গত ১৯ জুন, শুক্রবার লস এঞ্জেলেস পুলিশ প্রাক্তন পাকিস্তানি সামরিক চিকিৎসক তাহাউর হুসেন রানাকে ভারত সরকারের অনুরোধের ভিত্তিতে গ্রেফতার করেছে। এর ঠিক আগেই সে স্বাস্থ্যের কারণে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিল।
২৬-১১-র মুম্বই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে রানার প্রত্যর্পণ চেয়েছে ভারত। দেশে এনে তার বিচার হওয়ার কথা।
ভারতের নতুন প্রত্যর্পণ অনুরোধ
২০১১ সালে জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) রানা সহ ৯ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছিল। চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল রানার একসময়ের স্কুলের সহপাঠী ও বন্ধু ডেভিড কোলম্যান হেডলি, হাফিজ সঈদ, লশকর এ তৈবার জাকিউর রহমান লকভি, আল কায়দার ইলিয়াস কাশ্মীরী ও বেশ কয়েকজন পাক সেনা আধিকারিকের বিরুদ্ধে। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল হামলার পরিকল্পনা ও তার রূপায়ণের। এই হামলায় বেশ কয়েকজন আমেরিকান নাগরিক সহ মোট ১৬৬ জনের মৃত্যু হয়।
২০১৪ সালে দিল্লির দায়রা আদালত এই ৯ জনের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। এনআইএ এদের পলাতক তালিকাভুক্ত করেছিল। তবে শিকাগোর বাসিন্দা রানাকে ওই শহরের এক আদালত ২০১১ সালে শাস্তি দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ড্যানিশ এক সংবাদপত্রে মহম্মদের কার্টুন আঁকার প্রতিবাদে হামলা করার জন্য সে লশকর এ তৈবা ও হেডলিকে সাহায্য করেছিল।
তবে সে হামলা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। ২০১৩ সালে অপরাধী সাব্যস্ত হওয়ার পর হেডলি ৩৫ বছরের শাস্তি কমানোর জন্য দরাদরির রাস্তায় হেঁটেছিল, রানা তা করেনি।
গত সপ্তাহে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার টার্মিনাল আইল্যান্ড দ্বীপ থেকে রানাকে স্বাস্থ্যের কারণে সময়ের আগে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার কোভিড-১৯ ধরা পড়েছিল। রানা মুক্তি পেয়ে যাবে এই আশঙ্কায় ভারত অন্তর্বর্তী গ্রেফতারি অনুরোধ ও প্রত্যর্পণ অনুরোধ পাঠায়। মার্কিন কর্তৃপক্ষ এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাকে ফের গ্রেফতার করে।
রানা ও ষড়যন্ত্র
৫৯ বছর বয়স এখন রানার। সে পড়াশোনা করেছিল পাকিস্তানে হাসান আব্দাল ক্যাডেট স্কুলে, যেখানে পাঁচ বছর শিক্ষালাভ করেছিল হেডলিও। পাক সেনাবাহিনীতে কিছুকাল চিকিৎসকের কাজ করার পর রানা কানাডা চলে যায় এবং সেখানকার নাগরিকত্ব পায়।
একই সঙ্গে শিকাগোয় ফার্স্ট ওয়ার্লড ইমিগ্রেশন সার্ভিস নামের একটি কনসালটেন্সি সংস্থাও খোলে সে। এই ব্যবসারই মুম্বই শাখা হেডলিকে আশ্রয় দিয়েছিল, যেখানে সে লশকর এ তৈবার সম্ভাব্য টার্গেট চিহ্নিত করতে পারে ও তাদের উপর নজরদারি চালাতে পারে।
২০০৯ সালে শিকাগোর ও হারে বিমানবন্দরে হেডলির গ্রেফতারের পরপরই গ্রেফতার হয় রানা। সরকারি সাক্ষী হিসেবে হেডলির সাক্ষ্যের জন্য রানার ১৪ বছরের জেল হয়। হেডলি বলে ২০০৬ সালে সে শিকাগো গিয়েছিল রানার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এবং তার উপর লশকর যে কাজের ভার দিয়েছে সে সম্পর্কে রানাকে জানিয়েছিল। মুম্বইতে ফার্স ওয়ার্লড ইমিগ্রেশন সার্ভিসের কেন্দ্র খোলার ব্যাপারে হেডলির পরিকল্পনা অনুমোদন করে রানা এবং তার পাঁচ বছরের বিজনেস ভিসার ব্যাপারে সহায়তা করে।
তবে ২০১৬ সালে বম্বে সিটি সিভিল অ্যান্ড সেশনস কোর্টে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে দেওয়া বয়ানে হেডলি দাবি করে ২০০৮ সালের নভেম্বর হামলার কয়েক মাস আগে সে তার কার্যকলাপ সম্পর্কে রানাকে জানায়।
রানার মূল মাথাব্যথা হেডলি দাবি করেছিল মধ্য মুম্বইয়ের তারদেওয়ে সংস্থার দফতর থেকে কোনও নাশকতামূলক কাজকর্ম পরিচালিত হয়নি। হেডলি একই সঙ্গে দাবি করে ওই অফিস থেকে একটি ভিসা আবেদনও প্রসেস করা হয়নি।
রানা হেডলিকে আর্থিক সাহায্যও করেছিল। ২০০৬ সালের অক্টোবরে তাকে ৬৭,৬০৫ টাকা, ২০০৬ সালের নভেম্বরে ৫০০ ডলার, কয়েকদিন পরে ১৭,৬৩৬ টাকা ও ২০০৬-এর ডিসেম্বরে ১০০০ ডলার দিয়েছিল রানা।
২০০৯ সালে গ্রেফতারির ঠিক আগে দুজনেই একমত হয়েছিল ২৬-১১-য় যেসব পাক জঙ্গি নিহত হয়, সেই ৯ জনকে পাকিস্তানের সামরিক শৌর্যের সেরা সম্মান নিশান ও হায়দার দেওয়া উচিত। বিচারের সময়ে হেডলি এও বলেছিল যে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে ফার্স্ট ওয়ার্লড ইমিগ্রেশন সার্ভিসের প্রতিনিধি হিসেবে ছদ্মবেশে থাকার পরিকল্পনাও অনুমোদন করেছিল রানা। তবে সংবাদপত্রে হামলা, আল কায়দা যার নাম দিয়েছিল মিকি মাউস প্রজেক্ট, তা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি।
রানার বিচারের সময়ে, রানার আইনজীবীরা হেডলিকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযোগ আনেন। এ দুজন পুরনো বন্ধু বটে, কিন্তু পাক-আমেরিকান হেডলির নিজের কারাবাস কমানোর জন্য বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস রয়েছে। ২০১৬ সালে বয়ান দেওয়ার সময়ে হেডলি বলে তার শেষ ইচ্ছাপত্র সে ২০০৬ সালে মুম্বই রওনা দেওয়ার আগে রানাকে পাঠিয়েছিল। কেন, সে প্রশ্নের উত্তের হেডলি বলে, “আমার মনে হয়েছিল আমি যদি মারা যাই বা গ্রেফতার হই, তাহলে এ কাজ করে রাখা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আমি চেয়েছিলাম আমার পরিবারের কয়েকজনের ব্যাপারে ও যেন দায়িত্ব নেয়।”