স্বাধীনতার সময় থেকেই ধারাবাহিক ভাবে ভারতের স্থলভূমির এক পঞ্চমাংশ অধিকার করে এসেছে বনভূমি। স্বাধীনতার পর এতদিনে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। ১৯৫১-৮০-র মধ্যে মোট ৪২.৩৮০ বর্গ কিলোমিটার বনভূমি স্থানচ্যুত হয়ে অন্যত্র জায়গা পেয়েছে বৃক্ষরোপণ ইত্যাদির মাধ্যমে সবুজায়নের। এবং এর ৬২ শতাংশ গিয়েছে কৃষিকাজে। তবু এখনও দেশের স্থলভূমির অনুপাতে বনভূমির শতাংশের হিসেব সেই কুড়ির সামান্য উপরেই ঘোরাফেরা করছে।
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে 'ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া'-র প্রকাশিত ২০১৭ সালের 'দ্য ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট' অনুযায়ী, ২০১৫ সাল থেকে দেশের বনভূমির পরিমান বেড়েছে ৬,৬০০ বর্গ কিলোমিটার, শতাংশের হিসাবে বৃদ্ধি .২১। রিপোর্ট অনুসারে, ২০০৭ সালের পর এই প্রথম 'ঘন জঙ্গল'-এর পরিমান বেড়েছে ৫,১৯৮ বর্গ কিলোমিটার।
যদি মাথায় রাখা যায়, ১৯৮৭ সালে প্রথম বনসমীক্ষার পর থেকে দেশে বনভূমির পরিমান বেড়েছিল মাত্র ৬৭,৪৫৪ বর্গ কিলোমিটার, এই সর্বশেষ পরিসংখ্যান খুশি হওয়ার মতোই।
কিন্তু সবুজায়ন আর বনভূমি কি সমার্থক? বনভূমির উপর নগরায়নের ক্রমবর্ধমান চাপ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে বনাঞ্চলের বৃদ্ধি সম্ভব?
এক, ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এফএসআই) স্যাটেলাইট ইমেজ ব্যবহার করে এবং সহজাত প্রাকৃতিক বনভূমি এবং কৃষিজমির মধ্যে পার্থক্যকে হিসেবের আওতায় আনে না।
দুই, আটের দশকে স্যাটেলাইট নির্ধারিত বনভূমির মানদণ্ডে ৪ বর্গ কিলোমিটারের থেকে ছোট জমিকে বনাঞ্চলের আওতায় ধরা হত না। এখনকার মানদণ্ডে ১০ শতাংশ ঘনত্ব থাকলেই তাকে বনভূমি হিসাবে ধরা হচ্ছে। ফলে লক্ষ লক্ষ ছোট জমিও চলে আসছে বনভূমির তালিকায়, বৃদ্ধি ঘটছে শতাংশের হিসাবে।
উদাহরণস্বরূপ, এফএসআই-এর প্রথম রিপোর্ট অনুযায়ী দিল্লিতে বনভূমি ছিল মাত্র ১৫ বর্গ কিমি, যা সর্বশেষ রিপোর্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯২ বর্গ কিলোমিটারে। অর্থাৎ, ত্রিশ বছরে প্রায় ১৩ গুণ বৃদ্ধি। একই ভাবে, কৃষিনির্ভর রাজ্য পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় আটের দশকের তুলনায় বনভূমি বেড়েছে হাজার বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি।
ঘন জঙ্গল বলতে ধরা হয় ৪০ শতাংশের বেশি বৃক্ষ-ঘনত্ব আছে, এমন বনভূমিকে। ঘনত্ব কমে গিয়ে ১০ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে থাকলে তাকে আর ঘন জঙ্গল বলা হয় না।বলা হয় উন্মুক্ত বনাঞ্চল। ঘনত্ব আরও কমে গেলে তা চলে যায় বনভূমির তালিকার বাইরে, যাকে বলা হয় 'নন-ফরেস্ট'। এখন উন্মুক্ত বনাঞ্চলেও আবার ঘনত্বের পরিমান ক্রমে বেড়ে ফের তালিকাভুক্ত হতে পারে ঘন জঙ্গলের। আবার, 'নন-ফরেস্ট' অঞ্চলের ক্ষেত্রেও ক্রমে উন্মুক্ত এবং পরে ঘন বনভূমি হয়ে ওঠারও সম্ভাবনা থাকে।
গত দেড় দশকে ১৫,৯২০ বর্গ কিমি ঘন জঙ্গল পরিণত হয়েছে 'নন-ফরেস্ট'-এ। এই ক্ষতি অবশ্য, অন্তত কাগজে কলমে, পুষিয়ে গিয়েছে ৮,৩৬৯ বর্গ কিমি 'নন-ফরেস্ট' অঞ্চলের ঘন জঙ্গলে পরিণত হওয়ায়। শুধু গত দুই বছরেই ঘন জঙ্গলের পরিমান বেড়েছে ৩,৬০০ বর্গ কিমি।
কিন্তু কী করে সম্ভব হচ্ছে রাতারাতি এই রূপান্তর? উত্তরটা সহজ, 'নন-ফরেস্ট' তালিকাভুক্ত অঞ্চলগুলিতে রয়েছে দ্রুত বড় হয় এমন বৃক্ষসমূহ, যা ছোট অবস্থায় স্যাটেলাইট ছবিতে ধরা পড়ে না, কিন্তু দ্রুত বড় হয়ে অচিরেই ভূমির বৃক্ষ-ঘনত্ব বাড়িয়ে দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘন জঙ্গলের তালিকায়।
২০০৩ থেকে আমরা বস্তুত প্রতি বছর হাজার বর্গ কিমির বেশি ঘন জঙ্গল হারিয়েছি এবং ক্ষতিপূরণের চেষ্টা করেছি বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে। এই প্রবণতা ক্রমশ আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ২,২০৬ বর্গ কিমি ঘন জঙ্গল হারিয়েছে ভারত। তার এক দশক পরে, সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে এফএসআই যতই বনভূমির শতাংশ বৃদ্ধির দাবি করুক, আমরা ২০১৫-১৭-র মধ্যে আসলে হারিয়েছি ৬,৪০৭ বর্গ কিমি ঘন জঙ্গল।
ক্ষতির পরিমানটা আন্দাজ করা যায় একটু তলিয়ে দেখলে। বোঝা যায়, কাগজে কলমে যাকে বনভূমি বলা হচ্ছে, তা আদতে বনভূমিই নয়। এফএসআই-এর রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আমরা যে পরিমান বনভূমি হারিয়েছি, তার আয়তন প্রায় গুজরাট রাজ্যের মোট স্থলভূমির সমান।
সুতরাং, বনাঞ্চল-বিষয়ক সরকারি পরিসংখ্যান প্রকৃত ছবিটা তুলে ধরে না। ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার বিষয়টি নিয়ে ভাবার সময় এসেছে, বনভূমি সংক্রান্ত তথ্যের শ্ৰেণীবিভাগ করার সময় এসেছে। এতে প্রকৃত ছবিটা যেমন সামনে আসবে, তেমনই সুযোগ আসবে গভীরতর বিশ্লেষণের।