করোনা আবহের মধ্যেই আফগানিস্তানে তৈরি হল নয়া আশঙ্কার মেঘ। চলতি বছরের ২৫ মার্চ কাবুলের গুরুদ্বারে ২৫ জন শিখের দেহ আইএস জঙ্গির গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়ার পরই জীবন-মৃত্যুর ভয় গ্রাস করে আফগানিস্তানে অবস্থিত শিখ এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে। সে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হয়েও সুরক্ষার ফাঁসে যে তাঁরা নেই, বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাঁদের। অগত্যা ভরসাস্থল একটাই। নিজভূম ভারত। ইতিহাস বলছে একসময়ের হিন্দুস্তান ছিল আফগানিস্তান। কিন্তু সন্ত্রাসের কোপে পড়া এই দুই সম্প্রদায় চাইছে 'সেই হিন্দুস্তান' থেকে অবিলম্বে তাঁদের ফিরিয়ে আনা হোক ভারতে।
আফগানিস্তানে হিন্দুত্ববাদ পৌঁছেছিল কবে?
ইতিহাসবিদ ইন্দরজিৎ সিংয়ের লেখা বই 'আফগান হিন্দু অ্যান্ড শিখস: অ্যা হিস্ট্রি অফ থাউজেন্ড ইয়ার্স' থেকে জানা যায় একসময় পূর্ব আফগানিস্তান, এমনকী কাবুলেও আধিপত্য ছিল হিন্দুদেরই। লেখকের কথায়, "সাতের দশকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে ইসলাম। প্রধানত জুনবিল বংশ, যারা প্রথম দিকে হিন্দু ছিল বলে মনে করা হত তাঁরাই আফগানিস্তানের কান্দারের গজনি প্রদেশ শাসন করেছে ৬০০ থেকে ৭৮০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে। এরপর হিন্দু শাহী সাম্রাজ্যে ক্ষমতায় আসে। ১০-এর শতাব্দীতে গজনাবীররা শাহী সাম্রাজ্য সরিয়ে সেই জায়গার ক্ষমতা দখল করে । তবে তাঁরাও হিন্দু ধর্মকে ব্যবহার করেই ক্ষমতায় আসে।"
আরও পড়ুন, মাস্কেই আটকাচ্ছে করোনা সংক্রমণ, মিলল হাতেনাতে প্রমাণ
ইতিহাসবিদ জানান যে, "এরপর ১৫০৪ সালে কাবুল দখল করেন মুঘল সম্রাট বাবর। কাবুলকে বাবর চিরকাল হিন্দুস্তানের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছেন এবং ১৭৩৮ সাল পর্যন্ত কাবুল হিন্দুস্তানের অংশ ছিল।"
শিখ ধর্মের প্রবেশ কবে হয়েছিল আফগানদের দেশে?
ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে আফগানিস্তানে যান শিখগুরু গুরু নানক। কাবুল, কান্দাহার, জালালাবাদ এবং সুলতানপুর এলাকা ঘুরে ঘুরে ধর্মের সারতত্ত্ব প্রচার করেন তিনি। সেই সময় থেকেই শিখ ধর্মের প্রবেশ ঘটে মধ্য প্রাচ্যের এই দেশে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, সেই জায়গাগুলিতে এখন গুরুদ্বার স্থাপন করেছেন শিখ সম্প্রদায়েরা। এখনও কাবুলের শিখ সম্প্রদায়েরা পাঞ্জাবে আসেন গুরুনানকের পবিত্র স্থান দর্শনে।
ইতিহাসবিদ ইন্দরজিৎ তাঁর বইতে লিখেছেন, "আফগান সমাজে হিন্দু এবং শিখদের স্থান কোথায় তা নিয়ে বহু তথ্য রয়েছে। এদের মধ্যে ৯৯ শতাংশ সে দেশ ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি দিয়েছেন। যদিও আফগান সরকার কিন্তু এই বিষয়টিকে স্বীকার করে না। একজন আফগান কি হিন্দু বা শিখ হতে পারে না? সরকার বলছে না! পারে না। কিন্তু ইতিহাস বলছে পারে।"
আরও পড়ুন, ইরানকে সরিয়ে কেন আরবের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা উচিত ভারতের?
আফগান রাজ্যে কবে থেকে এই হিন্দু-শিখ 'বিতারণ পর্ব' চলছে?
সমস্ত তথ্য, ইতিহাস, নথি থেকে জানা যাচ্ছে ১৯৭০ সাল থেকেই শুরু হয়েছে এই ধর্মসঙ্কট। পরিসংখ্যানের বিচারে সেই সময় শিখ এবং হিন্দু সম্প্রদায় মিলে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ (৬০:৪০) থাকতেন আফগানিস্তানে। সমস্যা প্রকাশ্যে এল ১৯৮৮ সালে। বৈশাখী অনুষ্ঠানে জালালাবাদের গুরুদ্বারে একে-৪৭ এর গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয় ১৩ জন শিখের দেহ। ১৯৮৯ সালে ওই গুরুদ্বারের গুরু তেগ বাহাদুরকে হত্যা করে মুজাহিদ্দিনের লোকেরা। ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে আরও ১৭ জন শিখের খুনে রক্তাক্ত হয় জালালাবাদ। ১৯৯২ সাল থেকে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে মুজাহিদ্দিন। এরপর থেকে শুরু হয় হয় অত্যাচার। হয় মৃত্যুবরণ নয় দেশ ছেড়ে পালানো, দুই পথ বেছে নিতে বাধ্য হয় হিন্দু-শিখ সম্প্রদায়।
এই মুহুর্তে কতজন হিন্দু-শিখ রয়েছেন আফগানিস্তানে?
নথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে সংখ্যাটি ৭০০-এর বেশি নয়। যদিও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে শিখদের সংখ্যাই বেশি। ৬৫০ জন শিখ সম্প্রদায় এবং ৫০ জন হিন্দু অবশিষ্ট রয়েছে আফগান প্রদেশে। ১৯৭০ সালে যে সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ, আজ সেই সংখ্যার অধোগতি দেখাচ্ছে সমস্যার বৃহত্তর ক্ষেত্রটিকে। কাবুল গুরুদ্বারের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য বলেন, "২০১৮ সালে আমাদের উপর যে হামলা হয়েছিল তারপরও সকলে জীবন-মরণ বাজি রেখেই ব্যবসা-দোকান চালাচ্ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চের হামলা সেই প্রতিজ্ঞাকে রক্ত ছুঁড়ে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। এখন আর সাহস পাচ্ছি না থাকতে। আমাদের মনে হয় এর থেকে ভারতে গিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়া অনেক সহজ হবে।"
কিন্তু ভারতের নয়া নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কী আদপেই তাঁদের সুবিধা দেবে?
২০১৯ সালে নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি ভারতে। তবে বিরোধ সত্ত্বেও লাগু হয়েছে আইন। নিয়ামানুসারে এবার থেকে ১১ বছর নয়, আফগানিস্তান থেকে শিখ এবং হিন্দুরা ভারতে ৫ বছর টানা থাকলেই তাঁদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত সরকার। যদিও এই আইনের উপর এখনও কাজ করে চলেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। তাই যেমন বলা তেমন কাজ কতটা ফলপ্রসু হবে সে বিষয়ে কিছুটা প্রশ্ন চিহ্ন রাখছে ওয়াকিবহাল মহল।
Read the full story in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন