ছড়াচ্ছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। কিন্তু তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বহু দেশই তুলে নিয়েছে বিধি-নিষেধ। করোনার কোপে হাঁপিয়ে-ওঠা মানুষের কাছে যা বয়ে এনেছে বসন্তের বাতাস। কিন্তু এতে হু নিদারুণ উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন হু-র হেলথ ইমারজেন্সিস প্রোগ্রাম হেড মাইকেল রায়ান। তিনি বলেছেন, 'কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে ফসল ঘরে তোলা হয়েছে, তা যেন নষ্ট না হয়ে যায়, তাই সমস্ত দেশের সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ বিধি-নিষেধের মুঠো ঢিলে করবেন না।'
সাংবাদিক বৈঠকে তাঁর যেন আর্তনাদ, 'মহামারি এখনও শেষ হয়ে যায়নি…।' টেনে এনেছেন সদ্য পুরানো সেই দিনের কথা। 'গত গ্রীষ্মে যখন আমরা ভাবলাম-- করোনা ইজ ওভার, আমরা সব রেস্ট্রিকশন থেকে বেরিয়ে এলাম। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেই কিন্তু সমস্যার নতুন সূচনা হয়ে গেল। এবার আবার সেই পরিস্থিতি। সবাই বিধি-নিষেধের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু ডেল্টা বেশি সংক্রামক। সতর্কতার কোনও খামতি চলবে না।'
মার্কিন মুলুক এবং ব্রিটেনে নজর
ইংল্যান্ড আপাতত কোভিডের সব নিয়ন্ত্রণ তুলে নিচ্ছে। এমনকী মাস্ক পরা সামাজিক দূরত্ব মানা ইত্যাদির মতো প্রাথমিক নিয়মেও তাদের সিগন্যাল রেড। সোমবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একটি সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, 'মানুষকে করোনার সঙ্গে বাঁচা শিখতে হবে। নিজেদের মতামত অনুযায়ী চলতে হবে।' জনসনের এই জুনুন হু-কে অথৈ জলে ফেলে দিয়েছে।
কারণ ব্রিটেনে কোভিড বাড়ছে। বুধবার ইংল্যান্ডে কোভিডের নতুন সংক্রমিতের সংখ্যা ৩২, ৫৪৮। জানুয়ারির পরে এই প্রথম পেরোল ৩০ হাজার। 'পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড' বলছে, সে দেশে করোনা সংক্রমণের ৯০ শতাংশই ডেল্টা। এবং মার্কিন মুলুকেও চলছে এই প
প্রজাতির ঢেউ। নতুন করে সে দেশে যাঁরা করোনা সংক্রমিত হয়েছেন, তাঁদের ৫১. ৭ শতাংশ ডেল্টা কেস। আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি বলছে, এই ভ্যারিয়েন্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী।
আরও পড়ুন, করোনার ল্যাম্বডা প্রজাতির ভয় কতটা, কী ভাবে হামলা করতে পারে এই ভ্যারিয়েন্ট?
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মার্কিন স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে, তাঁর ভাষণে বলেছেন, 'কোভিড মহামারির বিরুদ্ধে আমেরিকা বিজয়ের মুখে দাঁড়িয়ে।' (আহা আনন্দ আর ধরে না!) তার পরেই ডেল্টার এই দাপাদাপির খবর বাইডেনের বিরাট বিরক্তির কারণ হবে বৈকি!
অনেকে বাইডেনের সঙ্গে ট্রাম্পের মিল খুঁজতে শুরু করে দিয়েছেন এর পরে। ট্রাম্প যে ভাবে করোনাভাইরাসকে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, তার ফল হাড়েমজ্জায় ভুগতে হয় আমেরিকাবাসীকে। আর বাইডেন মহামারি থেকে স্বাধীনতার এই ঘোষণা যখন করছেন, তখনও সে দেশ ভ্যাকসিনের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে। তথ্য বলছে, মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছেন। কোনও কোনও এলাকায় ভ্যাকসিনে বৈষম্যও চোখে ঝিলমিল লাগিয়েছে। এখন দেশকে করোনা-স্বাধীন বলা মানে মূর্খের স্বর্গে চড়া, আর দেশের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া মানে 'এসো ষাঁড় আমাকে হামলা করো' বলা। যদিও আমেরিকানদের অনেকে উদ্বাহু নৃত্য শুরু করছেন-- করোনা-স্বাধীন বলে কথা!
হু লাগাতার বলে যাচ্ছে-- ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে, মাস্ক নিয়ে মামার বাড়ির আবদার চলবে না। কিন্তু তারা সে কথায় কান দিতে নারাজ। আর করোনা নিয়ে কী পদক্ষেপ করা উচিত, তা আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে পিঠ পুড়লেও ফিরে শুচ্ছে হোয়াইট হাউস।
ডেল্টা ভাইরাসে ভয় কীসের?
ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ে ডেল্টা ঝোড়ো ব্যাটিং করেছে এবং ৯৮টি দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। ২০-র অক্টোবর ডেল্টার প্রথম দেখা মেলে এ দেশে। ফিজি, বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, ভিয়েতনাম, রাশিয়া এবং অবশ্যই (একটু আগেই সবিস্তারে বলেছি) আমেরিকা এবং ব্রিটেনে ভাইরাস এখন খতরনাক। এই প্রজাতি যে সবচেয়ে সংক্রামক সন্দেহ নেই এক সুতোও। হু বলছে, আলফা প্রজাতির চেয়ে এটি ৫০ শতাংশ বেশি ছড়িয়ে পড়ার শক্তি রাখে। উহান প্রজাতির চেয়ে আলফা সংক্রামক ৫০ শতাংশ বেশি। মানে হল, কাউকে যদি ডেল্টা ধরে, তাহলে তিনি ৫ কিংবা তার বেশি মানুষকে সংক্রমিত করতে পারেন। মূল ভাইরাসটি এ ক্ষেত্রে দু'জন কিংবা তিন জনকে সংক্রমিত করতে পারত। ফলে উদাসীন হলেই হলেই কুচ করে মুন্ডুটা ঘাড় থেকে নেমে যেতে পারে। জ্বর থেকে একেবারে জড় পদার্থ, একটা গ্রিক বর্ণের কী ক্ষমতা, না? ডেল্টায় নাজেহাল হয়ে সবাই অবশ্য নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে না। ইউরোপের কোথাও কোথাও লকডাউন নতুন করে বলবৎ করা হয়েছে (কিন্তু কবে হুঁশ ফিরবে বরিস জনসন, বাইডেনদের তা কেউ জানে না।) আর অস্ট্রেলিয়া ডেল্টা ঘোড়ার গলায় লাগাম পরিয়েছে। সে দেশে ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষকে (মোট জনসংখ্যার যা প্রায় ৭০ শতাংশ) বিধি-নিষেধের কঠোর ঘেরাটোপে এনে এই অসাধ্য সাধন করেছে তারা। তবে ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া দেরিতে শুরু করার ফলেই এই প্রজাতি সে দেশে এ ভাবে লাগামছাড়া হয়ে উঠেছিল, বলছেন অনেকেই।
ডেল্টার বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর?
হু-র চিফ সায়েনটিস্ট সৌম্যা স্বামীনাথন একটি সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছেন, ডেল্টায় মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তির হাত থেকে আপনাকে বাঁচাবে ফুল কোর্স ভ্যাকসিন। তাঁর কথায়: 'এখনও পর্যন্ত এমন কোনও ভ্যাকসিন নেই, যা রোগের হাত থেকে ১০০ শতাংশ রক্ষা করতে পারে। যদি আপনার ভ্যাকসিন নেওয়া থাকে এবং যদি করোনায় আক্রান্ত হয়ে যান, তাহলে উপসর্গ সামান্য হতে পারে বা উপসর্গহীন থাকতে পারেন। সংক্রমণ মারাত্মক হওয়ার সম্ভাবনা সত্যি খুবই কম।' এই জন্যেই হু বিভিন্ন দেশকে সতর্ক করে চলেছে এবং ভ্যাকসিনের কথা পাখি পড়ানোর মতো বলে চলেছে। বিশেষ করে যে সব দেশে টিকাকরণের হার খুবই কম, তাদের নিয়ে হু-র চিন্তার কোনও শেষ নেই। হু বলছে, 'আবার নিশ্চয়ই আপনারা চাইবেন না হাসপাতালগুলো ভরে উঠুক রোগীতে।' সত্যি সদ্য-শুকনো ঘায়ের দিকে তাকিয়ে আমরা আতঙ্কের শিহরণ অনুভব করছি বৈকি! 'আমি সমস্ত দেশের নেতাদের কাছে আবেদন করছি, আগামী বছর এই সময়ের মধ্যে সব দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের টিকাকরণের যৌথ সংকল্প করুন।' বলছেন হু-র ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসাস। তাঁর কথায় পুরনো সত্যিটাই নতুন করে স্পষ্ট-- ভ্যাকসিনই করোনাকে সিন থেকে সরানোর সবচেয়ে সহজ উপায়।
প্রতিষেধকে ডেল্টার তালটা কাটুক। হুঁশ ফিরুক হুঁশ ফিরুক। করোনার রোখার রিংটোন আপাতত এটাই।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন