Advertisment

Explained: ১৯৬২-র ২১ নভেম্বর, ভারতের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েও যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চিন, কেন?

অরুণাচল প্রদেশ দখল করে নিয়েছিল মাও সেতুংয়ের দেশ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
1962 Sino-Indian war

১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধের সময় টহলরত ভারতীয় সৈন্যরা। (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স)

আজ থেকে ৬১ বছর আগে ১৯৬২ সালের ২১ নভেম্বর, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে চিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল। ১৯৬২ সালের যুদ্ধ ছিল নয়াদিল্লির জন্য একটি বড় অপমান। যা প্রথমবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ভাবমূর্তিকে চিরতরে ক্ষুণ্ণ করেছিল। আর, চিনের জন্য এটি ছিল এক বিরাট সাফল্য। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারতকে নিজেদের শক্তি বুঝিয়ে দেওয়ার পরও। পাশাপাশি, পশ্চিমী দুনিয়ার কাছেও চিনের এই যুদ্ধজয় ছিল বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেওয়া। যাইহোক, যদিও চিন ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ব্যাপকভাবে সাফল্য পেয়েছিল, কিন্তু এর আঞ্চলিক লাভ সেই সাফল্য অনুযায়ী ছিল না। পশ্চিমে আকসাই চিন তারা দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু পূর্বে, চিন ম্যাকমোহন লাইন থেকে ২০ কিলোমিটার পিছিয়ে গিয়েছিল। আর, এখানেই প্রশ্ন যে চিন যেখানে সহজেই জিতে গিয়েছিল, জয়ের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করেছিল, সেখানে তারা কেন আচমকা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল? কেন অতিক্রম করা সীমানার পিছনে সরে গেল?

Advertisment

কেন ১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধ শুরু হয়েছিল?
এর পিছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। অনেকে চিনকে 'উসকানি' দেওয়ার জন্য নেহরুর 'ফরোয়ার্ড নীতি'কে দায়ী করেছেন। খুব সংক্ষেপে বলা যায়, ফরোয়ার্ড নীতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী চিনের সঙ্গে বিবাদমান অঞ্চলে ঘাঁটি তৈরি করেছিল। কেউ কেউ আবার যুক্তি দিয়েছেন যে একটি অপ্রস্তুত এবং অসজ্জিত সেনাবাহিনী দেখেই চিন ভারতে আক্রমণ চালিয়েছিল। আর, ভারত পরাজিত হয়েছিল। অনেকে বলেন যে, দালাই লামা চিনা নিপীড়নের কারণে তিব্বত থেকে পালিয়ে যান। এই পরিস্থিতিতে নেহরু নিজেকে এশিয়ার অবিসংবাদী নেতা হিসাবে দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকে দালাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার ফলেই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল। তাছাড়া, সেই সময় মাও সেতুং-এর গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড নীতির বিরুদ্ধে চিনে ক্ষোভ বেড়ে গিয়েছিল। দেশে জোর করে আধুনিকীকরণ এবং শিল্পায়নের জেরে তৈরি হওয়া ক্ষোভ সামাল দিতে মাওয়ের কাছে একটি যুদ্ধজয় ছিল জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের নিশ্চিত কৌশল।

কখন শেষ হয় ৬২-র যুদ্ধ?
যুদ্ধের তখন সবেমাত্র একমাস। চিন দুই দিক থেকে ভারত আক্রমণ করেছিল, পশ্চিমে লাদাখ অঞ্চলের চারপাশে এবং পূর্বে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল (আজকের অরুণাচল প্রদেশ এবং অসমের কিছু অংশ)। উভয় ফ্রন্টে, এর বিজয় দ্রুত ঘটেছিল। যা নিয়ে আলাদা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অবকাশ ছিল না। চিন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ তাওয়াং (বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে) দখল করতে সক্ষম হয় এবং আরও অগ্রসর হয়। ভারতীয় সৈন্যরা সজ্জিত ছিলেন না। রাজনৈতিক নেতৃত্বও এই আক্রমণে হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। ভারতের পরিস্থিতি মোটেও ভালো ছিল না।

চিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা
এরপর ২১ নভেম্বর চিন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। কারণ হল, প্রথমত- চিন তার নিজের দ্রুত অগ্রগতির মাধ্যমে তার সরবরাহ লাইনকে অতিরিক্ত প্রসারিত করেছিল। তখন শীত শুরু হতে চলেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী তার অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, প্রতিকূল পার্বত্য অঞ্চলে শেষ পর্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল। চিনা সৈন্যরা যত এগিয়ে এসেছিল, ভারতীয় বাহিনী আরও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। এই পরিস্থিতিতে পার্বত্য পথে তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে সরবরাহ এবং শক্তিবৃদ্ধি করা চিনের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠবে, এটা চিন বুঝতে পেরেছিল।

মার্কিন এবং ব্রিটিশ বাহিনীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা
নেহেরু পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। উভয় রাষ্ট্রই আবেদনে সাড়া দিয়েছিল। আমেরিকার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রুস রিডেল ব্রুকিংসের জন্য লিখেছেন, 'প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি অবিলম্বে ভারতে অস্ত্র ও অন্যান্য সরবরাহের জন্য একটি যুদ্ধবিমানকে উড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ার ফোর্সও ভারতে সরবরাহ পাঠানোর জন্য যুদ্ধবিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ভারতকে সাহায্য করার জন্য একটি বিশাল আন্তর্জাতিক অভিযান শুরু হয়েছিল।' এর অর্থ ছিল, চিনের আরও বেশি লড়াইয়ের মধ্যে জড়িয়ে পড়া।

ভারতীয় বিশেষজ্ঞের মত
ইরাকে নিযুক্ত প্রাক্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আরএস কালহা, মনোহর পারিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের জন্য লিখেছেন, 'চিনারা যদি তাওয়াং দখল করার পর থেমে যেত, ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ভারতের পক্ষে তাদের উচ্ছেদ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যেত। পশ্চিমী দেশগুলোও বিষয়টিকে এতটা গুরুত্ব সহকারে নিত না।'

আরও পড়ুন- গাজায় চার দিনের ‘মানবিক যুদ্ধবিরতি’, তারপরই কি ফের ভয়ংকর হত্যালীলার শুরু?

চিনা বিশেষজ্ঞের মত
চিনা বিশেষজ্ঞ হং ইউয়ান, চাইনিজ একাডেমি অফ সোশ্যাল সায়েন্সেসের বিশ্ব রাজনীতি কেন্দ্রের ডেপুটি সেক্রেটারি-জেনারেল এবং গবেষক ছিলেন। তিনি, গ্লোবাল টাইমসে লিখেছেন, 'চিনের আর্টিলারির শব্দ যখন নয়াদিল্লিতে পৌঁছয়, ততক্ষণে পিএলএ যুদ্ধবিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চিন তার সামরিক অভিযান বন্ধ করেছিল। সৈন্যদের প্রত্যাহার করেছিল। যুদ্ধে পিএলএর ক্ষমতা পশ্চিমী সামরিক বিশেষজ্ঞদের অবাক করে দিয়েছিল। আর, চিনকে গর্বিত করেছিল। এই বিজয় অর্ধ শতাব্দী ধরে চিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তে শান্তি এনেছে। যুদ্ধ একটি পদ্ধতি। এটা কোনও লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়। তাই, ১৯৬২ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চিন আসলে তার প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে চেয়েছিল।'

India china USA Britain
Advertisment