বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) সংসদে একটি গুরুতর নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। কারণ দুই ব্যক্তি দর্শক গ্যালারি থেকে লোকসভার কক্ষে লাফ দিয়ে স্লোগান দিতে দিতে একটি হলুদ ধোঁয়া বের হওয়ার ক্যানিস্টার খুলেছেন। অন্য চার ব্যক্তিকে নিয়ে গঠিত এই চক্রের উদ্দেশ্য এখনও স্পষ্ট হয়নি। তবে পুলিশ সূত্রের একাংশের দাবি, ঘটনাটি দেখে মনে হচ্ছে, 'ভগৎ সিং-এর দ্বারা অনুপ্রাণিত' হয়ে করেছে। মণিপুর থেকে শুরু করে কৃষকদের উদ্বেগ পর্যন্ত, বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিবাদ করা ছিল এই গোষ্ঠীর স্পষ্ট উদ্দেশ্য।
ভগৎ সিংয়ের বোমা নিক্ষেপ
৯৪ বছরেরও বেশি আগে, কিংবদন্তি ভগৎ সিং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি দিল্লির কেন্দ্রীয় পরিষদ বা ভারতীয় সংসদের কক্ষে দুটি প্রতীকী বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। তাঁর হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি (এইচএসআরএ)-র কমরেড বটুকেশ্বর দত্তের সঙ্গে তিনি ওই কক্ষে বিপ্লবী প্রচারপত্র ছুড়ে ফেলেন। দেশাত্মবোধক স্লোগান তোলেন। এভাবেই ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম বীরত্বপূর্ণ এবং সাহসী কাজটি ঘটেছিল।
১৯২৯ সালে 'ভারতীয় সংসদ'
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ড. পি সীতারামাইয়া তাঁর ১৯৪৬ সালের বইয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন, '১৯২৯ সালের প্রথম দিকে ভারতীয় সংসদের পরিস্থিতি পরীক্ষামূলক ছিল।' ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দাবি অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসন দেয়নি। ভারতীয়রা আইনসভায় স্থান পাওয়ার পর সামান্য ক্ষমতার অধিকারী হয়। ভগৎ সিংয়ের মত বিপ্লবীরা সচেতন থাকায় আলোচনাপন্থীরা ব্রিটিশদের সঙ্গে সরল বিশ্বাসে 'আলোচনা' করতে পারেনি।
প্রচারপত্রে যা বলা হয়েছিল
সংসদে ছুড়ে ফেলা ভগৎ সিংয়ের হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মি (এইচএসআরএ)-র প্যামফ্লেটগুলো বলেছে, 'গত দশ বছরের অপমানজনক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না করে এবং তথাকথিত ভারতীয় পার্লামেন্টের এই কক্ষের মাধ্যমে ভারতীয় জাতিকে অপমানিত করার কথা উল্লেখ না-করে, আমরা এটি জানাতে চাই, জনগণ আরও কিছু সংস্কারের আশা করছে। এই পরিস্থিতিতে সরকার আমাদের ওপর জননিরাপত্তা এবং বাণিজ্য বিরোধ বিলের মত নতুন দমনমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিচ্ছে।'
বিপ্লবীরা ' বধিরদের শোনাতে চেয়েছিলেন'
এইচএসআরএ, বিপ্লবী সংগঠন সেই সময়ে চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল। যা, ভারতীয় সংসদের জালিয়াতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত যে প্রচারপত্রগুলো ছুড়েছিলেন, তার কারণ হিসেবে বলেছিলেন- 'বধিরদের শোনাতে একটি উচ্চ কণ্ঠের প্রয়োজন হয়। এই অমর শব্দগুলো এরকমই এক ঘটনায় উচ্চারণ করেছিলেন ফরাসি নৈরাজ্যবাদী শহিদ ভ্যালিয়ান্ট।' আসলে তাঁরা চেয়েছিলেন কাউকে হত্যা বা আঘাত করা নয়, কেবল একটি বিন্দু তৈরি করতে। যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যজুড়ে প্রতিধ্বনিত হবে। প্রচার পুস্তিকা অনুযায়ী, 'অত্যন্ত উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে, হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন তার সেনাকে এই পদক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়েছিল। যাতে অপমানজনক প্রহসন বন্ধ করা হয়। বিদেশি আমলাতান্ত্রিক শোষকদের যা ইচ্ছা তাই, না-করতে দেওয়া হয়।'
দুর্ভাগ্যজনক দিন
যে দিন বিপ্লবীরা ওই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, ১৯২৯ সালের ৪ এপ্রিল, সেই দুর্ভাগ্যজনক দিনে ভাইসরয় লর্ড আরউইন জননিরাপত্তা এবং বাণিজ্য বিরোধ বিলগুলো প্রণয়ন করার ঘোষণা করবেন বলে ঠিক হয়েছিল। যদিও সংসদ বা পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তার বিরোধিতা করেছিল এবং তার জেরে উভয় বিলই আগে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। সংসদের কক্ষে বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড সুপরিকল্পিত ছিল। পুলিশি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত উভয়েই ঘটনার দিন খাকি শার্ট এবং হাফপ্যান্ট পরে দর্শক গ্যালারিতে বসেছিলেন। দুটি বোমা ফাটানোর পর, ভগৎ সিং একটি পিস্তল থেকে দুটি অনাকাঙ্ক্ষিত গুলি ছুড়েছিলেন। আর, বটুকেশ্বর দত্ত এইচএসআরএ প্রচারপত্র কক্ষে ছুড়ে দিয়েছিলেন। দুজনেই, 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ' (বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক) এবং 'বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে' স্লোগান দিয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত-র মধ্যে কেউই পালানোর কোনও চেষ্টা করেননি। আর, গ্রেফতার হন।
আরও পড়ুন- নিরাপত্তায় মোড়া সংসদে হামলা চালানো মুখের ব্যাপার? তারপরও কীভাবে ঘটল
শাস্তি
ঘটনার একমাস পর বিচার শুরু হয়। সেই বছরের ১২ জুন, উভয় বিপ্লবীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ভগৎ সিং পরবর্তীতে ১৯২৮ সালে লাহোরে ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার জন সন্ডার্সকে হত্যার অভিযোগের মুখোমুখি হন। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ, লাহোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ভগৎ সিংকে ফাঁসি দেওয়া হয়।
বুধবারের ঘটনার তদন্তে যা উঠে এসেছে
তদন্তকারীরা সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনকারী দলের মূল অংশ হিসেবে সন্দেহভাজন ষষ্ঠ ব্যক্তিকে গ্রেফতারের জন্য দিল্লি পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। কলকাতার শিক্ষক ললিত ঝা, এই নিরাপত্তা লঙ্ঘনের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন বলেই পুলিশ জানিয়েছে। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, অভিযুক্তরা বিপ্লবী শহিদ ভগত সিংয়ের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তারা এমন একটি কাজ করতে চেয়েছিল, যা তাদের প্রতি দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তদন্তকারীরা এখনও পর্যন্ত কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে এই নিরাপত্তা ভঙ্গকারীদের যোগসূত্র খুঁজে পায়নি। তদন্তকারীদের মতে, অভিযুক্তরা সোশ্যাল মিডিয়ায় একে অপরের সংস্পর্শে আসার পরে ছয় জনই ফেসবুকে ভগত সিং ফ্যান পেজে যোগদান করেছিলেন। ললিত, সাগর শর্মা ও মৌরঞ্জন ডি প্রায় এক বছর আগে মহীশূরে দেখা করেছিল। সেখানেই তারা সংসদে প্রবেশের পরিকল্পনা করেছিল। তারা পরে নীলম এবং অমলকেও পরিকল্পনায় যুক্ত করে। একজন শিক্ষক হওয়ার কারণে, ললিত নেতৃত্ব দিয়েছিল। মনোরঞ্জনকে বর্ষা অধিবেশন চলাকালীন সংসদের সমস্ত প্রবেশপথের রেইকি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।