কোভিড অতিমারীর সময়ে মাস্কের ব্যবহার নিয়ে প্রাথমিকভাবে বিতর্ক থাকলেও এর ব্যবহার এখন সর্বত্র গৃহীত হয়েছে। অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক মতামতে বলা হচ্ছে, এমনকী বাড়িতে তৈরি অপেক্ষাকৃত সহজ মাস্কও করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে পারে। গত কয়েকদিনে বেশ কিছু নতুন গবেষণায় এর প্রমাণ ফের পাওয়া গিয়েছে। এই গবেষণাগুলিতে বলা হয়েছে যদি জনগণের বড় অংশ মাস্ক ব্যবহার করেন তাহলে রোগ ছড়ানো বেশ ভালভাবেই আটকানো সম্ভব।
মাস্কের গুণগত প্রভাব
আরিজোনা, হারভার্ড ও সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এক গবেষণায় নিউইয়র্কের জনসংখ্যার উপর একটি গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে দেখেছেন, ৭০ শতাংশ মানুষ যদি কার্যকর প্রফেশনাল মাস্ক পরে বাইরে বেরোতেন তাহলে এ শহর থেকে অতিমারী দূর হয়ে যেত। গোটা আমেরিকায় যদি ৮০ শতাংশ মানুষ মাস্ক পরতেন, তাহলেও একই ফল পেত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এমনকি নিম্নমানের বাড়িতে তৈরি মাস্কও রোগ ছড়ানো প্রতিরোধ করতে অতীব সাহায্যকারী হতে পারত, যদিও সে ক্ষেত্রে আরও কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন হত বলে ওই গবেষণায় বলা হচ্ছে। গবেষকরা জানিয়েছেন, “জনসমক্ষে মুখোশ (এমনকি কম শ্রমতাসম্পন্ন কাপড়ের মুখোশও) ব্যবহার করলে গোষ্ঠী সংক্রমণ কমে এবং কোভিড-১৯-এর চাপকেও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তবে সেক্ষেত্রে মাস্কের আচ্ছাদন মাত্রা বেশি হতে হবে। মাস্কের আচ্ছাদন কোভিড-১৯ কমানোর জন্য প্রয়োজন, তবে এরই সঙ্গে মানতে হবে সামাজিক দূরত্ব বিধিও।”
ওই গবেষণায় দেখানো হয়েছে নিউ ইয়র্কে আগামী দু মাসে ৪৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হবে বলে যে অনুমান করা হচ্ছে, তা আটকানো সম্ভব হত যদি ৮০শতাংশ মানুষ কোনও না কোনও ধরনের মাস্ক পরতেন।
আরও পড়ুন, কোভিড ১৯ ভ্যাকসিন- করোনাভাইরাস থেকে মুক্তির সন্ধানপ্রক্রিয়া
“আরও ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগবে যতক্ষণ না গণ ভ্যাকসিন বা গোষ্ঠী প্রতিরোধের বিষয়টি বাস্তবিক হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে আমাদের মাস্ক সম্পর্কে ধারণা বদলাতে হবে এবং এখনই নতুন ফেস অ্যাকসেসরি হিসেবে তা গ্রহণ করে নিতে হবে” বলে মনে করেন ইন্ডিয়ান চেস্ট সোসাইটির ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা মহামারী প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ও মহারাষ্ট্র সরকারের একাধিক কমিটিতে নিযুক্ত থাকা সন্দীপ সালভি।
ডক্টর সালভি বলেন “এমনকী বাড়িতে তৈরি মাস্কও কার্যকর হতে পারে, যদি সকলে তা ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, আমরা এখন এমন একটা সমাধান পেয়েছি যা সহজ, হাতের কাছে রয়েছে, বাড়িতে বানানো সম্ভব, শস্তা, এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য। তবে মাস্ক পরতে হবে ঠিকভাবে, টাইট ফিটিং হতে হবে এবং যখনই বাইরে যাচ্ছেন তখনই পরতে হবে, নাহলে তা সুরক্ষাদায়ী হয়ে উঠবে না।”
বেশি মাস্ক, কম লক ডাউন
আরেকটি গবেষণা, যা কার্যত একটি বৈজ্ঞানিক পত্রের পর্যালোচনা, সেখানে বলা হয়েছে রোগের গোষ্ঠী সংক্রমণ আটকাতে বাড়িতে তৈরি মাস্ক যথেষ্ট কার্যকর হতে পারে, যদিও পেশাদার সার্জিকাল মাস্ক যে পরিমাণ সংক্রমণ বা ক্ষুদ্রতর কণা আটকাতে সক্ষম, তার এক তৃতীয়াংশ কার্যকর।
আরও পড়ুন, সার্স মহামারীর থেকে শিখেছিল পূর্ব এশিয়া; করোনার থেকে কী শিখবে ভারত?
এখানে বলা হয়েছে, জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ যদি মাস্ক ব্যবহার করেন তাহলে লকডাউন সময়কালও কমে যাবে। গবেষণার মুখ্য রচয়িতা জেরেমি হাওয়ার্ড এক ইমেলের উত্তরে লিখেছেন, “ব্যাপক পরিমাণ টেস্টিং, কনট্যাক্ট ট্রেসিং, সংক্রমণ হতে পারে এমন যে কাউকে কোয়ারান্টিনে রাখা, হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক ব্যবহার গোষ্ঠী সংক্রমণ আটকানোর ব্যপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে।”
তবে তিনি এও বলেছেন মাস্ক ব্যবহার করে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে ভুললে চলবে না। হাওয়ার্ড বলেছেন, “আমরা ঠিক জানি না মাস্কের জন্য ঝুঁকি কতটা কমে। যাঁদের উপসর্গ রয়েছে তাঁদের বাড়িতে থাকা জরুরি, কারণ কাশার সময়ে বা কথা বলার সময়ে মাস্ক কাজ করে না। সাধারণ ভাবে যত দুরে থাকবেন তত নিরাপদ থাকবেন, এবং মাস্ক থাকলে আপনি নিরাপদতর থাকবেন।”
তিনি বলেন, “আমার আশা, মাস্ক সকলে পরে লকডাউন পর্যায় কমবে। তিনি সাবধান করে দিয়েছেন যে মানুষ যদি মাস্ক পরা বন্ধ করে দেয় তাহলে শীতকালে দ্বিতীয় ওয়েভের সময় ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে।” হারভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের হৃদরোগের অধ্যাপক ডক্টর জগমিত সিং বলেছেন মাস্কের কার্যকারিতা হল যে তা উভয়পাক্ষিক সুরক্ষা প্রদান করে। “লোকে যখন বাড়ির বাইরে বেরোন, তখন তাঁদের মনে করতে হবে যে অন্যরা সম্ভাব্য সংক্রমিত, এবং তাঁদের থেকে তিনি সংক্রমিত হতে পারেন। যদি তাঁরা মাস্ক পরেন, তাহলে দ্বিপাক্ষিক সুরক্ষা হয়। তাঁরা অন্যদের সম্ভাব্য সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করেন এবং নিজেদেরও সুরক্ষিত রাখেন।”
আরও পড়ুন, নর্দমার জল থেকে করোনা সংক্রমণের আশঙ্কার কথা বলছেন গবেষকরা
ড্রপলেটের হাত থেকে বাঁচা
আরেকটি গবেষণায় ভারতের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা দেখিয়েছেন মাস্ক পরা অবস্থায় হাঁচল, কাশলে বা জোরে কথা বললে ভাইরাস বাতাসে ছড়ায় না।
“মাস্ক ছাড়া হাঁচি বা কাশির সময়ে বড় আকারের ড্রপলেট বেরোয়। ১২৫ মাইক্রনের বেশি ব্যাসার্ধের ড্রপলেট দু মিটার দূরের মাটিতে গিয়ে পড়ে যা ছোট আকারের ড্রপলেট হিসেবে ৫ মিটার দূরে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
গবেষণায় বলা হয়েছে, সাধারণ সুতির মাস্ক আলগা করে পরা থাকলেও তীব্র গতির ড্রপলেট মাস্কে আটকে যায়।
আইআইটি বম্বের গুরুস্বামী কুমারস্বামী, Pfizer-এর পঙ্কজ দোশি এবং প্রেম আন্দ্রাদে ও পুনের অ্যানসিস সফটওয়ারের তাঁর সহকর্মীরা এই গবেষণা করেছেন।গবেষণায় বলা হয়েছে বড়আকারের ড্রপলেট মাস্কে আটকে যায়, ছোট আকারের ড্রপলেট অনেক কম দূরত্ব, ৩০ সেন্টিমিটারেরও কম দূরত্ব পর্যন্ত যায়, যা মাস্ক না থাকলে ২ মিটার পর্যন্ত দূরে যেতে পারে।
মাস্ক ছাড়া কোনও ব্যক্তি যদি হাঁচেন তাহলে নিঃসরণের মধ্যেকার সম্ভাব্য ভাইরাল লোডের ৩৭ শতাংশ ওই ব্যক্তির দু মিটারের মধ্যে মাটিতে পড়ে, বাকি ৬৩ শতাংশ ওই ব্যক্তির ২ থেকে ৫ মিটারের মধ্যে বাতাসে মিলিয়ে যায়। তবে মাস্ক পরা থাকলে ৭০ শতাংশ ভাইরাস জনিত ড্রপলেট মাস্কে আটকে যায়, অবশিষ্টাংশ সম্ভাব্য ভাইরাসকে দে়ড় মিটারের মধ্যে আটকে রাখে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, ভাইরাস কণা ওই ব্যক্তির দেড় মিটারের মধ্যে আবদ্ধ থাকে, কিন্তু বাকি অংশের ক্ষমতা তারপর কমে যায়। উপসংহারে বলা হয়েছে সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা সাধারণ সুতির মাস্ক পরলে এবং দু মিটারের শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলে অনেকটাই কমে যায়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন