Advertisment

হিবাতুল্লা আখুন্দজাদা কে, তিনিই কি হবেন আফগান সুপ্রিম লিডার?

জল্পনার জল সমুদ্র-সফেন হয়ে উঠেছে-- কে বসবেন কাবুলের তখতে। মানে, কাবুলের তালিব-রাজা হবেনটা কিনি?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Who is Sheikh Haibatullah Akhundzada, he will be the supreme leader of Afghanistan?

হিবাতুল্লা আখুন্দজাদা

তালিবান প্রায় এক তালিতেই কাবুলের দখল নিয়েছে। কিন্তু পাঞ্জশির পেতে তাদের কালঘাম ঝরাতে হচ্ছে। সেখানে জোর লড়াই। আহমেদ মাসুদ না-হেরে ছাড়বেন না সূচ্যগ্র মেদিনী। তালিবান বলছে, পাঞ্জশির জয় তারা করে ফেলেছে। মাসুদরা সেই দাবি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। এ হেন ধুন্ধুমার চলছে যখন ও দিকে-- তখন, এক জল্পনার জল সমুদ্র-সফেন হয়ে উঠেছে-- কে বসবেন কাবুলের তখতে। মানে, কাবুলের তালিব-রাজা হবেনটা কিনি? তালিবান প্রধান হিবাতুল্লা আখুন্দজাদা ছাড়া আর কে হবেন, বলছেন এই জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব। তবে তালিবানের ডিফ্যাক্টো প্রধান বা নম্বর টু নেতা মোল্লা আবদুল ঘানি বরাদর হচ্ছেন আফগানিস্তান সরকারের প্রধান, বলছে কয়েকটি সূত্র। অনেকেই বলেন, বকলমে তালিবান চালান বরাদরই। সেনা প্রত্যাহার নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে তিনিই তো তালিবানের হয়ে কথাবার্তা চালিয়েছিলেন, এবং সফলও হলেন, তাঁর সাফল্যই তালিবদের নব-আনন্দে জাগিয়ে তুলেছে আজ। তিনি সরকারের প্রধান হওয়ার তাই প্রধান হকদার। অনেকেই বলেন, অনেকেই বলেন, তালিবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের শ্যালক এই বরাদর। উর্দুতে একটা কথা খুব চালু-- ভাইবেরাদর। বরাদর বা বেরাদর মানে, বলার অপেক্ষা রাখে না-- ভাই। জানা যায়, মোল্লা ওমর আবদুল ঘানিকে বেরাদর বলে ডাকতেন। বোনকে বিয়ে করার জন্য ভাই বলে ঘানিকে ডাকতেন না ওমর, তাঁদের দু'জনের ছোট থেকেই ছিল গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। ল্যাঙ্গোটিয়া ইয়ার বলতে যা বোঝায়, তা-ই। এর পর দক্ষিণ আফগানিস্তানে, ১৯৯৪ সালে, ওমর, বরাদর সহ চার জন তালিবান সংগঠনের জন্ম দিলেন।

Advertisment

কেমন আছে আফগানিস্তান

তালিবানের জন্মে পৃথিবী আজ পাগল-পাগল! তার উপর পরিস্থিতি বড্ড বেগতিক আফগান দেশে। প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ চলছে সেখানে। দেশের ৮০ শতাংশ এলাকাই এর কোপে। ২০ জুন সরকারি ভাবে দুর্ভিক্ষের ঘোষণাও করে দিয়েছিল আগের সরকার। দানাপানি নেই, গবাদিপশু হুড়মুড়িয়ে মরছে, মানুষ মরে পচছে। তার উপর যুদ্ধ চলছে তো চলছেই। এত দিন তালিবান নিধনের নামে আমেরিকার যুদ্ধ। ২০ বছরের সেই লড়াই, ২ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ নিহত। আমেরিকা সে দেশ ছেড়ে চলে তো গেল, চারদিকটা একটা ধ্বংসস্তূপ এখন। নতুন আফগানিস্তানের যে জন্ম হয়েছিল ভারতের হাত ধরে, হাঁটি হাঁটি পা-পা থেকে প্রাসাদোপম-- সে সব কোথায় হারিয়ে গিয়েছে কেউ জানে না, যেন গত জন্মের কথা। তালিবান, না তালিবান বললে হবে না, আফগানিস্তানের বড় অংশকেই দুষতে হবে, এঁরা মনে হয় পাউরুটিতে পেরেক ঠুকতেই ভালবাসেন। ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্বভাজাটা ঝোলাতে ভালবাসেন বড্ড। গোটা আফগানিস্তানটা ভুল পথে চলছে, চালানো হচ্ছে, কে দেখাবে এঁদের আলো, কে বুদ্ধির গোড়ায় একটু অন্তত ধোঁয়া দিয়ে বলবে, এই যে জিহাদ বা জেহাদ জেহাদ করছ, আসলে এ সব সাজানো, কারওর হাতের খেলনা হয়ে লড়াই করছ। পৃথিবীতে বড় বড় শক্তি-- তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি চালু তারা, এক সময়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমেরিকার মদত, পাকিস্তানের মদত, আবার ভারতের পক্ষে থাকা আফগানিস্তানকে ভেঙে এশিয়ায় কোণা-সেরে হয়ে থাকা পাকিস্তানের ফাইটব্যাক করার জন্য নতুন মদত, পিছনে চিনও-- একশো শতাংশ, না হলে দুয়ে-দুয়ে চার হবে কি করে? পাকিস্তানের বেরাদর তো ড্রাগনই, সেই কবে থেকে। 'ড্রাগন-ভাই আমার শি জিংপিং'। কিন্তু আমেরিকা কী করল? যাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল, তাদের হাতে দেশটাকে তুলে গুটিগুটি চৌপাটি। বাহ, ভালই তো--বেশ! দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায় হে… যারা এত দিন মরাকান্না কাঁদছিল, তারা, মানে তালিবান ও তাদের ভাইবেরাদর আজ উদ্বাহু।

আরও বরাদর-কথা

ওমরের জমানা থেকে ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মোল্লা ঘানি বরাদরের প্রতিপত্তি বর্ধিষ্ণু, এখন তিনি এই জঙ্গিদলের রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে তালিবানের পতনের পর, ঘানিভাইকে পালাতে হয়। হাজির হন পাকিস্তানে। সেখানে তালিবানের ছদ্মসংগঠন কোয়েতা শুরা গঠন করেন, ধীরে ধীরে তাঁর ক্ষমতা আকাশ স্পর্শ করে যায়। তখন তিনি সেনা প্রত্যাহার নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা-বিলোচনা শুরু করেন। কিন্তু সেটা করছিলেন পাকিস্তানকে লুকিয়ে, এতেই পাক-রোষে পড়েন। গ্রেফতার হলেন ২০১০ সালে। তার পর ২০১৮-তে জেল থেকে ছাড়া হল তাঁকে। আমেরিকার সঙ্গে সেনা-প্রত্যাহার সংক্রান্ত আলোচনা চলাতেই পাকিস্তান গনিকে ছাড়ল পাকিস্তান। দুইয়ের স্বার্থ যে এক বিন্দুতে। তালিবান সূত্রে জানা যাচ্ছে, বরাদর সরকারের যেমন প্রধান হতে পারেন, তেমনই মোল্লা ওমরের বড় ছেলে মোল্লা মহম্মদ ইয়াকুবও বড় কোনও পদ পেতে পারেন। তা ছাড়া, শের মহম্মদ আব্বাস স্তানিকজাই বা শেরু, দোহার তালিবানের রাজনৈতিক দফতরের উপ-প্রধান, তিনিও বড় কোনও পদে পা রাখতে পারেন। সবার উপরে থাকবেন ছাতা হয়ে আখুন্দজাদা, ইঙ্গিত দিয়েছেন, একের পর এক আন্তর্জাতিক ইন্টারভিউয়ে, তালিবানের মাথামুন্ডুরা।

কে আখুন্দজাদা?

মোল্লা ওমরের পর তালিবানের তখতে বসেন আখতার মনসুর। আফগানিস্তানকে ফের তালিবানের 'পুণ্যভূমি'তে পর্যবসিত করার মনসুবা পূর্ণ হওয়ার আগেই মনসুর মার্কিন ড্রোনে খতম হলেন। ১৯১৬ সালের ঘটনা সেটা। তার পর ক্ষমতাদণ্ড গেল আখুন্দজাদার হাতে। কান্দাহার লাগোয়া পঞ্জওয়াই জেলায় জাদা-র জন্ম। মাদ্রাসায় পড়াশুনো। সোভিয়েতের দল আফগানিস্তানে এলে তাঁদের পরিবার চলে আসে বালুচিস্তানে। সোভিয়েত-বিরোধী লড়াইয়ের ডাকে সাড়া দেয় আখুন্দজাদারও অন্তর। ইসলামিক প্রতিরোধে গা ভাসিয়ে দেন। ভুল পথটাই মনে করেন নির্ভুল। আরও অনেকের মাথাও খেতে থাকেন। কারণ ধর্মশাস্ত্রে তাঁর নাকি সবিশেষ দখল। ধর্মকে আঁকিয়ে-বাঁকিয়ে ভিনপথে নিয়ে গিয়ে নানা ভুল ব্যাখ্যা করে আখুন্দজাদারা রক্তপাতের কারণ বার করে আনলেন। এক অবিস্মরণীয় রক্তপাতের প্রকল্প যেন। ধর্মীয় ব্যুৎপত্তির ফলে আখুন্দজাদার দিকে নজর যায় তালিবান সুপ্রিমো মোল্লা ওমরের। তাঁকে নিজের ধর্মীয় উপদেষ্টা করেন তালিবান শিরোমণি। এর পর সেভিয়েতরা আফগানিস্তান ছাড়ল। ক্রমে তালিবান ক্ষমতায় বসল। ধর্ম-তাত্ত্বিক হিসেবেই বেশি গ্রাহ্য হতে থাকলেন জাদা, মিলিটারি কম্যান্ডার হিসেবে মাইলেজ প্রায় শূন্য। আফগানিস্তানের ফারাহ রাজ্য তালিবানের দখলে যাওয়ার পর, সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা সামলানোর ভার পড়ে এই ব্যক্তির উপর। তার পর কান্ড এলাকার তালিবানের সেনা আদালতে তাঁকে নিযুক্ত করা হয়।

তালিবানের ক্ষমতা-সিঁড়ির অনেক নীচেই ছিলেন আখুন্দ-- ২০০১-এ আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সেনা তালিবানকে ক্ষমতা থেকে ছুঁড়ে ফেলল যখন, এই ব্যক্তিটিকে তালিবানি ধর্ম-বিশেষজ্ঞদের কমিটির প্রধান করা হল। বোঝাই যাচ্ছে, উত্থান হলেও, বেশি উপরে উঠতে পারলেন না আখুন্দজাদা, অন্তত তখনও পর্যন্ত। মাঝে মাঝে নানা ধর্মসংক্রান্ত বিবৃতি দিতেন, আর বিভিন্ন পরবে সাধারণকে জ্ঞানের বাণী শোনাতেন-- এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর কাজকর্ম। এর পর, মনসুরের মৃত্যুর পর-- ২৫ মে, ২০১৬-- আখুন্দজাদাকে তালিবানের সুপ্রিম লিডার হিসেবে ঘোষণা করা হল। এতে অনেকে বিস্মিত হয়ে যান। মনসুরের দুই ডেপুটি-- প্রবল ক্ষমতাশালী সিরাজুদ্দিন হাক্কানি এবং মোল্লা ওমরের ছেলে ইয়াকুব-- এঁদের একজন কেন এক নম্বর হলেন না, সেই জল্পনা শুরু হয় জোরদার। আখুন্দজাদা ছিলেন তৃতীয় স্তরে, কী করেই বা এই উত্থান সম্ভব, কথা শুরু হয় অলিগলিতে! তালিবান সূত্রে এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। জানানো হয়, স্বয়ং মনসুরই হিবাতুল্লাকে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে উইলে লিখে রেখে গিয়েছেন, এ ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না। হাক্কানি এবং ইয়াকুবরা তাঁদের অধস্তনকে বস হিসেবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন এর ফলে। আখুন্দজাদার ডেপুটি হিসেবে নিযুক্ত হন এই দু'জন।

এখন নতুন অধ্যায় লেখা হচ্ছে কাবুল-মুলুকে। তালিবান বলছে, আফগানিস্তানকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলবে তারা। বিশ্বাস রাখতে বলছে, বলছে-- ভয় কী, আছি তো! যদি অতি-কষ্ট কল্পনায় এটা মেনেও নেওয়া যায়, তা হলেও কিন্তু বিশাল চ্যালেঞ্জ সামনে। আফগানিস্তান এখন ব্ল্যাকহোল, কৃষ্ণগহ্বরে আলো জ্বালানো কি যায়?

Afganistan Taliban Taliban Government
Advertisment