাস্ত করলেও, পরবর্তী অনুপ্রবেশ অতটা ঘাতক হতে পারে না। প্রাথমিক উপসর্গগুলি প্রায়শই দেখা যায়। সেই সুযোগে দেহের অনাক্রম্য কোষগুলি সেয়ানা হয়ে যায়। স্মৃতিধর বি ও টি কোষগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে, বাঁচায়। তাই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশে অভিযোজিত মানুষকুল সেইসব জীবাণুদের সঙ্গে সহাবস্থান করে। জীবন চলতে থাকে। একেই বলে সামাজিক অনাক্রম্যতা বা 'হার্ড ইমিউনিটি'। কিন্তু প্রথম ধাক্কাটা বেশ মারাত্মক হতে পারে। তাতে উৎরাতে না পারলে, জীবকুল নিশ্চিহ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই থাকে। আমরা এখন তা টের পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে।
জীব ও জীবাণুর পারস্পরিক দ্বন্দ্বে যে জেতে, জয়জয়কার তার। সামাজিক অনাক্রম্যতার দরুন আমরা সময়ান্তরে চলতি অসুস্থতার যে প্রবাহ, তাতে গরমকালে সর্দি-জ্বর, চিকেন পক্স; বর্ষাকালে ও পরে দাস্ত-আন্ত্রিক; শীতে কাশি-সর্দি-জ্বর ইত্যাদি ইত্যাদি হয়ে থাকতে দেখেছি। তা আবার ভৌগোলিক সীমানা ভিত্তিক হয়ে ভিন্ন নামে পরিচিতি পায়, যেমন ক্যালকাটা ফিভার, জয় বাংলা; মাদ্রাজ ফিভার প্রভৃতি। এই অসুখের সীমাবদ্ধতা সীমিত। ঋতু পরিবর্তনে তা অদৃশ্য হয়ে যায়। সমাজের স্বাভাবিক মেজাজে খুব একটা তারতম্য বোঝা যায় না। এ ধরনের অসুখকে বলা হয় এন্ডেমিক।
রোগের প্রাদুর্ভাবে যদি রোগীর সংখ্যা অনুমিত সংখ্যা থেকে হঠাৎ বেড়ে যায় এবং তা অন্যান্য ভৌগোলিক সীমানায় ছড়িয়ে পড়ে, মরণাপন্ন ও মৃতের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে ক্রমবর্ধমান হয়, তাকে আমরা বলি এপিডেমিক বা মহামারী (যেমন নিউমোনিয়া, কলেরা, আন্ত্রিক, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, প্লেগ, টাইফয়েড, পোলিও)। কিন্তু যে অসুখ ও তার কারণ (জীবাণু) দেশান্তরী হয়ে অন্য দেশের মানুষদের কাবু করে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়, যখন তার ভয়াবহতা মানুষকে স্তম্ভিত করে, ভাবতে শেখায় বাঁচার নতুন পথ উদ্ভাবনের, তা হলো প্যান্ডেমিক। যেমন কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্ত, পোলিও, এইডস, নানাবিধ জ্বর - বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু বা বর্তমানের ত্রাস, করোনাভাইরাস ঘটিত ফ্লু।
সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে গতিশীল। যার প্রভাব মহামারীর প্রকোপকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মহামারী যা এককালে ছিল এন্ডেমিক-এপিডেমিক, তাই সভ্যতার হাত ধরে প্যান্ডেমিক-এ পরিণত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ সালে প্রাচীন এথেন্স শহরে সম্ভাব্য টাইফয়েড (সালমোনেলা টাইফি ব্যাক্টিরিয়া-ঘটিত) এবং/বা এবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ, ১৬৫-১৮০ খ্রিস্টাব্দে স্মলপক্সের কবলে পড়ে সমগ্র রোম সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন, ইয়ারশি্নিয়া পেস্টিস নামক ব্যাক্টিরিয়া সংক্রমিত বিউবনিক প্লেগের কারণে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যে বিপর্যয় (৫৪১-৫৪২ খ্রিস্টাব্দ), এমনকি প্রায় ৮০০ বছর পরেও (১৩৪৬-১৩৫৩), ঐ প্লেগ সংক্রমণেই ইউরোপের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার জীবনাবসান, যা 'ব্ল্যাক ডেথ' নামে পরিচিত। অনুমিত মধ্য বা পূর্ব এশিয়া থেকে সিল্ক পথ ধরে জাহাজে বসে ইঁদুরের গায়ে বেঁচেবর্তে থাকা জীবাণুবাহী মাছি পৌঁছে গিয়েছিলো সুদূর ইউরোপের এক বন্দরে। বাকিটা ইতিহাস।
আরও পড়ুন: সংক্রমণে এগিয়ে বড় শহরগুলিই
এইভাবে ষোড়শ শতকে (১৫১৯-১৫৩২) স্মলপক্স-এর প্রাদুর্ভাবে আমেরিকার অ্যাজটেক ও ইনকা সভ্যতা ধ্বংস, লন্ডন (১৬৬৫-১৬৬৬) ও ফরাসী বন্দর মারসে শহরের (১৭২০-১৭২৩) ব্ল্যাক ডেথ প্লেগ, ফিলাডেলফিয়ায় (১৭৯৩) দাস ব্যবসার পথ ধরে আফ্রিকার মশাবাহিত ভাইরাস ঘটিত পীত জ্বর বা 'ইয়েলো ফিভার', ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মারণ কামড়ে রাশিয়া, ইউরোপ সহ পৃথিবীর প্রায় ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু (১৮৮৯-৯০)। আমেরিকায় পোলিও (১৯১৬) এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন (১৯১৮-১৯২০) ইনফ্লুয়েঞ্জা জনিত ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ আক্রান্ত ৫০ কোটির ৫ কোটি বিশ্ববাসী মারা পড়েছিলেন।
চীন থেকে উদ্ভূত 'এভিয়ান ফ্লু' (১৯৫৭-৫৮), এবং ১৯৮১ থেকে আজ পর্যন্ত আফ্রিকার শিম্পাঞ্জী থেকে মানুষে সংক্রমিত ভাইরাস ঘটিত এইডস মহামারীতে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি মানুষের প্রাণ গেছে। এইডস-এর জেরেই সাধারণ মানুষও জেনে গেছেন সিডি ৪ বা সিডি ৮-বিশিষ্ট টি কোষ এবং এলাইজা ও ওয়েস্টার্ন ব্লট পরীক্ষার কথা। কোনও কার্যকারী প্রতিষেধক এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি। ২০০২ সালে সার্স, ২০০৯ সালে মেক্সিকো থেকে উদ্ভুত শুয়োর বাহিত 'সোয়াইন ফ্লু' (প্রতিষেধক আবিষ্কৃত), পীত জ্বর (২০১৩), ২০১৪-২০১৬ সালে, বাদুড়-বাহিত ইবোলা ভাইরাস এবং ২০১৫ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মশাবাহিত (এডিস) মারন ভাইরাস জিকা’র প্রাদুর্ভাবে আমরা স্তম্ভিত। পৃথিবী অপেক্ষা করছে এদের প্রতিষেধকের জন্য।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ, ভারতে জীবানুঘটিত সংক্রামক রোগের আধিক্য স্বাভাবিক কারণেই বেশি। তথ্যানুসারে, ১৫৪৫ সালে গোয়ায় প্রাচীনতম বসন্ত মহামারীতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৮,০০০ শিশু। এডওয়ার্ড জেনার আবিষ্কৃত প্রতিষেধক প্রয়োগে 'ভারতীয় প্লেগ'-কে চিরতরে বিদায় জানিয়েছিলাম ১৯৭৭ সালে। ভারতে মূলত দুটি প্যান্ডেমিক মহামারী উল্লেখযোগ্য। এক, কলেরা ও দুই, ইনফ্লুয়েঞ্জা। কলেরা মহামারী এ পর্যন্ত তিন শতক ধরে আটবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে, এবং অদ্যাবধি কাটে নি তার প্রকোপ। ভারতে ৫ কোটির বেশী প্রাণ কেড়ে নিয়েছে কলেরা। আর ২০০৯ সালের এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা সহ ১৯১৮ সালের 'স্প্যানিশ ফ্লু' ভারত সহ সমগ্র বিশ্বকে পঙ্গু করে দিয়েছিল।
মহামারী-বিধ্বস্ত ভারতে ১৯ শতকের কলেরা ছাড়াও, বম্বের প্লেগ (১৮৯৬), ২০ শতকের ইনফ্লুয়েঞ্জা প্যান্ডেমিক (১৯১৮) সহ পোলিও (১৯৭০-১৯৯০), বসন্ত (১৯৭৪), সুরাতের প্লেগ (১৯৯৪) এবং ২১ শতকে ঘটে যাওয়া উত্তর ভারতের প্লেগ (২০০২), ডেঙ্গু (২০০৩), সার্স (২০০৩), মেনিঞ্জাইটিস (২০০৫-২০০৬), চিকুনগুনিয়া (২০০৬), ডেঙ্গু (২০০৬), গুজরাটে জন্ডিস (২০০৭-২০১০), এইচ১এন১ জ্বর (২০০৯), ওড়িশায় জন্ডিস (২০১৪), সোয়াইন ফ্লু (২০১৫), নিপা ফ্লু (২০১৮) এবং কোভিড-১৯ (২০১৯-২০) সংক্রমণে ভারতবাসী মৃত্যুর আগুনে ঝাঁপ দিয়েছেন। প্রাণ গেছে লক্ষ লক্ষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার।
বাঁচার উপায় হিসাবে, প্রতিষেধকের আবিষ্কার ও প্রয়োগে, আমরা বহু মহামারীর হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। এই সূত্রে ১৯২০-১৯৩৯ এর মধ্যে ডিপথেরিয়া, পারটুসিস, ও টিটেনাস (ডিপিটি) ভ্যাকসিন, যক্ষ্মা ভ্যাকসিন (১৯৫১), পোলিও (ওপিভি, ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন, ১৯৬৭), হাম বা মিজলস (১৯৮০), হেপাটাইটিস ডিএনএ ভ্যাকসিন (১৯৯৭), নভেল ফ্লু ভাইরাস ভ্যাক্সিন (২০০৯), ওরাল কলেরা ভ্যাকসিন (২০১০) ও মেনিঞ্জাইটিস এ ভ্যাকসিন (২০১০) এবং সর্বোপরি জাপানি এনকেফালাইটিস ভ্যাকসিন (২০১২) আবিষ্কার ও প্রস্তুত করার প্রযুক্তি রয়েছে আমাদের ঝুলিতে। এসব ক্ষেত্রে আমরা বেশ স্বনির্ভর হতে পেরেছি।
আরও পড়ুন: কোভিড অতিমারীর সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চিত্র
কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস বা SARS-CoV-2 যা Covid-19 বা কোভিড-১৯ নামে কুখ্যাত হচ্ছে। এমন জবরদস্ত বিশ্ব-মহামারী (প্যান্ডেমিক) মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল। আমাদের দেখা ধুতরো ফলের মতো কাঁটার আবরণীতে গোলাকার দেহটি হলো এই CoV-2 ভাইরাসের। ৪০০-৫০০ মাইক্রন, সুতরাং তুলনায় বেশ বড় আকারের ভাইরাস। একটি কক্কাস (coccus) ব্যাক্টিরিয়ার অর্ধেক। বা বলা যায়, দেখতে পাওয়া পেন্সিল-বিন্দু্র হাজার ভাগের এক ভাগ। এমন একটি কণাই পৃথিবীকে কাঁদিয়ে বেড়াচ্ছে। এর গায়ে যে কাঁটা আছে, তা হলো স্পাইক প্রোটিন।
CoV-2 কোনোমতে নাসারন্ধ্রে বা শ্বাসনলে অনুপ্রবেশ করলে, সংবেদিত শ্বাসতন্ত্রের কোষে তার অবস্থান নিশ্চিত করে অনুপ্রবিষ্ট হয় ও সংখ্যায় বাড়তে থাকে। পাশাপাশি দেহের অনাক্রম্য কোষ লড়াই শুরু করে দেয়। প্রদাহ বশত হাঁচি, কাশি, জ্বর শুরু হয়। রোগীর আভ্যন্তরীন অনাক্রম্যতা সুস্থির থাকলে, সে বেঁচে যায়। তাই এই সংক্রমণ প্রধানত ষাটোর্ধ বয়স্কদের মধ্যে এবং বিশেষ করে যাদের জীবনশৈলী জনিত রোগ (ডায়াবেটিস, নানাবিধ হৃদরোগ, অ্যালার্জি, সিজোফ্রেনিয়া প্রভৃতি) রয়েছে, তাঁরাই তুলনায় সহজে সংক্রমিত হচ্ছেন এবং মারা পড়ছেন। এ পর্যন্ত উন্নতশীল দেশের বহু দেশপ্রধান, পরিচিত ব্যক্তিত্ব, স্বাস্থ্যকর্মী, এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।
সময় জীবনের সঙ্গে সাপলুডো খেলছে। বিশ্বের সমস্ত দেশে শোকের ছায়া। যেন অরন্ধন চলছে লকডাউনের প্রতীকে। আঠারোতম দিনে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নিষ্পত্তি হয়েছিল, কিন্তু অবস্থা বিপাকে দেশে এর মেয়াদ বেড়ে হয়েছে ৩১ মে পর্যন্ত। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় উহান শহরের লকডাউনের মেয়াদ ছিল ৭৬ দিন, যা পরে শেষ হলেও নতুন রোগীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে মৃত্যুও উপস্থিত। পরিসংখ্যান সংজ্ঞা হারাচ্ছে। অশনি সংকেত সর্বত্র। তবু, আমরা পরাজয় স্বীকার করবো না। গবেষণাগারে তৈরি হচ্ছে প্রতিঘাতী প্রতিষেধক। যাতে মহেঞ্জোদড়োর সংখ্যা আর না বাড়ে, অরন্ধনসম লকডাউনের অনুশাসনে থেকে, প্রাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সময়কে সমীহ করে, ধৈর্যকে ঢাল বানিয়ে, আমরাই আবার জয়গাথা রচনা করব, কোভিড-১৯ মুক্ত আগামী দিনের অপেক্ষায়।
(লেখক ভেলোর ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির বরিষ্ঠ অধ্যাপক এবং আইসিএমআর-এর প্রাক্তন বৈজ্ঞানিক)