লকডাউন। তবুও তারা বেলাগাম ভাবে পথে। পুলিশ তাদের থেকে পাশ দেখতে চাইল, 'এই যে ভাই, এ ভাবে রাস্তায় বেরনোর অনুমতি আছে কি?' কোথাও কিছু নেই, তলোয়ারের এক কোপে নেমে গেল পুলিশ আধিকারিকের হাত। রক্তের ফোয়ারা তখন। পথচলতি একজন কাটা হাতটা তুলে দিলেন সেই আধিকারিকের আরেক হাতে। গত বছরের এপ্রিল মাসের ঘটনা। যারা নিমেষে হাত কেটে দেওয়ার পিছনে, তাদের ধরতে পুলিশকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয় তার পর। হুলস্থূল বেঁধে গেল। এরা শিখদের নিহাঙ্গ গোষ্ঠীর লোকজন। ফের তারা স্পটলাইটে এসেছে শুক্রবার। সিঙ্ঘুতে কৃষকদের আন্দোলন এলাকায় ধর্মগ্রন্থ অবমাননার অপবাদে এক যুবককে নৃশংস ভাবে খুনের অভিযোগে। তাদের নিয়ে এর ফলে চর্চা শুরু। কারা এই নিহাঙ্গ? গভীরে নজর দিয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। খুঁজে দেখেছে ইতিহাস।
নিহাঙ্গ কারা?
নিহাঙ্গ হল শিখ যোদ্ধা। নীল পোশাক তাঁদের। মাথায় নীল পাগড়ি। যা অলঙ্কৃত। ইস্পাত-উদ্ধৃত। সশস্ত্র তারা। তলোয়ার, বর্শায়। শিখ ইতিহাসবিদ ড. বলবন্ত সিং ধিলোঁ বলছেন, নিহাঙ্গ শব্দটা এসেছে পারসি থেকে। অর্থ বৃহৎ কুমির, তলোয়ার কিংবা কলম। নিহাঙ্গের যে বৈশিষ্ট, তার সঙ্গে সংস্কৃত নিশঙ্ক শব্দের মিল রয়েছে। নিশঙ্কের অর্থ নির্ভয়, নির্দোষ, নির্ভীক, বিশুদ্ধ। পৃথিবীর সব প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ঊর্ধ্বে। নিহাঙ্গ শব্দটা গুরু গ্রন্থসাহিবের একটি স্তোত্রেও রয়েছে। যে স্তোত্র নির্ভীক ও বাধাহীনতার ইঙ্গিতবাহী। ইতিহাসবিদ রতন সিং ভাঙ্গুও নিহাঙ্গের অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন, নিহাঙ্গ মানে কষ্ট ও সুখের অতীত। ধ্যানমগ্নতা, তপস্যার পথে অগ্রগামী, দানশীল। সম্পূর্ণ এক যোদ্ধা।
কবে নিহাঙ্গের গঠন?
১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিং গঠন করলেন শিখদের সেনাদল খালসা। নিহাঙ্গ গঠনের কাহিনিটাও তার অঙ্গাঙ্গী। ধিলোঁর কথায়, 'গুরু গোবিন্দ সিংয়ের ছোট ছেলে ফতেহ সিং একদিন নীল চোলা, নীল পাগড়ি পরে তাঁর বাবার সামনে এসেছিলেন। রাজকীয় সেই বেশে ছেলেকে দেখে গুরু গোবিন্দ আপ্লুত। নিহাঙ্গের পোশাক এটাই হতে পারে, বললেন গুরু গোবিন্দ।' নিহাঙ্গ, খালসার বেপরোয়া যোদ্ধার পোশাক। গুরু গোবিন্দ এই পোশাক পরতেন। ছবিও রয়েছে তাঁর নীল বস্ত্রে। নীল তো আকাশের রং, নিহাঙ্গরা তাকে যুদ্ধের রং করে তুলল। নীল রং ভীষণ প্রিয়, যে রঙে রক্তের লাল ছিটকে লাগল। নীল রঙে লাল মিশে গেল।
নিহাঙ্গের সঙ্গে অন্যান্য শিখ যোদ্ধাদের ফারাক কী?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্নেল জেমস স্কিনার (১৭৭৪-১৮৪১) লিখেছেন, খালসারা দু'দলে বিভক্ত ছিল। একদল নীল পোশাকধারী। যে পোশাক গুরু গোবিন্দ সিং যুদ্ধের সময় পরতেন। আর এক দল, যারা নির্দিষ্ট কোনও রঙের পোশাকের নিয়ম মানেন না। যদিও দুই দলের দক্ষতা ছিল যুদ্ধকলায়। অতুলনীয় পর্যায়ে। ধিলোঁ বলছেন, খালসা নিয়মের কঠোর পথের অনুসরকারীরাই নিহাঙ্গ। তাঁরা পার্থিব কোনও গুরুর কাছে মাথা নত করে না। নীল নিশান সাহিবে তারা আনত। নিহাঙ্গদের স্লোগান হল, চারদি কালা। যার অর্থ চির-শক্তির লক্ষ্যে। আর একটি স্লোগান, তিয়ার বার তিয়ার। অর্থ, অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য সদা প্রস্তুত। তাঁদের প্রসিদ্ধ পানীয়ও রয়েছে। তার নাম শরদাই অথবা শরবতি দেঘ। অর্থাৎ, পবিত্র পনীয়। যে পানীয় তৈরির উপকরণ হল, এলাচ, পোস্ত, গোলমরিচ, গোলাপের পাপড়ি, তরমুজের বীজ। ভাল মাত্রায় গাঁজাও মেশানো হয় তাদের এক ধরনের পানীয়তে, তার নাম শহিদি দেগ, বা পবিত্র শহিদের পানীয়। শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের সময় যা পান করে থাকে নিহাঙ্গরা।
শিখ ইতিহাসে নিহাঙ্গদের ভূমিকা কী?
শিখ রাজত্বের পত্তন হয় মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের হাতে। পাঞ্জাবকে কেন্দ্রকে তাঁর রাজত্ব ছিল। ১৭৯৯ সালে রঞ্জিত লাহোর দখল করেন, তখন থেকেই তাঁর সাম্রাজ্যের সূত্রপাত ঘটে বলে ধরা হয়। রঞ্জিত সিংয়ের মৃত্যু হয় ১৮৩৯ সালে। তার পরই শাসন-ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়ে। বহু ভাগে বিভক্ত শিখরা, যা ব্রিটিশ শাসকদের হাতের অস্ত্র হয়ে ওঠে। ১৮৪৯ সালে অ্যাংলো-শিখ যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত এই রাজত্বের আক্ষরিক পতন ঘটে। এর মধ্যে ১৭১৬ থেকে ১৭৯৯ সাল পর্যন্ত চূড়ান্ত পরিস্থিতি ছিল পাঞ্জাব অঞ্চলে। মুঘলদের পতন হচ্ছে তখন, শূন্যস্থান পূর্ণ করতে মরিয়া শিখরা, তখন খালসা পার্টি, যারই অংশ ছিল নিহাঙ্গরা, মূলত তারা ছিল গেরিলা যোদ্ধাদের দল, তারা ছিল মুঘলদের বিরুদ্ধে দুরন্ত আগ্রাসী। তার পর আফগানিস্তানের শাসক আহমেদ শাহ দুরানির হামলা-কালে যখন গণনিধন হল শিখদের, তখনও নিহাঙ্গদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত লড়াকু।
এখন নিহাঙ্গদের অবস্থান কী?
এখন নিহাঙ্গরা ছোট একটি গোষ্ঠীতে পরিণত। মোটামুটি ১২টি দল তাদের। প্রতিটির একজন নেতা রয়েছেন। এই দলগুলির মধ্যে নাম করা যেতে পারে বুধা দল, তরুণ দলের। প্রায় কোনও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেই নিহাঙ্গদের, ফলে সংগঠন দুর্বল। অনেক সময় তাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সারা বছর নিহাঙ্গরা নিজেদের ডেরায় থাকেন, তবে নির্দিষ্ট সময়ে তারা আনন্দপুর সাহিব, দমদমা সাহিব তালওয়ান্দি সাবো এবং অমৃতসরে গিয়ে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। যুদ্ধবিদ্যার প্রদর্শন করে। আপাতত, কৃষকদের আন্দোলনের পাশে দাঁড়াতে নিহাঙ্গরা সিঙ্ঘুতে।
কারা নিহাঙ্গ হতে পারেন?
ধর্ম-জাতি নির্বিশেষে যাঁরা মন থেকে শিখপন্থা অবলম্বন করবেন, ঠোঁটস্থ করে রাখবেন পঞ্চ বাণীর সব-কটি। রোজ রাত একটায় উঠবেন এবং দু'-বেলা প্রার্থনা করবেন নিয়ম করে। তাঁরা এই গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ার প্রাথমিক ছাড়পত্র পাবেন। এমনই বলছেন এক নিহাঙ্গ নেতা। শিখ ধর্মে দীক্ষিত যাঁরা নিহাঙ্গ হওয়ার ধাপগুলি উত্তীর্ণ হন, তাঁদের নীল বস্ত্র দেওয়া হয়, অস্ত্র দেওয়া হয়। যা খালসার প্রতিষ্ঠাতা গুরু গোবিন্দ সিং যুদ্ধকালে ধারণ করতেন। রাজ্য-রক্ষা। মুঘলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, নিধনের বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা-- এমন বিদ্রোহ-প্রবণতায় যাদের মাথাচাড়া দেওয়া, তারাই এখন পুলিশের হাত কেটে নিচ্ছে। একটুতেই উত্তেজিত হয়ে কাউকে নৃশংস ভাবে খুন করে দিচ্ছে। নীল বস্ত্রের সম্মান কি ধরে রাখতে পারছেন নব্য-নিহাঙ্গরা?