মঙ্গলবার সংবাদসংস্থা রয়টার্সের দুই সাংবাদিক উ ওয়া লোন (৩৩) এবং উ কাওয়া সো উ (২৯) ইয়াঙ্গনের কাছে এক জেল থেকে ছাড়া পেলেন। মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট তাঁদের ক্ষমা করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। নববর্ষের সময়ে এ ধরনের ক্ষমা প্রদর্শনের ঐতিহ্য রয়েছে মায়ানমারে।
কেন জেলে গিয়েছিলেন এই সাংবাদিকরা?
গ্রেফতার ও বিচার
২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর ওয়া লোন এবং কাওয়া সো উ-কে এক পুলিশ অফিসার ইয়াঙ্গনের এক রেস্তোরাঁয়া ডেকে পাঠান। বৈঠকের পর দুই সাংবাদিক যখন চলে যাচ্ছেন, তখন ওই পুলিশ অফিসার দুই সাংবাদিকের হাতে জোর করে দুটি গোটানো কাগজ গুঁজে দেন। রেস্তোরাঁ থেকে বেরোনো মাত্র দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করে পুলিশ, তাঁদের হাত থেকে কাগজ দুটি নিয়ে নেওয়া হয়। সে কাগজে কী ছিল তা ওই সাংবাদিকরা দেখেনওনি।
পরের দিন মায়ানমার সরকারের তরফ থেকে বলা হয় ওই দুই সাংবাদিক সে দেশের সরকারি গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘন করেছেন। এই আইন স্বাধীনতাপূর্ব ভারতে ১৯২৩ সালে লাগু করেছিল ব্রিটিশরা। এরপর সপ্তাহের পর সপ্তাহ এবং মাসের পর মাস ধরে রাষ্ট্র সংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, মায়ানমারের সাংবাদিক এবং বহু সংখ্যক নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দাবিকে উপেক্ষা করে ওই সাংবাদিকদের আটক করেই রাখা হয়।
বিচারক উ ইয়ে লুইনের আদালতে এক পুলিশ অফিসার সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, পুলিশ প্রধান নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই সাংবাদিকদের হাতে যেন গোপন নথি ধরিয়ে দেওয়া হয়, যার ভিত্তিতে ওই দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যাবে।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে আদালত গোপনীয়তা আইন লঙ্ঘনের দায়ে ওই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে। ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আদালত রায় দেয়, ওই দুই সাংবাদিক সাধারণ সাংবাদিকসুলভ কাজকর্ম করছিলেন না। ওঁদের কাছে অত্যন্ত গোপন নথি ছিল যা দেশের শত্রুদের কাজে লাগতে পারে। দুই সাংবাদিককে সাত বছরের জন্য় জেলে পাঠানো হয়।
১১ জানুয়ারি ইয়াঙ্গনের হাইকোর্ট এই শাস্তি বহাল রাখে। ২৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট ওই সাংবাদিকদের চূড়ান্ত আবেদন খারিজ করে দেয়।
মঙ্গলবার যখন সাংবাদিকরা মুক্ত হলেন, ততদিনে তাঁরা গরাদের পিছনে ৫০০ দিন কাটিয়ে ফেলেছেন।
সাংবাদিকদের বয়ান
ওয়া লোন ওবং কাওয়া সো উ যখন গ্রেফতার হন, সে সময়ে তাঁরা মায়ানমার সেনাবাহিনী ও রাখাইন এলাকার ইন ডিন গ্ররামের বৌদ্ধদের হাতে ঠান্ডা মাথায় খুন হওয়া ১০ রোহিঙ্গা মুসলিমের হত্যা সম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহ করছিলেন।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রয়টার্সে 'মায়ানমারে ম্যাসাকার' শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে প্রতিবেদক হিসেবে নাম ছিল ওই দুই সাংবাদিকের। তাঁরা ততদিনে জেলে। সে প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল ১০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমের মধ্যে দুজনকে কুপিয়ে খুন করে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা এবং বাকিদের গুলি করে মারে সেনাবাহিনী।
রয়টার্সের ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, "এই হত্যাকাণ্ড উত্তর রাখাইনের জাতিহিংসার আরেকটি রক্তাক্ত এপিসোড। (২০১৭ সালের) অগাস্ট থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬,৯০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলিম নিজেদের গ্রাম থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করেছেন। অক্টোবর মাসে ইন ডিনের ৬০০০ রোহিঙ্গা মুসলিমের একজনও নিজের গ্রামে নেই।"
এই প্রতিবেদনের সঙ্গেই প্রকাশিত হয়েছিল ১০ জনের ছবি, যারা হাঁটু মুড়ে মৃত্যুর অপেক্ষায় বসে রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ছিল ১৭ ও ১৮ বছর বয়সী দুই হাই স্কুল ছাত্রের ছবিও।
এই প্রথম রাখাইনের এথনিক ক্লেনজিংয়ের কোনও প্রতিবেদন প্রকাশিত হল, যাতে ছিল রোহিঙ্গাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, মুসলিমদের হত্যা করে তাদের কবর দিয়ে দেওয়া নিয়ে বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের স্বীকারোক্তি, ছিল মায়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক নিযুক্ত সে দেশের আধা সেনার অপরাধে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি ও সে সম্পর্কিত বিবরণ।
"৫৩ মিলিয়ন বৌদ্ধের দেশ থেকে তাদের মুছে ফেলার জন্য সেনাবাহিনী তাদের মারধর করছে, ধর্ষণ করছে এবং হত্যা করছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা, সে কথাও লেখা হয়েছিল ওই প্রতিবেদনে। রাষ্ট্র সংঘ বলেছে সেনাবাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তুলেছে এথনিক ক্লেনজিংয়ের। মায়ানমারের বক্তব্য, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের আক্রমণের যথাযথ প্রত্যুত্তর দিতে এ তাদের সাফাই অভিযান।"
২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে ওয়া লোন এবং কাওয়া সো উ-কে রয়টার্সের অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে তদন্তমূলক সাংবাদিকতার জন্য পুলিৎজার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
Read the Story in English