প্রথমবার ১ জানুয়ারি নতুন বছরের শুরু হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এর আগে রোমান ক্যালেন্ডার মার্চ মাসে শুরু হত। আর বছর ৩৫৫ দিন ধরে চলত। একটি অতিরিক্ত ২৭-দিন বা ২৮-দিনের ইন্টারক্যালারি মাস কখনও কখনও ফেব্রুয়ারি এবং মার্চের মধ্যে ঢোকানো হত। রোমান শাসক জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে ক্ষমতায় আসেন। তারপরই ক্যালেন্ডারের সংস্কার করেছিলেন। কিন্তু, জুলিয়াস সিজারের এই ক্যালেন্ডার বা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও, ইউরোপের বড় অংশ এই ক্যালেন্ডারকে ১৬ (ষোড়শ) শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত গ্রহণ করেনি।
কার্যত খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবের সঙ্গেই, ১ জানুয়ারিকে একটি নতুন বছরের সূচনা হিসেবে দেখা শুরু হয়েছিল। তবে, যীশুর জন্ম সম্পর্কিত ধর্মীয় অর্থবহ হওয়ায় ২৫ ডিসেম্বর অনেকের কাছেই আরও গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল।
সিজারের দিক থেকে ভুল গণনার সমস্যাও ছিল। যার কারণে নতুন বছরের দিন প্রায়শই বদলাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পোপ গ্রেগরি নিজে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কার এবং ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরেই এটি ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়েও স্বীকৃতি অর্জন করে।
জুলিয়াস সিজারের তৈরি ক্যালেন্ডার
খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীতে রোমের প্রতিষ্ঠাতা রোমুলাস দ্বারা প্রাথমিক রোমান ক্যালেন্ডারের ধারণা তৈরি হয়েছিল। নুমা পম্পিলিয়াস, যিনি এক বছর পরে ক্ষমতায় এসেছিলেন, জানুয়ারিয়াস এবং ফেব্রুয়ারিয়াস মাস যোগ করে এটিকে ১২ মাসের বছর বানিয়েছিলেন। কিন্তু এই ক্যালেন্ডার, যা চন্দ্রচক্র অনুসরণ করত, প্রায়শই ঋতুর সঙ্গে সমন্বয়হীন হয়ে পড়ে। তার ওপর, পঞ্জিকা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে নিযুক্ত ধর্মগুরু বা পুরোহিত পরিষদের সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায়ই নির্বাচনের তারিখে হস্তক্ষেপ করার এবং রাজনৈতিক মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দিন যোগ করার অভিযোগ আনা হয়।
জুলিয়াস সিজার ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ক্ষমতায় আসার পর, ক্যালেন্ডারটি সংস্কার করার চেষ্টা করেছিলেন। যার জন্য তিনি আলেকজান্দ্রিয়ান জ্যোতির্বিদ সোসিজেনাসের পরামর্শ নিয়েছিলেন। সোসিজেনাস চন্দ্রচক্রকে বাদ দিয়ে সূর্যকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যেভাবে মিশরীয়রা করেছিল। সেই অনুসারে, বছরটি ৩৬৫ এবং ১/4 দিনে গণনা করা হয়েছিল।
মজার বিষয় হল, সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালে ৬৭ দিন যোগ করেন, যাতে ৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দেই নতুন বছর ১ জানুয়ারী শুরু হতে পারে। তারিখটি রোমানদের সূচনার ঈশ্বর, জানুসকে সম্মান করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। জোনাসের দুটি মুখ আছে বলে বিশ্বাস করা হয়- একটি অতীতের দিকে বা ফিরে তাকায়। অন্যটি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রাচীন রোমানরা জানুসকে বলিদানের মাধ্যমে এবং একে অপরের সঙ্গে উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করত।
যাইহোক, খ্রিস্টধর্মের প্রসারের সঙ্গেই, একজন রোমান ঈশ্বরের উদযাপনকে ইউরোপের অনেক অংশে একটি পৌত্তলিক আচার হিসেবে দেখা হয়েছিল। সেই কারণে মধ্যযুগীয় ইউরোপে খ্রিস্টান নেতারা ২৫ ডিসেম্বর (বড়দিন) বা ২৫ মার্চ (ঘোষণার পরব)-এর মত আরও ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিনে নতুন বছরের শুরুটা উদযাপন করার চেষ্টা করেছিলেন।
একটি সৌর বছরে দিনের সংখ্যা গণনা করার ক্ষেত্রে সিজার এবং সোসিজেনাসের একটি ত্রুটি ছিল। একটি সৌর ক্যালেন্ডারে প্রকৃত দিনের সংখ্যা হল ৩৬৫.২৪১৯৯। সিজার ৩৬৫.২৫-এর বদলে এমনই গণনা করেছিলেন। ফলে, প্রতিবছর ১১ মিনিটের ব্যবধান তৈরি হচ্ছিল, যা ১৫৮২ সাল নাগাদ প্রায় ১১ দিন যোগ করে।
ইতিহাসবিদ গর্ডন মোয়ার তাঁর প্রবন্ধ, ‘দ্য গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’-এ লিখেছেন যে, 'এই ত্রুটিটি পোপের জন্য নীতিগত উদ্বেগের বিষয় ছিল; কারণ, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার চালু থাকলে ইস্টার উদযাপনের সময়টা শেষ পর্যন্ত গ্রীষ্মকালে চলে যেত।' এরপর মধ্যযুগের খ্রিস্টান জীবনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী একটি ক্যালেন্ডারকে স্থায়ী করার চেষ্টা শুরু হয়।
পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি দ্বারা তৈরি ক্যালেন্ডার
এই সংস্কার সহজ ছিল না। পোপ গ্রেগরি এই উদ্দেশ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ এবং যাজকদের একটি বিশিষ্ট সংস্থাকে একত্রিত করেছিলেন। ক্যালেন্ডার সংস্কারের প্রধান চ্যালেঞ্জটি ছিল, ইউরোপের বিপুল সংখ্যক নাগরিক ততদিনে আগের ক্যালেন্ডার মানা শুরু করেছেন। আর, বছরের শেষের দিকে ঝুলে থাকা দিনের একটি ভগ্নাংশের জেরে তারিখ নিয়ে হাজারো সমস্যায় ভুগছেন।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ভুল গণনা ঠিক করার জন্য, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে কাজ করা ইতালীয় বিজ্ঞানী অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। যেখানে প্রতি চতুর্থ বছর একটি অধিবর্ষ হবে। কিন্তু শতাব্দীর বছরগুলো, যেগুলি ৪০০ দ্বারা বিভাজ্য নয়, সেগুলোকে এই পদ্ধতিতে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ ১,৬০০ এবং ২,০০০ সালগুলো লিপ ইয়ার ছিল। কিন্তু, ১,৭০০, ১,৮০০, এবং ১,৯০০ বছর লিপ ইয়ারের তালিকা থেকে বাদ গিয়েছিল। এই সব সংশোধনী আনুষ্ঠানিকভাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৫৮২-তে পোপের শাসনে গৃহীত হয়েছিল। যাকে ঘিরে ধর্মীয় নেতা এবং পণ্ডিতদের মধ্যে প্রচণ্ড বিতর্ক দানা বাঁধে।
ক্যালেন্ডার সংস্কারের এই ধর্মীয় বিরোধিতা মূলত ক্যাথলিক ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল। ইতিহাসবিদ গর্ডন মোয়ার লিখেছেন, 'এটা ছিল সংস্কারের যুগ; প্রোটেস্ট্যান্ট দেশগুলো নতুন ক্যালেন্ডারকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, এটাকে তাঁর বিদ্রোহীদের রোমের এক্তিয়ারে ফিরিয়ে আনার জন্য পোপের চেষ্টা বলেই নিন্দা করেছিল।' মোয়ার লিখেছেন যে এই অভিযোগটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ছিল না। কারণ, ষোড়শ গ্রেগরি পালটা সংস্কারের একজন নির্মম প্রবর্তক ছিলেন।
ফলস্বরূপ ইতালি, স্পেন এবং পর্তুগালের মতো ক্যাথলিক দেশগুলো নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দ্রুত উৎসাহ দেখায়। আর, ইংল্যান্ড এবং জার্মানির মতো প্রতিবাদী দেশগুলো ১৮ শতকের শেষ পর্যন্ত নতুন ক্যালেন্ডারের ব্যবহার বন্ধ রেখেছিল। কিছু বিবরণ থেকে জানা গিয়েছে যে ১৭৫২ সালে ইংল্যান্ডের রাস্তায় একটি দাঙ্গা হয়েছিল। কারণ, দেশটি নতুন ক্যালেন্ডার গ্রহণ করতে গিয়েছিল। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণকারী সর্বশেষ ইউরোপীয় দেশ ছিল গ্রিস। তারা ১৯২৩ সালে এই ক্যালেন্ডারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
আরও পড়ুন- পরিযায়ীদের জন্য চালু হচ্ছে রিমোট ভোটিং সিস্টেম, কী এটা, কীভাবে হবে ভোটগ্রহণ?
আমেরিকার ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিও যখন তাদের মাতৃ দেশগুলো নতুন ক্যালেন্ডারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তারপরই সেসব গ্রহণ করেছিল। অ-ইউরোপীয় বিশ্বের বড় অংশও ২০ শতকের সময়কালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করতে শুরু করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, জাপান ১৮৭২ সালে তার ঐতিহ্যবাহী লুনিসোলার ক্যালেন্ডারের বদলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার চালু করে। আর চিন ১৯১২ সালে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করে।
আজও ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মায়নামার, ইজরায়েল-সহ এমন কিছু দেশ রয়েছে যেখানে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়। ভারতে সাকা ক্যালেন্ডার যা চৈত্র মাস (মার্চ ২১/২২) দিয়ে শুরু হয় আবার বাংলা ক্যালেন্ডার যা বৈশাখ মাস (১৫/১৬ এপ্রিল) দিয়ে শুরু হয়। তবে, বেশিরভাগ সরকারি কাজেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই ব্যবহৃত হয়।
Read full story in English