জম্মু এবং কাশ্মীরে দুটি বর্তমান ছুটি বাতিল করে ঘোষিত হয়েছে তৃতীয়, নতুন একটি ছুটির দিন। জম্মু ও কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা এই পদক্ষেপকে কেন্দ্রের গা-জোয়ারি হিসেবেই শুধু দেখছেন না, নিজেদের মুসলিম পরিচিতি প্রতিষ্ঠার পথে বাধা হিসেবেও দেখছেন।
তিন ছুটির দিন
সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী বাতিল করা হয়েছে ৫ ডিসেম্বর এবং ১৩ জুলাইয়ের ছুটি। ৫ ডিসেম্বর পালিত হয় জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, তথা ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মহম্মদ আবদুল্লার জন্মবার্ষিকী হিসেবে।
অন্যদিকে ১৩ জুলাই জম্মু-কাশ্মীরে পালিত হয় শহীদ দিবস। আজ থেকে প্রায় নয় দশক আগে, ১৯৩১ সালের এই দিনে, শ্রীনগর সেন্ট্রাল জেলের বাইরে রাজ্যের স্বৈরাচারী ডোগরা রাজাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সমাবেশে নিহত হন ২২ জন কাশ্মীরী।
নতুন ছুটির দিন ঘোষিত হয়েছে ২৬ অক্টোবর, ১৯৪৭ সালে যেই দিনটিতে ভারতীয় আধিপত্য স্বীকার করে নেয় জম্মু-কাশ্মীর। এর একদিন পরে উপজাতীয় হানাদারদের বিতাড়িত করতে শ্রীনগরে হাজির হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। এর ফলে ২৭ অক্টোবর কাশ্মীরে পালিত হয়ে এসেছে 'ব্ল্যাক ডে' বা কালো দিবস, যেদিন কার্যত অচল হয়ে যায় কাশ্মীর।
ইতিহাস এবং গুরুত্ব
১৮৪৬ সালের অমৃতসর চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা ডোগরা শাসক মহারাজা গুলাব সিংয়ের কাছে বিক্রি করে দেয় জম্মু ও কাশ্মীর। মূলত জম্মুর অধিবাসী ডোগরাদের রাজত্ব চলে পরবর্তী প্রায় ১০০ বছর ধরে। ১৯৩১ সালে ডোগরা রাজাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন রাজ্যের মুসলিম প্রজারা। এই আন্দোলনের জেরে মৃত্যু হয় ২২ জন মুসলিমের। জম্মু-কাশ্মীরে মুসলিম পরিচিতি প্রতিষ্ঠার পথে সম্ভবত এটিই প্রথম পদক্ষেপ।
রাজ্যে পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (পিডিপি) সঙ্গে বিজেপি জোট বাঁধার পর থেকে বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা দাবি করে আসছেন, ১৯৩১-এর আন্দোলন চলাকালীন কাশ্মীরের শাসক মহারাজা হরি সিংয়ের জন্মদিনে ছুটি ঘোষিত হোক। অধিকাংশই জম্মুর বাসিন্দা এই বিজেপি নেতারা ১৯৩১-এ নিহত কাশ্মীরীদের স্মৃতিতে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকেন নি।
অন্যদিকে, ৫ ডিসেম্বরের তাৎপর্যের মূল কারণ হলো শেখ আবদুল্লার তরফে জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা। জওহরলাল নেহরুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তথা রাজনৈতিক সহযোগী আবদুল্লাই তৎকালীন মুসলিম কনফারেন্সকে ১৯৩৯ সালে ধর্মনিরপেক্ষ ন্যাশনাল কনফারেন্সে পরিণত করেন। মুসলিম কনফারেন্সের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রচার করে যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সঙ্গেই সুরক্ষিত রাজ্যের ভবিষ্যৎ, পাকিস্তানের সঙ্গে নয়। একদা কাশ্মীরের জনপ্রিয়তম নেতা আবদুল্লার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কালের নিয়মে কমে গেলেও তাঁর দল ভারতের সঙ্গেই কাশ্মীরের ভবিষ্যতের পক্ষে প্রচার করে যায়।
কিসের ইশারা?
সরকারের নবতম পদক্ষেপকে ১৯৩৯ সাল থেকে জম্মু-কাশ্মীরে চলে আসা রাজনীতির থেকে আলাদা বলেই মনে করা হচ্ছে। অনেকেই আরও মনে করছেন, এই পদক্ষেপ নিয়ে শেখ আবদুল্লার ভূমিকা ভুলিয়ে দিতে চাইছে বর্তমান সরকার, মুছে দিতে চাইছে জম্মু-কাশ্মীরের মুসলিম অভিমুখ। এছাড়াও তাঁদের মত, এই পদক্ষেপে বিস্মৃতির দিকে ঠেলে দিতে চাইছে কাশ্মীরের সেইসব জনপ্রিয় মুসলিম নেতাদের, যাঁরা ১৯৪৭-এ ভারতের পক্ষ নিয়েছিলেন, এবং বর্তমান সময়েও যাঁরা ভারতকে সমর্থন করছেন।
এই দুই ছুটি বাতিল হওয়ায় জম্মু-কাশ্মীরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুনঃস্থাপন করা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল হওয়ার পর, এবং জম্মু-কাশ্মীরকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভাজিত করার পর মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির বিরুদ্ধেও কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার, বন্দী হয়েছেন এইসব দলের নেতা-কর্মীরা, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন তিন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কোনোরকম রাজনৈতিক আলোচনাও করে নি সরকার। বিশেষ মর্যাদা বাতিল হওয়ার পাঁচ মাস পরেও স্বাভাবিক হয়নি পরিস্থিতি, যে প্রেক্ষিতেই এলো এই নতুন পদক্ষেপ।