নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) নিয়ে উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি ফুটছে। কিন্তু এনআরসির মাধ্যমে বিদেশি অভিবাসী চিহ্নিত করার জন্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারকে যে কড়া চৌকাঠ পেরোতে হবে, তার নাম পশ্চিমবঙ্গ।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। সে কথা মাথায় রেখেই সোমবার লোকসভায় এ বিল নিয়ে কথা বলবার জন্য রাজ্যের পাঁচজন সাংসদের উপর দায়িত্ব দিয়েছিল বিজেপি। এঁরা হলেন, বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, মহিলা মোর্চার প্রধান লকেট চট্টোপাধ্যায়, দার্জিলিংয়ের সাংসদ রাজু বিস্ত, মতুয়া নেতা শান্তনু ঠাকুর এবং লোকসভা ভোটের ঠিক আগে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা সৌমিত্র খান। বিজেপির তরফ থেকে সোমবার সংসদে যাঁরা বলেছেন সেই পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, বিলের সপক্ষে আর কোনও রাজ্য থেকে এতজনকে বলতে দেওয়া হয়নি।
পড়ুন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (ক্যাব) কী?
পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটা বড় ইস্যু হয়ে ছিলেন ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তু মানুষ। সে ইস্যু ফের সামনে এসেছে। এর আগে কংগ্রেস ও তৃণমূল উভয়পক্ষই ভোটব্যাঙ্কের জন্য উদ্বাস্তুদের প্রশ্রয় দেবার অভিযোগ করে এসেছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম সরকারের বিরুদ্ধে। এখন পাশার দান উল্টে গিয়েছে। বিজেপি এখন একই অভিযোগ আনছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে।
সোমবার লোকসভায় ক্যাব পেশ করবার সময়ে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সাংসদদের উদ্দেশে বলেন, "এ বিতর্ক যাঁরা দেখছেন, তাঁদের অনেকেই আশা করছেন যে আপনারা ওঁদের নাগরিকত্ব সমর্থন করবেন।"
পড়ুন, কোথায় কোথায়, কেন লাগু হবে না ক্যাব?
ঘটনাক্রমে, ১ অক্টোবর অমিত শাহ কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এনআরসি তালিকাছুটদের সুরক্ষাকবচ হিসেবে প্রথমবার ক্যাবের উল্লেখ করেন। আসামের এনআরসি তালিকাছুটদের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যা মুসলিমদের চেয়ে বেশি, এ কথা জানবার পর রাজ্য বিজেপিতে যে শঙ্কার আবহ তৈরি হয়েছিল, তা দূর করতেই বাংলায় এসে অমিত শাহের এ হেন বরাভয়।
লোকসভায় অমিত শাহ আরও একটি বিষয়ে জোর দিয়েছেন। ভারতে যেসব শরণার্থীরা কর্মরত তাঁরাও ক্যাবের মাধ্যমে সুরক্ষাকবচ পাবেন বলেন উল্লেখ করেছেন তিনি। "বাংলা এবং উত্তরপূর্বের শরণার্থীদের কাছে একটা স্পষ্ট বার্তা পৌঁছন প্রয়োজন। আপনারা যেদিন ভারতে এসেছেন, সেদিন থেকেই আপনারা নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন।"
তৃণমূলের রাজ্যসভার চিফ হুইপ সুখেন্দু শেখর রায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, "পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু আগমন দীর্ঘদিনের একটি ইস্যু। সমস্যা হল, বাংলাদেশ তৈরি হয়েছে ভাষার ভিত্তিতে। যাঁরা ওপার থেকে এসেছেন, তাঁদের একটা বড় অংশ ধর্মীয় অত্যাচারের আশঙ্কায় নয়, এসেছেন উর্দুভাষীদের হাতে ভাষাগত অত্যাচারের আশঙ্কায়।"
পড়ুন, আমেরিকায় অমিত শাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে চায় কারা?
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আগে থেকেই এ বিষয়ে তৎপর হয়েছেন। তিনি বলেই দিয়েছেন রাজ্যে ক্যাব প্রযুক্ত হবে না। নাগরিকত্ব বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান। মমতারা বলেই দিয়েছেন, ক্যাবকে এনআরসি থেকে আলাদা করা যাবে না, কারণ ক্যাবের লক্ষ্য এনআরসিছুটদের রক্ষাকবচ দেওয়া।
মে মাসে বিজেপি ৪২টার মধ্যে এ রাজ্য থেকে ১৮টি লোকসভা আসনে জিতেছে। এ বারের লোকসভা নির্বাচনে তাদের মূল বক্তব্য ছিল অবৈধ অভিবাসীদের দেশ থেকে তাড়ানো। এই টার্গেট আসলে সীমান্তের ওপার থেকে আসা মুসলিমরা, যারা এখন তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক।
কিন্তু নভেম্বরে বিজেপি তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনেই হেরে গিয়েছে রাজ্যে। তার মধ্যে এমন আসনেও তৃণমূল জিতেছে, যেখানে আগে তারা কখনও জেতেনি। দুই দলই বলেছে, ভোটের এই ফল অমিত শাহের দেশব্যাপী এনআরসি লাগু করার প্রস্তাবের জের।
উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলি ছাড়া, কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই লোকসভা ভোটের সময়ে এনআরসি নিয়ে বাগবিতণ্ডা চরমে ওঠে। রায়গঞ্জে অমিত শাহ অনুপ্রবেশকারীদের "উইপোকা" বলে উল্লেখ করেন, মালদায় তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল "বাংলা তথা সারা দেশকে অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে রক্ষা" করা।
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে অমিত শাহ বলেছিলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তুকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। আমি আমার শরণার্থী ভাইদের আশ্বাস দিতে চাই... আমি সমস্ত হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, এবং খ্রিষ্টানদের আশ্বাস দিতে চাই যে আপনাদের ভারতছাড়া হতে হবে না। এনআরসি-র আগে আমরা নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল আনব, যার মাধ্যমে এই সব মানুষেরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। ওঁরা ভারতীয় নাগরিকদের সমস্ত অধিকার ভোগ করবেন।"
সোমবার লোকসভায় বিতর্কের জবাব দেবার সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, দেশ ব্যাপী এনআরসি তাঁদের লক্ষ্য। মাত্র এক বছর আগে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং লোকসভায় বলেছিলেন, "বর্তমানে আসাম ছাড়া দেশের অন্য কোনও জায়গায় এনআরসি চালু করবার কোনও প্রস্তাব নেই।"