সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ পিটিশনের শুনানি করছে। ৩৭০ ধারা ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। কীভাবে এবং কেন এই ‘বিশেষ মর্যাদা’? ভারতের অভ্যন্তরে এবং প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর স্থায়ী বিতর্ক এবং রক্তপাতের কেন কারণ হয়ে দাঁড়াল? এই বিষয়গুলো জানতে হলে কতগুলো ঘটনা জানা দরকার। সেগুলো হল— বিভাজনের পরে মহারাজা হরি সিংয়ের স্বাধীন থাকার সর্বনাশা সিদ্ধান্ত, পাকিস্তানি উপজাতিদের কাশ্মীর আক্রমণ, চাপের মুখে হরি সিংয়ের ভারতে যোগদান, হামলাকারীদের তাড়াতে ভারতের সৈন্য পাঠানোর ঘটনা। এর পাশাপাশি জানা দরকার, কাশ্মীর ইস্যুতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, হরি সিং কেন ভারতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? র্যাডক্লিফ বাউন্ডারি কমিশনের গুরুদাসপুর বিভাগ কেন তাৎপর্যপূর্ণ ছিল? কেন রাষ্ট্রসংঘে কাশ্মীর ইস্যু গেল? জওহরলাল নেহেরু এবং বল্লভভাই প্যাটেলের ভূমিকা কী ছিল?
পূর্বের সুইজারল্যান্ড
জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটি ১৮৪৬ সালের মার্চে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময় ব্রিটিশরা প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধের পরে অমৃতসর চুক্তির অধীনে, জম্মুর ডোগরা জায়গিরদার গুলাব সিং-কে ৭৫ লক্ষ নানকশাহি রুপিতে কাশ্মীর বিক্রি করেছিল। মহারাজা হরি সিং সেই ডোগরা পরিবারের উত্তরসূরি। তিনি ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় কাশ্মীরের সিংহাসনে ছিলেন। ব্রিটিশরা ভারতকে বিভক্ত করার পর চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেই সময়, দেশীয় রাজ্যগুলোকে ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান বা স্বাধীন থাকার বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। যদিও স্বাধীন থাকার বিকল্পটি তেমন একটা বাস্তবোচিত ছিল না। তবুও, এই বিকল্পটিই হরি সিং গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কাশ্মীরকে 'সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ', 'প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড' করার স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ভাইসরয় লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন শ্রীনগর সফর করেন। তিনি হরি সিং-কে যে কোনও একটি দেশের সঙ্গ বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু, হরি সিং তাঁকে জানিয়েছিলেন যে তিনি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে থাকতে চান। এই ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেন কাশ্মীরের রাজার সাথে সাক্ষাত করতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু, শেষ মুহূর্তে তাঁকে জানানো হয়েছিল যে হরি সিং অসুস্থ।
গুরুদাসপুর সীমান্ত
এখান গুরুদাসপুর সীমানা নিয়ে র্যাডক্লিফ কমিশনের সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ভৌগোলিকভাবে, কাশ্মীর উপমহাদেশের সঙ্গে তিনটি পথ দ্বারা যুক্ত: রাওয়ালপিন্ডি-বারামুলা-শ্রীনগর; শিয়ালকোট-জম্মু-বানিহাল পাস এবং গুরুদাসপুর হয়ে জিপের চলাচলের যোগ্য পাথুরে রাস্তা। গুরুদাসপুর জেলায় শকরগড়, বাটালা, গুরুদাসপুর এবং পাঠানকোট এই চারটি জেলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলিম। তাঁরা চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। সেটা হলে, কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের আর কোনও স্থলপথে যোগাযোগ থাকত না। এই প্রসঙ্গে ব্রিটিশ লেখক ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ড তাঁর 'কাশ্মীর ইন কনফ্লিক্ট' বইয়ে লিখেছেন, 'কার্যত পুরস্কার হিসেবেই বাটালা, গুরুদাসপুর এবং পাঠানকোট তিনটি মহকুমা ভারতের হাতে চলে যায়। এই ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পঞ্জাব রাজ্যের মন্ত্রীর তৈরি একটি স্মারকলিপি। যেখানে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে 'অমৃতসর জেলাকে সেচের জল দেয় এমন খালগুলোর শুরুটা গুরুদাসপুর জেলায়। সেই কারণে এই খালগুলোর যে কোনও একটি ভারতের সঙ্গে রাখা জরুরি।' এই কারণেও হরি সিং-এর ভারতে যোগদানের সুযোগ বেড়েছিল। আর, পাকিস্তান বিষয়টি ব্রিটিশদের 'অন্যায়ভাবে পক্ষপাতিত্ব' হিসেবে দেখেছিল।
স্বাধীনতার পর
এই ভাবেই চলে আসে ১৫ আগস্ট, ১৯৪৭। কিন্তু, তারপরও হরি সিং ভারতে যোগ দিতে রাজি হননি। তিনি যা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তা ছিল ভারত এবং পাকিস্তান- উভয়ের সঙ্গেই 'আক্রমণ না-করার চুক্তি'। যার অর্থ ছিল, কাশ্মীর থাকবে বাফার স্টেট হিসেবে। যেখানে বাণিজ্য, ভ্রমণ এবং যোগাযোগ পরিষেবা চলবে ব্রিটিশদের অধীনে। পাকিস্তান এতে স্বাক্ষর করলেও ভারত অপেক্ষা করা শুরু করে। এইভাবে যখন ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে, জম্মু ও কাশ্মীরও নিয়মমাফিক স্বাধীন হয়ে যায়। একমাস পরেই কিন্তু, কাশ্মীরের এই স্বাধীনতা বিশেষভাবে গোটা বিশ্বের নজরে পড়ে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য পেট্রোল, চিনি, লবণ, জামাকাপড় ইত্যাদি বহনকারী লরিগুলো সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানের দিকে আটকানো হয়। যাকে অনেকেই হরি সিংয়ের ওপর পাকিস্তানের চাপ সৃষ্টির চোখে দেখেছিল।
আরও পড়ুন- ভারতে খুচরো মুদ্রাস্ফীতি: কোন দ্রব্য এবং কোন রাজ্যে দাম সবচেয়ে বেড়েছে?
হানাদারদের হামলা
এরপর নেহেরু ১৯৪৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্যাটেলকে লিখেছিলেন যে জম্মু ও কাশ্মীরের পরিস্থিতি 'বিপজ্জনক এবং অবনতিশীল'। নেহরু বিশ্বাস করতেন যে পাকিস্তান 'কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করার এবং আসন্ন শীতে কাশ্মীর ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর বড় পদক্ষেপ গ্রহণের' পরিকল্পনা করছে। এরপর অনুপ্রবেশকারীরা একমাসেরও কম সময়ের মধ্যে, ২২ অক্টোবর তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে। ভারত ও পাকিস্তান কখনই একমত হয়নি যে হানাদারদের কে পাঠিয়েছিল এবং কেন পাঠিয়েছিল। ভারত বলেছে যে উপজাতিরা পাকিস্তানের মদতে হামলা চালিয়েছিল। যার প্রমাণ, তাদের ব্যবহৃত ট্রাক এবং উন্নত অস্ত্র। আর, পাকিস্তান জোর দিয়ে জানিয়েছিল যে, পাঠানরা ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে 'অত্যাচারের প্রতিশোধ' নেওয়ার জন্য নিজে থেকে এই হামলা চালিয়েছিল। কারণ, হরি সিংয়ের সঙ্গে কাশ্মীরের স্থানীয় মুসলিম জনগণের বিরোধ পুঞ্চে একটি বিদ্রোহের সৃষ্টি করেছিল।
জিন্না গোড়া থেকেই জানতেন
যদিও বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে, মহম্মদ আলি জিন্নাহ গোড়া থেকেই যাবতীয় বিষয়গুলো জানেন। সে যাই হোক, অনুপ্রবেশকারীরা দ্রুত অগ্রসর হয়। তারা মুজাফফরাবাদ দখল করে। উরিতে মহারাজার বাহিনীকে পরাজিত করে। ২৪ অক্টোবর, পুঞ্চের বিদ্রোহীরা আনুষ্ঠানিকভাবে মহারাজার কাছ থেকে আজাদ (মুক্ত) কাশ্মীরের ঘোষণা করে। আজাদ কাশ্মীরের বাহিনী মাহুতায় পৌঁছয়। এরপর তারা বারামুলার দিকে রওনা দেয়। সঙ্গে হিন্দু, স্থানীয় মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের ওপর লুটপাট চালায়। তাঁদের হত্যা করে। এই সময় হরি সিং সামরিক সাহায্যের জন্য ভারত সরকারের কাছে আবেদন জানায়। একদিন পরে ২৫ অক্টোবর, ভারত সরকারের শীর্ষ কূটনীতিক ভিপি মেনন শ্রীনগরে যান এবং হরি সিংকে নিরাপত্তার জন্য জম্মুতে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ২৬ অক্টোবর, মেনন দিল্লিতে ফিরে যান এবং প্রতিরক্ষা কমিটির একটি সভা হয়। যেখানে গভর্নর-জেনারেল মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন যে হরি সিং সম্মত হওয়ার পরেই ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ করা উচিত। মেনন জম্মুতে ফিরে যান। আর, হাতে ভারতে যোগদানের অনুমতিপত্র নিয়ে ফিরে আসেন।
মহারাজার চিঠি
মাউন্টব্যাটেনকে মহারাজার চিঠিটি পড়ে শোনানো হয়। যাতে লেখা ছিল, 'বর্তমানে আমার রাজ্যে যে পরিস্থিতি এবং জরুরি অবস্থা, তাতে ভারতের কাছে সাহায্য চাওয়া ছাড়া আমার বিকল্প নেই। স্বাভাবিকভাবেই, আমার রাজ্য ভারতের সঙ্গে যোগ না-দিলে, ভারতও আমার কাছে চাওয়া পাঠাতে পারবে না। আমি, সেই অনুযায়ী তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কারণ, বিকল্প হল আমার রাজ্য এবং আমার জনগণকে বর্বরদের হাতে ছেড়ে দেওয়া।' এরপরই ভারতীয় সৈন্যরা শ্রীনগরে যায় এবং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। শুধু তাই নয়, ভারতীয় সৈন্যরা কাশ্মীরের অন্য অংশ থেকে হানাদারদের তাড়িয়ে দিতেও শুরু করে।
জম্মু-কাশ্মীরে গণভোটের প্রশ্ন
হরি সিংকে মাউন্টব্যাটেন পালটা বলেন যে, 'রাজ্যের ক্ষেত্রে যোগদানের বিষয়টি বিবাদের হয়ে উঠেছে, সেখানে যোগদানের প্রশ্নটি রাজ্যের জনগণের ইচ্ছা অনুসারে হওয়া উচিত। কাশ্মীরে আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। তার মাটি হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার সঙ্গেই কাশ্মীরের যোগদানের প্রশ্নের মীমাংসায় জনগণের মতামত নেওয়া উচিত। ভারতীয় নেতারাও দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন যে রাজার ভারতে যোগদান সত্ত্বেও কাশ্মীরে শান্তি পুনঃস্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই গণভোট হবে।'
লিয়াকতকে নেহরুর টেলিগ্রাম
১৯৪৭ সালের ৩১ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে টেলিগ্রামে নেহরু বলেন, 'মহারাজার সরকার এবং কাশ্মীরের সর্বাধিক সংখ্যক প্রতিনিধিত্বশীল জনপ্রিয় সংগঠন (শেখ আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স)-এর অনুরোধে আমরা ভারতে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপরও এই নীতি নেওয়া হয়েছে যে কাশ্মীরের মাটি থেকে হানাদারদের বিতাড়িত করার সঙ্গে সঙ্গে, সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার হলে, কাশ্মীরের জনগণই রাজ্যভুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।'
গণভোটের প্রশ্ন
নেহেরু এবং প্যাটেল-সহ ভারতীয় নেতাদের কাছে জম্মু-কাশ্মীর প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার জন্য গণভোট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, কাশ্মীরিরা ভারতকে বেছে নিলে পাকিস্তানের সমস্ত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল ভারত থেকে সরে যেতে চায়, এমন দাবিও প্রত্যাখ্যান করবে। যেমনটা জুনাগড়ের ক্ষেত্রে হয়েছিল। সেখানে মুসলিম-শাসিত হিন্দু-অধ্যুষিত রাজ্য পাকিস্তানে যোগদান করেছিল। সেই সময় ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণভোটের জেরে জুনাগড় ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। যাইহোক, জম্মু ও কাশ্মীরে গণভোট হয়নি। কারণ, গণভোটের পূর্বশর্ত হিসেবে যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছিল, তা কখনও অর্জিত হয়নি।