অন্যান্য কারণগুলি ছাড়াও, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বড় আকারে বিজয় সম্ভব হয়েছে অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায় (ওবিসি)-এর ভোটারদের সমর্থনের জন্য। এমন নয় যে বিজেপি অন্যান্য বর্ণ সম্প্রদায়ের থেকে কোনও সমর্থন পায়নি। বরং, গেরুয়া শিবির তার ঐতিহ্যবাহী সমর্থক, উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্তদের ভোটব্যাংক ধরে রাখতে পেরেছিল। তার ওপর বিপুলসংখ্যক দলিত এবং আদবাসীদের একত্রিত করতেও সমর্থ হয়েছিল। এখনও বিজেপি-নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার একটি জাতভিত্তিক আদমশুমারি সম্পর্কে সেই কারণে অনিচ্ছুক বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও এটি এখন সমস্ত বিরোধী দলের সর্বসম্মত দাবি হিসেবে উঠে এসেছে। (টেবিল ২)
বিজেপির প্রতি ওবিসি সমর্থন
ভিপি সিং সরকার ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টের বাস্তবায়ন, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওবিসিদের জন্য ২৭% সংরক্ষণের অনুমোদন দেওয়ায় ভারতে নির্বাচনী রাজনীতির প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়। যা, আরও বেশি করে ঘটে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে। মণ্ডল-পরবর্তী রাজনীতির ফলে প্রচুর শক্তিশালী আঞ্চলিক দলের উত্থান ঘটে, বিশেষ করে বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের মত রাজ্যে।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে 'কমণ্ডলু রাজনীতি' নামে পরিচিত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে মণ্ডল রাজনীতির মোকাবিলা করতে বিজেপিকে খুব কঠিন লড়াই করতে হয়েছে। এজন্য বিজেপির উত্থানে বহু বছর লেগেছে। বিজেপি এলকে আদবানি এবং অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কঠোর পরিশ্রম করেছিল এবং ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল।
অবশ্য একা নয়। বিজেপি অংশীদারদের সাথে জোট এনডিএ গঠন করেছিল। সেই সময় আঞ্চলিক দলগুলো খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ১৯৯৮ এবং ১৯৯৯ সালে যথাক্রমে ৩৫.৫% এবং ৩৩.৯% ভোট পেয়েছিল৷ এমনকী, যখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ ২০০৪ এবং ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেছিল, আঞ্চলিক দলগুলো একসঙ্গে ৩৯.৩% ভোট পেয়েছিল। আর, বিজেপি পেয়েছিল ৩৭.৩% ভোট। এমনকী, যখন বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৩১% ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল, আঞ্চলিক দলগুলোর সম্মিলিত ভোট ছিল ৩৯%। (১নং টেবিল)
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময় বিজেপি ওবিসি ভোটারদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছিল। যা, আঞ্চলিক দলগুলির ভোটব্যাংকে একটি ধাক্কা দিয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলোর ভোটের হার ২৬.৪% শতাংশে নেমে এসেছে। লোকনীতি-সিএসডির সমীক্ষার একটি সিরিজ থেকে প্রমাণ মিলেছে যে বিজেপি গত এক দশকে ওবিসি ভোটারদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে, ২২% ওবিসি বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল এবং ৪২% আঞ্চলিক দলগুলিকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু, এতেই একদশকে ওবিসিদের মধ্যে বিজেপির সমর্থনের ভিত্তি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময়, ৪৪% ওবিসি বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল যেখানে আঞ্চলিক দলগুলিকে মাত্র ২৭% ভোট দিয়েছিল। (সারণি ৩)
লোকসভা বনাম বিধানসভা
কিন্তু, একটা মজার বিষয় আছে। বিজেপি প্রধানত লোকসভা নির্বাচনের সময় ওবিসি ভোটারদের পছন্দ। কিন্তু রাজ্য সরকার নির্বাচন করার সময় সেই ওবিসি ভোটাররাই অন্য দলকে ভোট দেয়। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের সময়, বিহারের মাত্র ১১% ওবিসি আরজেডিকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু, ২০২০ বিধানসভা নির্বাচনের সময়, ২৯% ওবিসি বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। ইউপিতে, ২০১৯ সালে, মাত্র ১৪% ওবিসি সমাজবাদী পার্টিকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু, ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় ২৯% ওবিসি সমাজবাদী পার্টিকে ভোট দিয়েছিল। যদিও, সমাজবাদী পার্টি সেই নির্বাচনে ব্যাপকভাবে হেরেছিল। আমরা লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে অন্যান্য রাজ্যেও ওবিসিদের মধ্যে ভোটের পছন্দের ক্ষেত্রে একই রকম পার্থক্য দেখতে পেয়েছি। (সারণি ৪)
এছাড়াও, বিজেপি উত্তর ভারতের অনেক রাজ্যে প্রভাবশালী ওবিসিদের তুলনায় নিম্ন ওবিসি ভোট অনেক বেশি সফলভাবে সংগ্রহ করেছে। সুতরাং, যদিও বিজেপি ওবিসিদের মধ্যে প্রবেশ করে রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করেছে। যদিও বিজেপির মধ্যে ওবিসি সমর্থনের ভিত্তি ততটা দৃঢ় বলে মনে হচ্ছে না, যতটা উচ্চবর্ণ এবং উচ্চবিত্তদের সমর্থন বিজেপির প্রতি রয়েছে। এই উচ্চবর্ণ এবং উত্তবিত্তরা বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিয়েছেন। এগিয়ে থাকা ওবিসিদের মধ্যে ৪১% বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন। আর, পিছিয়ে থাকা ওবিসিদের মধ্যে ৪৭% ভোট দিয়েছে বিজেপিকে।
আঞ্চলিক দলগুলি নিম্ন ওবিসিদের তুলনায় এগিয়ে থাকা ওবিসিদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের যাদবরা, সেই দৃষ্টিতে প্রভাবশালী ওবিসি জাতি। সমাজবাদী পার্টি এবং আরজেডিকে উচ্চস্তরের ওবিসিরা বেশিসংখ্যায় ভোট দিয়েছেন। আর, বিজেপি এই সব রাজ্যগুলোতে পিছিয়ে থাকা ওবিসিদের সফলভাবে সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। (সারণি ৫ এবং ৬)
আরও পড়ুন- ভারতে জাতশুমারি: এর ইতিহাস ঠিক কতটা জটিল? দেখে নেওয়া যাক
আরও পড়ুন- ইলেকট্রন নিয়ে কাজের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতলেন তিন বিজ্ঞানী
বিজেপির অনীহা
বিজেপি যে কারণে একটি সর্বভারতীয় জাতিশুমারি করতে অনিচ্ছুক, তা হল- বিভিন্ন জাতি, বিশেষ করে ওবিসির সংখ্যা পরিষ্কার হয়ে গেলে, তা শাসক দলের ওপর চাপ বাড়াতে পারে। পাশাপাশি, আঞ্চলিক দলগুলোকে একটি নতুন ইস্যু দিতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওবিসি কোটা নতুন করে স্থির করার প্রয়োজন হতে পারে। আঞ্চলিক দলগুলোকে নতুন জীবন দিতে পারে। যার সাহায্যে আঞ্চলিক দলগুলো আগামী এক দশক ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে আধিপত্যকারী বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত হাতিয়ার পেয়ে যেতে পারে।
সব মিলিয়ে গেরুয়া শিবিরের একটি ভয় আছে যে ওবিসি পরিসংখ্যান প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিতে পারে। যাকে সামলানো, বিজেপির পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এই নিবন্ধটি প্রথমে প্রিন্ট (ইংরেজি)সংস্করণে ২৩ আগস্ট, ২০২১-এ ‘BJP vote share and caste census’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।
(লেখক সঞ্জয় কুমার একজন অধ্যাপক এবং লোকনীতি-সিএসডিএস-এর সহ-পরিচালক )