/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/12/internet-LEAD.jpg)
অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস
সারা দুনিয়ায় যেখানেই ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়, তার খবর পৌঁছে যায় সফটওয়্যার ফ্রিডম ল সেন্টারের (SFLC) কাছে। আন্তর্জাতিক এই সংস্থা নজর রাখে যে কোনোরকম ইন্টারনেট 'শাট ডাউনের' ওপর, এবং সোমবার তাদের দফতরে উপচে পড়তে থাকে ভারতের নানা জায়গায় এই শাট ডাউনের খবর। গত বেশ কয়েক বছরে ভারতে যা ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা ইন্টারনেটের বাজার যেমন ভারত, তেমনই নাগরিকদের কম বা বেশি সংখ্যায় ইন্টারনেট পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করার ব্যাপারেও শীর্ষস্থানে ভারতই। ইদানীং উত্তেজনার আভাস পেলে প্রথমেই প্রতিষেধক ব্যবস্থা হিসেবে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া রুটিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষে। এতে উত্তেজনা ছড়ানোর সুযোগ যেমন কমে, তেমনই কমে ভুয়ো খবর এবং গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনাও।
কোনও রাজ্য সরকারের নির্দেশে শাট ডাউন হলে তার হিসেব রাখে না কেন্দ্রীয় টেলিযোগাযোগ বিভাগ - সংসদে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ হওয়া সংক্রান্ত যে কোনও প্রশ্ন উঠলে এটাই হয় সরকারি উত্তর। SFLC-র কাছে যে তথ্য, তারও বেশিরভাগ আসে জাতীয় বা আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম থেকে, সুতরাং তারা এই বলে সতর্ক করে দেয় যে "আমাদের তথ্য ততটাই নির্ভরযোগ্য, যতটা আমাদের তথ্যসূত্র"। তা সত্ত্বেও এদের দেওয়া তথ্য নিয়েই কারবার করতে হয়, যেহেতু ইন্টারনেট শাট ডাউন সংক্রান্ত আর কোনও তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না।
অনেকেই হয়তো জানেন না ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার বিপুল আর্থিক ক্ষতির দিকটা। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনস-এর দ্বারা প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, গত পাঁচ বছরে ১৬ হাজার ঘণ্টা ইন্টারনেট শাট ডাউনের আর্থিক মূল্য ৩ বিলিয়ন ডলার, বা ২২ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/12/internet-1.jpg)
SFLC জানিয়েছে, পৃথিবীর আরও যেসব দেশে প্রায়শই ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা ঘটে, সেগুলি হলো পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, মিশর, কঙ্গো, সিরিয়া, সুদান, বুরুন্ডি, ইরাক, এবং ভেনেজুয়েলা।
২০১৯ সালের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা
নাগরিকত্ব আইন: রবিবার বাংলা জুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে যখন তোলপাড় চলছে, তখন উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগণা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণার কিছু এলাকায় বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। এই একই বিষয়ে প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে এর আগে ইন্টারনেট শাট ডাউন হয় উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জেলায়, এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যেও।
অবশ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চলতি বছরের গোড়াতেই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়, যখন পূর্ববর্তী লোকসভায় পাস হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, যার জেরে অশান্ত হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চল। সাম্প্রতিক কালে SLFC-র কাছে অরুণাচল প্রদেশ এবং ত্রিপুরায় প্রথম শাট ডাউনের খবর পৌঁছয় ১০ ডিসেম্বর, লোকসভায় এই বিল পাস হওয়ার একদিন পর।
আসামে পরিষেবা বন্ধ করা হয় ১১ ডিসেম্বর, যেদিন রাজ্যসভাতেও পাস হয়ে যায় বিল, এবং বন্ধ করার নির্দেশ বহাল থাকে ১২ ডিসেম্বরেও।
সেদিনই ৪৮ ঘণ্টার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা স্তব্ধ করে দেওয়া হয় মেঘালয় রাজ্যেও, কারণ এক সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, "এসএমএস এবং হোয়াটসঅ্যাপের মতো মেসেজিং সার্ভিস, এবং ফেসবুক, টুইটার, ও ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া মঞ্চে ছবি, ভিডিও, বা লিখিত মেসেজের মাধ্যমে তথ্য প্রচার করা হতে পারে, যার ফলে সামাজিক অশান্তি এবং আইন শৃঙ্খলার আরও অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে"।
এরপর উত্তর প্রদেশের আলিগড়ে প্রতিবাদের জেরে ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় ১৩ ডিসেম্বর, এবং রবিবার মীরাটে "আইন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে" বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিষেবা। আধিকারিকরা জানিয়েছেন, রবিবার এবং সোমবার সাহারানপুরেও বন্ধ থাকে ইন্টারনেট।
আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্র বিক্ষোভের আগেই প্রশাসন ফের সক্রিয় হয় "সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে গুজব এবং বিভ্রান্তি ছড়ানো...তথা শান্তি এবং আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করা" রুখতে।
অযোধ্যা রায়: গত কদিনের শাট ডাউন যে বিস্তৃত আকার ধারণ করেছে, তার অঙ্কুর লুকিয়ে রয়েছে গতমাসের শাট ডাউনে, যখন সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যা মামলায় রায় দেওয়ার আগে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় বেশ কিছু রাজ্যে, যেহেতু উত্তেজনা এবং হিংসার আশঙ্কা ছিল প্রায় দেশজুড়েই। এর মধ্যেও সবচেয়ে বেশিবার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয় রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশে।
জম্মু ও কাশ্মীর: আজ নিয়ে গত ১৩৫ দিন ধরে ইন্টারনেট যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে জম্মু-কাশ্মীর। এই শাট ডাউনের সূত্রপাত হয় ৫ অগাস্ট, যেদিন আলাদা হয়ে যায় জম্মু, কাশ্মীর, এবং লাদাখ, এবং বাতিল করা হয় ৩৭০ ধারার আওতায় প্রাক্তন এই রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা। ভারতে এত দীর্ঘদিন ধরে একটানা ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ থাকার নজির আর নেই। এর আগে ২০১৬ সালে ৮ জুলাই থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩৩ দিনের জন্য জম্মু-কাশ্মীরে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট; এবং ২০১৭-য় ৮ জুন থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০০ দিনের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ হয় দার্জিলিংয়ে।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/12/internet-ban2.jpg)
ভারতে কোথায় সবচেয়ে বেশি বার বন্ধ হয়েছে ইন্টারনেট?
নিয়ম করে, এবং মাঝেমাঝেই, যেসব রাজ্যে শাট ডাউন হয়েছে, সেগুলি হলো:
জম্মু-কাশ্মীর: বর্তমানে এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২০১২ থেকে শুরু করে ১৮০ বার বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা, বলছে SFLC। বন্ধ করে দেওয়ার কারণ হিসেবে যেসব কারণ সাধারণভাবে দেখানো হয়, তাদের মধ্যে পড়ে "নিরাপত্তা রক্ষী এবং জঙ্গিদের মধ্যে সংঘর্ষ", "ব্যাপক তল্লাশি অভিযান", "গুলির লড়াই", এবং "সিআরপিএফ-এর ওপর হামলা"। গোটা অঞ্চলে ইন্টারনেট ফিরিয়ে আনার দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে আপাতত একটি মামলার শুনানি চলছে।
নিহত হিজবুল মুজাহিদিন কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুবার্ষিকীর সময় বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। এছাড়াও স্বাধীনতা দিবস ২০১৭, প্রজাতন্ত্র দিবস ২০১৬, এবং ঈদ ২০১৫-তেও বন্ধ থাকে ইন্টারনেট। এবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময়ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জম্মু-কাশ্মীর।
রাজস্থান: ২০১৫ থেকে ৬৭ বার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে এরাজ্যে, একেবারে স্থানীয় স্তর থেকে শুরু করে জেলাস্তর বা নির্দিষ্ট কিছু এলাকা পর্যন্ত। এর মধ্যে বেশ কিছু ছিল "সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার বিরুদ্ধে প্রতিষেধক" অথবা "গুজব ছড়ানো রুখতে" ব্যবস্থা গ্রহণ। এবছরের ১৩ অগাস্ট "জয়পুরের ১০টি থানার এলাকায়...মোবাইল ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়...যেহেতু দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ছোটখাটো একটি সংঘর্ষের ফলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, এবং গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনা দেখা দেয়"।
এছাড়াও রাজস্থানে পরীক্ষায় টোকাটুকি রুখতেও বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা - বিশেষ করে ১৮ জুলাই, ২০১৮ থেকে শুরু করে দুদিন, কনস্টেবল নিয়োগের পরীক্ষা চলাকালীন; এবং ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সালে REET পরীক্ষা চলাকালীন বিকানের, সিকর এবং করৌলি জেলায়।
কিছু জেলায় আম্বেদকর জয়ন্তী উপলক্ষ্যে, বা দলিতদের প্রতিবাদ চলাকালীন, বা কিছু হিন্দু সংগঠনের উৎসব চলাকালীনও বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/12/amu.jpg)
উত্তর প্রদেশ: উত্তর প্রদেশে ২০১৫ থেকে শুরু করে মোট ১৯ বার বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট। এবছরের ৫ জুলাই SFLC জানায়, "মুসলিমরা এক ব্যক্তির গণপ্রহারে মৃত্যুর প্রতিবাদ করায় উত্তেজনার সৃষ্টি হয়, যা প্রশমিত করতে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট পরিষেবা। কিছু সূত্র অনুযায়ী, বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে হিংসাত্মক হয়ে ওঠে পরিস্থিতি।"
এছাড়াও শাট ডাউনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে: "একটি শিশুর নৃশংস হত্যা", "AIMIM সাংসদ আসাদুদ্দিন ওয়েইসির আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে আসার খবর নিয়ে একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে পড়ুয়াদের বিবাদ", "ভীম আর্মি নেতার ভাইয়ের হত্যা", এবং "ভারত বনধের সমর্থক ও সংরক্ষণের সমর্থক দলিত এবং ওবিসি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ"।
সংশ্লিষ্ট 'শাট ডাউন আইন'
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাট ডাউন আরোপ করে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতর, দ্য টেম্পোরারি সাসপেন্সন অফ টেলিকম সার্ভিসেস (পাবলিক এমারজেন্সি অর পাবলিক সেফটি) রুলস, ২০১৭-র আওতায়। শাট ডাউনের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করে রাজ্য সরকারের পর্যালোচনা কমিটি। এই আইনে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকেও, যদিও এখনও কেন্দ্র সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করেনি।
আরও কিছু সংশ্লিষ্ট আইন হলো ১৯৭৩ সালের ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৪৪ ধারা এবং ১৮৮৫ সালের ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট।
সাম্প্রতিক অতীতে বেশ কিছু শাট ডাউনের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছে ১৪৪ ধারা, বিশেষ করে ২০১৭ সালের টেলিকম সার্ভিসেস রুলস বলবৎ হওয়ার আগে পর্যন্ত। এই ধারা জেলাশাসক এবং সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট সহ রাজ্য সরকারের ক্ষমতা প্রদত্ত যে কোনও আধিকারিককে "সর্বসাধারণের শান্তি রক্ষার্থে" নির্দেশ জারি করার অনুমতি দেয়।
অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহৃত ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ অ্যাক্ট, ১৮৮৫-র ধারা ৫(২) কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারকে যে কোনোরকম বার্তা বা মেসেজ পাঠানো বন্ধ করার অনুমতি দেয় "পাবলিক এমারজেন্সি" চলাকালীন, অথবা "জনসুরক্ষার স্বার্থে", অথবা "ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতার স্বার্থে, রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য", ইত্যাদি।