বেবি পাউডার বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে জনসন অ্যান্ড জনসন। সিদ্ধান্তটি এক কথায় ঐতিহাসিক। শিশুজীবনের অঙ্গ যে বেবি পাউডার, তার বিরুদ্ধে সুনামির মতো অভিযোগের জেরে এই সিদ্ধান্ত তারা নিতে বাধ্য হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বহু মামলা হয়েছে এই পাউডারের বিরুদ্ধে। মামলায় মহিলাদের অভিযোগ, তাদের ডিম্বাশয়ে ক্যান্সারের কারণ এই পাউডার। তাঁদের দাবি, পাউডারে রয়েছে অ্যাসবেস্টস, যা থেকে ক্যান্সার হয়।
আমেরিকা এবং কানাডায় অবশ্য দু’বছর আগেই এই পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দেয় জনসন অ্যান্ড জনসন। বাকি পৃথিবীতে এর বিক্রিবাটা বন্ধের কারণ হিসেবে এই ফার্মা সংস্থা অবশ্য বলেছে অন্য কথা। বলেছে, বাণিজ্যিক পরিবর্তনের নিরিখে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কর্নস্টার্চ (cornstarch) নির্ভর বেবি পাউডার তারা সামনে এনেছে বিকল্প হিসেবে।
ইতিমধ্যেই তা বিক্রিও হচ্ছে কয়েকটি দেশে। লাগাতার জনসন অ্যান্ড জনসনের চির-চেনা বেবি পাউডারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও, সংস্থাটি এই পাউডারকে সুরক্ষিত বলে দাবি জানিয়ে এসেছে। বৃহস্পতিবার এই পাউডার বিক্রি বন্ধের সিন্ধান্ত ঘোষণা করেও তারা জানিয়ে দিয়েছে, এ নিয়ে পুরনো অবস্থান বদল হয়নি। তাদের বক্তব্য, ট্যাল্ক-নির্ভর তাদের এই বেবি পাউডারে অ্যাসবেস্টস মোটেই নেই, ফলে এটি সম্পূর্ণ সুরক্ষিত।
ট্যাল্ক হল সবচেয়ে নরম খনিজ পদার্থ। এটি-- হাইড্রস ম্যাগনেশিয়াম সিলিকেট। বিভিন্ন কসমেটিক এবং পারসোনাল কেয়ার প্রোডাক্ট তৈরিতে এটি কাজে লাগে। যেমন বেবি পাউডার, লিপস্টিক, আইশ্যাডো, ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। ত্বক শুষ্ক রাখতে সাহায্য করে এটি। Rash বেরোতে দেয় না। মেক-আপ অনেক ক্ষণ থাকে ত্বকের উপর।
ক্যান্সারের কারণ
অ্যাসবেস্টস। আর একটি খনিজ পদার্থ। যেখানে ট্যাল্ক পাওয়া যায় তার কাছাকাছিই এটি মেলে। ফলে অনেক সময় ট্যাল্কের সঙ্গে এটি মিশেও যেতে পারে, অন্তত এমনটাই মনে করছে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বা এফডিএ। অ্যাসবেস্টস নির্মাণ শিল্পে ব্যবহার করা হয়। এটি ফুসফুস, ওভারিয়ান ক্যান্সারের কারণ। এ ছাড়াও আরও কিছু রোগেও অ্যাসবেস্টস দায়ী।
আমেরিকার ক্যান্সার সোসাইটি বলছে, যদি ট্যাল্কে অ্যাসবেস্টস মিশে যায়, তা হলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও অ্যাসবেস্টস ফ্রি ট্যাল্ক ক্ষতিকর কিনা, সে ব্যাপারেও সংশয় রয়েছে। ১৯৬০ থেকেই বলা হচ্ছে যে, যদি যৌনাঙ্গে ট্যালকম পাউডার দেওয়া হয়, যদি স্যানিটারি ন্যাপকিনে এই পাউডার ব্যবহার করা হয়, তা হলে ওভারিয়ান ক্যান্সার হতে পারে। অবশ্য এফডিএ বলছে, এ সংক্রান্ত গবেষণা থেকে এমন সিদ্ধান্তে এখনও পৌঁছানো যায়নি।
জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে মামলা
১৮৯৪ সাল থেকে জনসন অ্যান্ড জনসন এই বেবি পাউডার বিক্রি করছে। ডায়পার ব্যবহারে বাচ্চাদের যে rash বেরোয়, তা রুখতে এই পাউডার ফলপ্রসূ। ১৯৯০-এর শেষ দিক থেকে জেঅ্যান্ডজে এই পাউডারের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার মুখে পড়তে থাকে। যদিও সংস্থা পাউডারটিকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত বলে দাবি জানিয়ে আসছে। ডারলেন কোকের সম্ভবত প্রথম মামলাকারী। যাঁর দাবি ছিল, বিষাক্ত ট্যাল্ক পাউডার তাঁর শিশুর পাশাপাশি তিনিও ব্যবহার করেছেন, আর তাতেই মেসোথেলিয়োমায় আক্রান্ত।
মেসোথেলিয়োমা হল এক জাতীয় ক্যান্সার, টিসু এবং নানা অঙ্গে এই আক্রমণ ঘটে। কিন্তু মামলাটিতে কোকের ব্যাকফুটে চলে যান। কারণ, জনসন অ্যন্ড জনসন ট্যাল্ক সংক্রান্ত অভ্যন্তরীণ রিপোর্ট দেখানো এড়ায়। এবং রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, কোকেরকে মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয়। তার পর থেকে গাদা গাদা মামলা জনসন অ্যান্ড জনসনের বিরুদ্ধে। অভিযোগ একই, পাউটারে বিষাক্ত অ্যাসবেস্টস রয়েছে। ৪০,৩০০টি মামলা হয়েছে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই, বলছে ব্লুমবার্গ। এবং জনসন অ্যান্ড জনসনকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার দিতে হয়েছে মামলা নিষ্পত্তি বাবদ। ২০১৮ সালে বেবি পাউডারে অ্যাসবেস্টস মেলায় আমেরিকার মিসৌরি আদালত ২২ জন মহিলাকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে বলে জনসন অ্যান্ড জনসনকে। কারণ, মহিলাদের এই পাউডার ব্যবহারে ওভারিয়ান ক্যান্সার হয়েছে বলে অভিযোগ।
গত বছর এসোসিয়েট প্রেসের রিপোর্ট বলছে এমনই। এমন ঘটনা রয়েছে আরও। রয়টার্স এবং নিউ ইয়র্ক টাইমসের তরফে এই বেবি পাউডার নিয়ে তদন্ত চালানো হয়, দেখা যায়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পাউডারে সামান্য পরিমাণে অ্যাসবেস্টসের উপস্থিতি থাকছে। যদিও সংস্থাটি এই পাউডারকে অ্যাসবেস্টস-ফ্রি বলেই চলে।
আরও পড়ুন- পেরিয়ে গেল স্বাধীনতা দিবস, এখন কীভাবে সযত্নে রাখবেন জাতীয় পতাকা
কী ভাবে আমেরিকায় বিক্রি বন্ধ?
২০১৯ সালে ৩৩ হাজার বোতল বেবি পাউডার প্রত্যাহার করে এই সংস্থা। কারণ, এফডিএ একটি বোতলে অ্যাসবেস্টস পেয়েছিল। তার অল্প পরেই জনসন অ্যান্ড জনসন জানায়, তারা ওই বোতলের ১৫টি নমুনার পরীক্ষা করেছে নানা ল্যাবে। কিন্তু কোনও অ্যাসবেস্টস পাওয়া যায়নি, ২০২০ সালে এমনই রিপোর্ট সিবিএস নিউজের। ওই বছরের মে মাসে সংস্থাটি ঘোষণা করে আমেরিকা এবং কানাডায় তারা ট্যাল্ক নির্ভর বেবি পাউডার বিক্রি করবে না আর। কিন্তু তার পর বাকি পৃথিবীতে এটি বিক্রি বন্ধ করতে এত সময় কেন লাগল, সেই প্রশ্ন থাকছে।
প্রশ্ন এমনও যে, এত যখন অভিযোগ, এত মামলা, তাও সংস্থাটি বেবি পাউডারের সুরক্ষার প্রশ্নে কী ভাবে এখনও অনড়। সংস্থার দাবি যদি সত্যি হয়, তা হলে সব মামলাই ভুয়ো। না হলে, বিষ পাউডারই এত দিন ধরে বিক্রি করে গিয়েছে সংস্থাটি সব জেনে। যদি দ্বিতীয়টায় কিছু মাত্র সারবত্তা থেকে থাকে, তা হলে জনসন অ্যান্ড জনসনের অন্যান্য প্রোডাক্টও তো সংশয়ে ঘেরা। তাই না?
Read full story in English