কেরলের কোঝিকোড় জেলায় নিপা ভাইরাসে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়ার পরে আরও সংক্রমণের খবর মিলেছে। যার মধ্যে ৯ ও ২৪ বছর বয়সি দুই রোগীও আছে। তারা ৩০ আগস্ট নিপায় প্রথম মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারের সদস্য। মঙ্গলবার সকালে কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীনা জর্জ কোঝিকোড়ে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মান্ডাভিয়া জানিয়েছেন, কেরলে বিশেষজ্ঞদের একটি কেন্দ্রীয় দল পাঠানো হয়েছে। বাঁচোয়া বলতে এই যে নিপা ভাইরাস কোভিড-১৯-এর দ্রুতবেগে ছড়ায় না। তবে, এই ভাইরাস অত্যন্ত মারাত্মক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুযায়ী নিপার বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক মৃত্যুহার ৪০% থেকে ৭৫%।
নিপা সংক্রমণ কী?
নিপা একটি জুনোটিক রোগ। যার অর্থ এটি সংক্রমিত প্রাণী বা দূষিত খাবারের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এটি সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে এক ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে। এমনটাই জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) অনুসারে এর লক্ষণগুলো হল- জ্বর, মাথাব্যথা, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাস নিতে অসুবিধা এবং বমি। পরিস্থিতি গুরুতর হলে রোগীর বিভ্রান্তি, তন্দ্রা, খিঁচুনি, এনসেফালাইটিস (মস্তিষ্কের ফোলা) হতে পারে। শেষে কোমা আর মৃত্যুও ডেকে আনে।
নিপা কীভাবে সংক্রমিত হয়?
মানুষের মধ্যে নিপা ভাইরাস সংক্রমণের প্রথম খবর পাওয়া গিয়েছিল মালয়েশিয়া (১৯৯৮) এবং সিঙ্গাপুর (১৯৯৯) থেকে। ভাইরাসটির নাম মালয়েশিয়ার গ্রাম থেকে এসেছে। সেখানে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। প্রাণীদের থেকে সংক্রমণ মূলত দূষিত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে ঘটে। সিডিসির মতে, সংক্রমণ ঘটতে পারে, 'কাঁচা খেজুরের রস বা ফল খাওয়ার কারণে। যা সংক্রামিত বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাব দ্বারা দূষিত হয়ে থাকে বলে হামেশাই অভিযোগ ওঠে। যাঁরা গাছে চড়েন, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে তাই নিপা সংক্রমণের ঘটনা ঘটতে বেশি দেখা গিয়েছে। কারণ, বাদুরও গাছে ওঠে।'
কারা এই ভাইরাস বহন করে?
যে প্রাণীরা এই ভাইরাস বহন করে, সেগুলো হল ফল বাদুড় বা ফ্লাইং ফক্স। তাদের থেকে সংক্রমণ ছড়ায় শূকর, কুকুর, বিড়াল, ছাগল, ঘোড়া এবং ভেড়ার মত প্রাণীতে। মানুষ মূলত এই প্রাণীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে বা এই সংক্রমিত প্রাণীর লালা বা প্রস্রাব দ্বারা দূষিত খাবার খাওয়ার মাধ্যমে সংক্রমণের শিকার হয়। আবার, মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ সম্ভব বলে মনে করা হয়। সিডিসি বলেছে, 'বাংলাদেশ এবং ভারতে নিয়মিতভাবে নিপা (NiV) ভাইরাস আক্রান্ত থেকে অপর ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর খবর পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণত এই ভাইরাস সংক্রমিত রোগীদের পরিবার এবং পরিচর্যাকারীরাই আক্রান্ত হন।'
কবে থেকে জানা গেল?
যেহেতু এটি ১৯৯৮-৯৯ সালে প্রথম শনাক্ত হয়েছিল, নিপা ভাইরাসের একাধিক প্রাদুর্ভাব ঘটেছে, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়। বাংলাদেশে আবার, ২০০১ সাল থেকে অন্তত ১০টি নিপা সংক্রমণের খোঁজ মিলেছে। তবে, পরীক্ষা হয়নি, অথচ এই ভাইরাসের প্রভাবে মৃত্যু ঘটেছে, এমন ঘটনাও ঘটে থাকতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০১ এবং ২০০৭ সালেও নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গিয়েছিল। কেরলে অবশ্য, ২০১৮ সালে কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারপর ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে নিপা সংক্রমণের অভিযোগ উঠেছিল। তবে, পরীক্ষা করার পর আদৌ সেগুলো নিপা ভাইরাস কি না, তা জানায়নি প্রশাসন।
নিপা কতটা ক্ষতিকর?
যাইহোক, এর প্রাণঘাতী ক্ষমতাই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। ২০০১ সালে বাংলার শিলিগুড়িতে প্রথম প্রাদুর্ভাবের সময়, সংক্রামিত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া ৬৬ জনের মধ্যে ৪৫ জনেরই মৃত্যু হয়েছিল। তখন মৃত্যুর হার ছিল ৬৮%। পরবর্তী প্রাদুর্ভাবে, পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় ২০০৭ সালে পাঁচ জন সংক্রামিতর প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছিল। ২০১৮ সালে কেরলে ১৭ সংক্রামিত ব্যক্তির প্রত্যেকেই মারা গিয়েছেন।
দ্রুত ছড়ায় না
বিশেষজ্ঞদের মত, আশার কথা একটাই যে নিপা ভাইরাস করোনার (SARS-CoV-2) চেয়ে অনেক ধীরে ছড়ায়। ১৯৯৯ সালে মালয়েশিয়ায় প্রাদুর্ভাবে, মোট ২৬৫ জনের সংক্রমণ ঘটেছিল বলে খবর পাওয়া গিয়েছিল। যাঁদের মধ্যে ১০৫ জন মারা গিয়েছিলেন। কোচিন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষকদের দ্বারা ২০০২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র 'নিপাহ ভাইরাস: অতীত প্রাদুর্ভাব এবং ভবিষ্যৎ কন্টেনমেন্ট' অনুসারে নিপা ভাইরাস এতদিন শুধু স্থানীয়ভাবেই ছড়িয়েছে। দ্রুতহারে ছড়িয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে প্রভাব ফেলেনি। যার কারণ হিসেবে গবেষকরা মনে করছেন, এই ভাইরাস অত্যন্ত সংক্রামক নয়।
আরও পড়ুন- ফের নিপা ভাইরাসের দাপট, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা, কোন পথে মোকাবিলা?
গবেষকদের বক্তব্য
২০২১ সালে প্রকাশিত নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি গবেষক পি দেবনাথ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএমএ এ মাসুদের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে নিপা ভাইরাসের পূর্ববর্তী প্রাদুর্ভাবের মধ্যে প্রজনন সংখ্যা (R0) ছিল প্রায় ০.৪৮। যা হল, জনগণের মধ্যে ভাইরাসটি কত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তার একটি পরিমাপ। একের চেয়ে কম মান মানে একজনের কম লোক ইতিমধ্যেই সংক্রমিত ব্যক্তি দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে, প্রাদুর্ভাব দ্রুত হ্রাস পাবে বলেই আশা করা হয়। উপরন্তু, প্রাদুর্ভাব কম হওয়ায় মৃত্যুও কম ঘটবে। এটাই এখন বিজ্ঞানীদের কাছে সবচেয়ে আশার কথা।