Advertisment

বিশ্বে কেন জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী, কেন ভারতে তার ছোবল?

অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানোটা মাটিতে মিশে যাবে যদি এই ভাবে দাম বাড়তে থাকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Petrol and Diesel price hike in bengal 23 october 2021

পেট্রোল একশো পেরিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই, এবার পালা ডিজেলের।

মহামারির কবলে পড়া পৃথিবীর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, আর হু হু করে বাড়ছে তেলের দাম। করে ফেলেছে নতুন রেকর্ড। অপরিশোধিত তেলের দাম ২০১৮-র পর সর্বোচ্চ। শক্তিক্ষেত্রে চাপের মহাশক্তি। প্রাকৃতিক গ্যাস ও কয়লার মূল্য রেকর্ড উচ্চতায়।

Advertisment

দাম-বৃদ্ধির দুনিয়ায়

ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেল পিছু ৮৫ ডলার হয়েছে এ সপ্তাহের শুরুতে। ২০১৮ সালের পর যা সবচেয়ে বেশি। মহামারিতে জীর্ণ অর্থনীতি ট্র্যাকে ফিরছে বলে চাহিদাও দুরন্ত বেগে বাড়ছে, তাই এই ভাবে দামও বাড়ছে। তেলের দাম বাড়ায় অন্য অনেক কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী, তার উপর যা বৃষ্টি, জীবন মৃতবৎ হয়ে গিয়েছে। তেলমূল্যের এই বাড়াবাড়ি দেখে অনেকে বলছেন, বহু দিন বাঁধা পড়ে থাকা ঘোড়া যেন ছাড়া পেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগিয়েছে, কিংবা সদ্য জন্ম নেওয়া গোশাবকের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য সে-ছুট। কিন্তু প্রধান তেল উৎপাদক দেশগুলি ধীরে ধীরে তেলের জোগান বাড়াচ্ছে বাজারে, ফলে চাহিদার তুলনার জোগানাভাবে অর্থনীতির সরল নিয়মেই তেল-মূল্যে এমন আগুন দাউদাউ। এক বছর আগে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল যা ( ব্রেন্ট ক্রুড ছিল ব্যারেল পিছু ৪২.৫ ডলার), এখন তার দ্বিগুণ।
বাড়তি তেলের এই সমূহ চাপের পরও সাম্প্রতিকতম বৈঠকে ওপেগ স্থির করেছে নভেম্বর মাসে প্রতি দিন চার লক্ষ ব্যারেল তেলের সাপ্লাই বাড়াবে তারা। গগনচুম্বী চাহিদার সঙ্গে যার তুলনাই হয় না, মানে চাওয়া-দেওয়ার মধ্যে যাকে বলে আশমান-জমিন পার্থক্য। হিসেবটা কেমন? শীর্ষে থাকা তেল উৎপাদক দেশগুলি, যেমন সৌদি আরব, রাশিয়া, ইরাক, ইউএই এবং কুয়েতের এই জোগান নভেম্বরে চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনার থেকে ১৪ শতাংশ কম।

ওপেগ-প্লাস (OPEC+) বলেছে, কোভিডের ফলে ২০২০ সাল থেকে জোগানে বড় ভাবে কাঁচি চালাতে হয়েছে, তখন তো তেল একেবারে মুখ থুবড়ে মুষড়ে পড়ে, দামও তলানিতে নেমে গিয়েছিল, কিন্তু এখন ঝটিকা-বৃদ্ধি হলেও জোগান কিন্তু ধীরে ধীরেই বাড়তে হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। ভারত ওপেগ-প্লাসের কাছে আরও তেলের জন্য দরবার করেছে, কার্যত যা কাকুতি-মিনতির পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বলে অনেকেরই মত, ভারতের স্পষ্ট এবং উপযুক্ত বক্তব্য, অর্থনীতির এই ঘুরে দাঁড়ানোটা মাটিতে মিশে যাবে যদি এই ভাবে দাম বাড়তে থাকে।

ডেটা-সংস্থা এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল প্ল্যাটস ( S&P Global Platts) বলছে, প্রাকৃতিক গ্যাস নভেম্বরে যে পরিমাণ প্রয়োজন হবে এশিয়ায়, তা সর্বকালীন রেকর্ড স্পর্শিবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম প্রতি এমএমবিটিইউ-তে (মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট) ৫৬.৩ ডলারে। নানা ভাবে দায়ী নানা দেশের পরিস্থিতি। যেমন কাঠগড়ায় আমেরিকায় হারিকেন ইদার তাণ্ডব। তেমনই আবার ইউরোপের চাহিদা বাড়ায় প্রাকৃতিক গ্যাস তুলনায় কম সরবরাহ করতে পারছে রাশিয়া। শীতে তা কমবে আরও।

কালো সোনায় চলছে নাকানিচোবানি। বিদ্যুৎ তো এই-যায়-আর-সেই-যায়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়াটা এই বৃদ্ধির একটা বড় কারণ, তা বহু বার বলা হয়েছে, আরেক বার এই প্রসঙ্গে জানাচ্ছি। অনেকটাই দায়ী মাও জে দং, দেং জিয়াও পিং থুড়ি শি জিনপিংয়ের চিন। চিন জুড়ে বিভিন্ন কারখানাতেই এই শর্টেজের শিহরণ চলছে। ফলে আন্তর্জাতিক কয়লার বাজারটা প্রায় খোঁড়া। অনেকের কটাক্ষ: প্রথমে চিনা করোনা, এবং এখন কোল ক্রাইসিসেও চিনের ছোবল। ড্রাগনের আগুন পিছু ছাড়ছে না যেন। ইন্দোনেশিয়ার কয়লার দামও হুহু করে বেড়েছে। মার্চে প্রতি টন ইন্দোনেশিয়ার কয়লার দাম ছিল ৬০ ডলার, অক্টোবরে তা বেড়ে হয়েছে প্রতি টনে ২০০ ডলার।

ভারতে দারুণ প্রভাব

২০২১ থেকেই অপরিশোধিত তেলের বদান্যতায় এ দেশে নিত্যনতুন রেকর্ড করছে পেট্রোল-ডিজেলের দাম। দিল্লিতে পেট্রোলের দাম লিটার পিছু পৌঁছে গিয়েছে ১০৫. ৮৪ টাকায়। তিন সপ্তাহে দাম বেড়েছে লিটার পিছু ৪.৬৫ টাকা। ডিজেলের দাম পৌঁছেছে প্রতি লিটারে ৯৪.৬ টাকায়, যা ওই একই সময়ে বেড়েছে ৫ টাকা ৭৫ পয়সা।

প্যান্ডেমিক জনিত কঠোরতা থেকে দেশের মুক্তির পর, ভারত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তার চাকা চালানোর জন্য তেলের প্রয়োজনও কী ভাবে বাড়ছে, এটা এত ক্ষণে নিশ্চয়ই জলবৎ হয়ে গিয়েছে, যদিও সবটা এক রকম নয়, কেমন সেটা? দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরে পেট্রোলের প্রয়োজন গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় বেড়েছে ৯ শতাংশ, কিন্তু ডিজেলের ক্ষেত্রে মোটেই তেমন ছবি নয়, কারণ ২০২০-তে যে পরিমাণ ডিজেলের প্রয়োজন হত, তার থেকে প্রয়োজনটা এখন ৬.৫ শতাংশ কম। ভারতে পেট্রোলিয়াম-জাত পণ্যের ৩৮ শতাংশ ডিজেল নির্ভর। কৃষি-ক্ষেত্রেও ডিজেল একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি। এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল প্ল্যাটস বলছে, ডিজেলের প্রয়োজন আগামী কয়েক মাসে এ দেশে বাড়বে। বিশেষ করে এই টানা উৎসবের মরশুমে এই সম্ভাবনাটা প্রবল। প্ল্যাটসের বিশ্লেষণ জানাচ্ছে, মহামারি-পূর্ব সময়ে অপরিশোধিত তেলের চাহিদা পৌঁছতে পৌঁছতে কিন্তু ২০২২।

প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশেও তা লাফাচ্ছে। ওএনজিসি এবং ওয়েল ইন্ডিয়ার মতো সরকারি তেল সংস্থাগুলির তেল-মূল্য বাড়িয়েছে পেট্রোলিয়াম প্ল্যানিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস সেল বা PPAC। গত ছ'মাসে প্রতি এমএমবিটিইউ-র দাম ১.৭৯ ডলার থেকে বেড়ে ২.৯ ডলারে পৌঁছে গিয়েছে। গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে কমপ্রেসড ন্যাচারাল গ্যাস বা সিএনজির দাম বেড়েছে, যা পরিবহণের কাজে অতি গুরুত্বপূর্ণ, বেড়েছে পাইপড ন্যাচারাল গ্যাস বা পিএনজি-র দামও। যা রান্নার জ্বালানি। মানে হেঁসেল পুড়ছে এই ভাবে। এই মাসে সিএনজির দাম দু'বার বেড়েছে। মোট বৃদ্ধি প্রতি কেজিতে ৪ টাকা ৫৬ পয়সা। রাজধানীতে দাম পৌঁছে গিয়েছে ৪৯.৮-এ। পিএনজি-র মূল্য বেড়েছে প্রতি এসসিএমে (scm = standard cubic meter) ৪.২ টাকা। হয়েছে ৩৫.১১ টাকা।

কয়লার দাম বাড়ায় তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি সঙ্কট-ঘন, ইতিমধ্যেই যা সকলেই জেনে গিয়েছেন। কয়লা-স্টক তলানি পৌঁছানোয় পাওয়ার এক্সচেঞ্জ থেকে পাঞ্জাব, রাজস্থানের মতো বেশ কয়েকটি রাজ্যকে অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। ফলে ভয়ঙ্কর হাহাকার।

দেখা যাচ্ছে, সঙ্কটের কোনও শেষ নেই। কোভিড অর্থনীতির রক্ত শুষে নিয়ে যে ছিবড়েটা ফেলে দিয়েছিল এই সেই দিন, তাতে এখন প্রাণ সঞ্চারিত হলে কী হবে, নতুন প্রাণ… নব আনন্দে জাগা যাবে না কিছুতেই-- কারণ, থেমে থাকা ট্রেনটা এক ঝটকায় চলতে শুরু করেছে। ইনার্শিয়ায় ধপাধপ করে এ-ওর ঘাড়ে গিয়ে পড়ছে। মাথা ঠুকে গিয়ে আলু, হাত-পা ভেঙে একশেষ, হাসপাতালে ভর্তি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Explained Petrol-Diesel price Hike
Advertisment