Advertisment

বালাকোট কেন মাইলফলক হয়ে থাকবে

প্রত্যাঘাতের এই নতুন নক্সা এটুকু নিশ্চিত করে দিল, যে এরপর যে কোনো সন্ত্রাসবাদী হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে শোরগোল পড়ে যাবে দেশে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
balakot air strike

প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক

দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর সম্পর্কের মধ্যে বালাকোটে মঙ্গলবার ভোররাতের ভারতীয় বিমান হানা মাইলফলক হয়ে থাকবে। কেন? প্রথমত, কোনো জঙ্গি হানার পর ভারতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতীয় বায়ুসেনার এই অভিযান একটি দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ। অদ্যাবধি ছবিটা অন্যরকম ছিল। যেমন ২০০৮ সালে ২৬/১১ মুম্বই হামলার পর পাকিস্তানের ওপর কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করার পথ বেছে নেয় ভারত। আবার ২০০১ সালের সংসদ ভবনে আক্রমণের পর বড় মাত্রায় সশস্ত্র বাহিনী জড়ো করা হয়। অন্যদিকে ২০১৬-র উরি হামলার পর সীমিত স্থল-ভিত্তিক অভিযান চালানো হয়। কিন্তু কখনোই বায়ুসেনার ব্যবহার হয় নি, তাও আবার পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে।

Advertisment

দুই দেশের মধ্যে আকাশপথে সমরশক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কার্যত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, বিশেষ করে দুটি দেশই ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক শক্তি ঘোষিত হওয়ার পর, সঙ্কটের তীব্রতা বৃদ্ধির আশঙ্কায়। পাকিস্তান এর আগে প্রত্যাঘাতের হুমকি দিলেও, আকাশপথে যুদ্ধের ময়দানে গুরুতর এই লক্ষণরেখা কিন্তু ভারতই অতিক্রম করল।

আকাশপথে নিষেধাজ্ঞার হাতেগরম উদাহরণ স্বরূপ রয়েছে ১৯৯৯-এর কার্গিল যুদ্ধ, যখন বাজপেয়ী সরকার যুদ্ধে ভারতীয় বায়ুুসেনার ব্যবহার অনুমোদন করলেও তাকে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরোনোর অনুমতি দেয় নি। একদিকে যেমন এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা তথা নিয়ন্ত্রণরেখাকে সম্মান প্রদর্শন করা, তেমনি অন্যদিকে ছিল সংঘর্ষের তীব্রতা বাড়ানোর প্রতি অনীহা। কিন্তু এই হামলাকে মাইলফলক বলার আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে। ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর থেকে ভারতের সামরিক অনুপ্রবেশ সীমিত থেকেছে নিয়ন্ত্রণরেখা এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীর পর্যন্ত, পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ড অক্ষত রেখে।

ভবিষ্যত পদক্ষেপের ক্ষেত্রে মঙ্গলবারের বিমান হানা দৃষ্টান্তমূলক ভাবে দেখিয়ে দিল, যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে সেখানে অবস্থিত সন্ত্রাসবাদী শিবিরের বিরুদ্ধে আকাশপথে হানা দেওয়া যায়। আজ বালাকোট তো কাল বাহাওয়ালপুর বা পরশু মুরিদকে হতে পারে। প্রত্যাঘাতের এই নতুন নক্সা এটুকু নিশ্চিত করে দিল, যে এরপর যে কোনো সন্ত্রাসবাদী হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে শোরগোল পড়ে যাবে দেশে, যে কারণেও এটিকে মাইলফলক বলতে হয়।

publive-image প্রথম বিমান হানার কেন্দ্রবিন্দু

বিদেশ সচিব এই হামলাকে "তথ্য চালিত অভিযান" এবং "অসামরিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ" বলে অভিহিত করেছেন। এর মানে কী?

মানে আর কিছুই নয়, বিদেশ সচিব অত্যন্ত যত্ন সহকারে এটা বোঝালেন যে লক্ষ্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিবিরে সন্ত্রাসবাদীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে শুধুমাত্র কঠিন তথ্যের ভিত্তিতে। এই তথ্য এসেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে (স্যাটেলাইট দ্বারা), বা যোগাযোগ বার্তা আটক করে, বা স্রেফ মাটির কাছাকাছি 'হিউম্যান সোর্স' ব্যবহার করে। এই অভিযানকে তথ্য ভিত্তিক আখ্যা দিয়ে সরকারিভাবে বিশ্বের দরবারে এই বার্তা দেওয়া হলো যে বিমান হানার জন্য যেমন তেমন জায়গা বেছে নেওয়া হয় নি, পরিকল্পিতভাবেই লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।

"অসামরিক সতর্কতামূলক পদক্ষেপ" - এই শব্দচয়ন দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে আকাশপথে হানা দেওয়া যুদ্ধের ইঙ্গিতই বহন করে, এই পদক্ষেপকে অসামরিক আখ্যা দিয়ে দুনিয়াকে আশ্বাস দিল যে যুদ্ধে আগ্রহী নয় তারা। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বা সাধারণ নাগরিকদের নিশানা না করে যে জঙ্গি শিবিরে আক্রমণ চালিয়েছে, তাতে আরো জোরালো হলো এই আশ্বাস, এবং পাকিস্তানের তরফে প্রত্যাঘাতের তীব্রতাও নিয়ন্ত্রণে রাখা গেল। "সতর্কতামূলক পদক্ষেপ"-এর অর্থ, এই বিমান হানা কোনো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার বাসনা নিয়ে নয়, বরং আত্মরক্ষার্থে এবং ভবিষ্যতের সন্ত্রাস রোখার জন্য। প্রতিটি শব্দের উদ্দেশ্য স্পষ্টতই সংঘাতের মাত্রা কমানো, এবং পাকিস্তানকেও সংঘাতের পথ এড়ানোর সুযোগ দেওয়া।

পাকিস্তান এই অভিযানকে "গুরুতর আগ্রাসন" বলে বর্ণনা করে "যথোচিত জবাবের" হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তা কী আকার ধারণ করতে পারে?

পাকিস্তান "যথোচিত জবাব" দিতে যে পদক্ষেপই নিক, তা সংঘাতের মাত্রা বাড়াতে বাধ্য, যা ভারতের তরফ থেকে ফের প্রত্যাঘাত আকর্ষণ করবে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক চাল সাজানোর চেষ্টা করবে, কিন্তু জঙ্গি সংগঠনের মদতদাতা হিসেবে তাদের এই প্রয়াসে সম্ভবত চিঁড়ে ভিজবে না। নিয়ন্ত্রণরেখার এপারে যে কোনো পদক্ষেপ যুদ্ধের সামিল গণ্য হবে, এবং কোনো অসামরিক লক্ষ্যে আঘাত হানলে পাকিস্তানের পক্ষে পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে উঠতে পারে।

এগিয়ে এসে খেলার সুবিধে নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে উচ্চ সতর্কতার বার্তা দিয়ে রেখেছে ভারত। যার অর্থ হলো, যুদ্ধের প্রথাগত নিয়ম মেনে কোনো অতর্কিত হামলা চালাতে পারবে না পাকিস্তান। তবে সীমান্ত জুড়ে বোমাবর্ষণ বাড়াতে পারে তারা।

publive-image পাকিস্তানে জরুরি বৈঠক ইসলামাবাদে

ঝাঁপ যখন দিয়েই ফেলেছে, ভারতের সামনে মুখ্য চ্যালেঞ্জ কী কী?

প্রধান চ্যালেঞ্জ, বাড়তে পারে সংঘাত। তার মানে সশস্ত্র বাহিনীকে পুরোদস্তুর সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে ভারত, এবং বাগাড়ম্বর বর্জন করে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে বিজেপি।

কূটনীতির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চিনের মোকাবিলা করতে হবে ভারতকে, কারণ এরা নিজেদের স্বার্থেই ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সমাধান চাইবে, এবং দুই দেশকেই সংযত থাকার পরামর্শ দেবে। আপাতত সেই সংযমের দায় ইসলামাবাদের বেশি, কিন্তু পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নামলে, এই দায় নয়া দিল্লির ওপরেও বর্তাবে।

উরি হামলার পর 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' পুলওয়ামা কাণ্ড আটকাতে পারে নি। আবার হামলা হলে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

সন্ত্রাসী হামলার পর সামরিক পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হয় শাস্তিমূলক, নাহয় সতর্কতামূলক। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে ভারত দেখাতে চাইতে পারে যে তারা রাজনৈতিক ও সামরিক ভাবে পাকিস্তানকে বাধ্য করতে চায় জঙ্গি সংগঠনদের সাহচর্য ত্যাগ করতে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থার উদ্দেশ্য পাকিস্তানকে ভয় দেখিয়ে ভবিষ্যতে ভারতে আর কোনোরকম নাশকতা সমর্থন না করা।

বালাকোটের বিমান হানা এই বার্তাই বহন করছে যে ভারত গায়ের জোরে হোক, বা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হোক, পাকিস্তানের কাছ থেকে বশ্যতা আদায় করতে বদ্ধপরিকর।

pakistan indian air force CRPF Pulwama Attack
Advertisment