Advertisment

চিনা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা কি ভারতের রফতানিকে চাপে ফেলবে?

সীমান্তে ইন্দো-চিন সংঘর্ষ। প্রাণ গিয়েছে ২০ ভারতীয় সেনাকর্মীর। তারপর থেকেই দেশজুড়ে প্রতিবেশী দেশের পণ্য বয়কটের ডাক উঠেছে দেশের অভ্যন্তরে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
china boycott

ভারত-চিন সংঘর্ষ, দেশের অন্দরে চিনা পণ্য বয়কটের দাবি।

সীমান্তে ইন্দো-চিন সংঘর্ষ। প্রাণ গিয়েছে ২০ ভারতীয় সেনাকর্মীর। তারপর থেকেই দেশজুড়ে প্রতিবেশী দেশের পণ্য বয়কটের ডাক উঠেছে দেশের অভ্যন্তরে। এতেই বিভিন্ন ভারতীয় শিল্প সংস্থার মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। চিনা পণ্য বয়কটের বিরূপ প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে রফতানিতেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

Advertisment

ওষুধ, টেলিযোগাযোগ এবং অটোমোবাইল ক্ষেত্রের শিল্পসংস্থাগুলো মনে করে, উপযুক্ত দেশীয় বিকল্প তৈরি না করে চিনা পণ্যের উপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ভারতীয় অর্থনীতি ও রফতানিতে আঘাত আনতে পারে।

চিনা আমদানির উপর ভারত কতটা নির্ভরশীল?

ভারতের আমদানীকৃত পণ্যসম্ভারের মধ্যে বৃহৎ অংশ দখল করে রেখেছে চিন। বিশেষ করে মধ্যবর্তী পণ্য বা উপাদান ও কাঁচামালের ক্ষেত্রে এই আধিপত্য। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম এবং যন্ত্রাংশ, পারমাণবিক চুল্লি, জৈব এবং অজৈব রাসায়নিক, সার, যানবাহন-যন্ত্রাংশ এবং আনুষাঙ্গিক পণ্যগুলির শীর্ষ রফতানিকারক দেশও চিন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে, ভারতের কাছে এই পণ্যগুলির দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশগুলির তুলনায় চিনের ‘অবদান’ অনেক বেশি।

ভারতের মোট ইলেকট্রনিক্স পণ্যের ৪৫ শতাংশই প্রতিবেশি দেশটি থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। সিআইআই-এর তথ্য অনুসারে, ভারত বিশ্ব থেকে যে পরিমাণ যন্ত্রাংশ ক্রয় করে থাকে তার এক তৃতীয়াংশ করা হয় চিন থেকে। জৈব রাসায়নিক ক্ষেত্রে এই পরিমাণ দুই পঞ্চমাংশ। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাংশ এবং সার সহ এমন অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলিতে ভারতের আমদানির ২৫ শতাংশের বেশি চিন থেকে আমদানিকৃত।

চিন থেকে আমদানিকৃত উপাদানের সহায়তায় বহু প্রস্তুতকারী এদেশে বসে পণ্য প্রস্তুত করে থাকেন। এইভাবেই ভারতের উৎপাদনকারী সরবরাহ ক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রয়েছে চিনা পণ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ভারতে প্রস্তুতকারী মোবাইলের ৯০ শতাংশ উপাদনই আসে চিন থেকে।

এমনকী রফতানি ক্ষেত্রেও ভারতের অন্যতম ভরসা চিন। পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে চিন ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম গন্তব্য। অঙ্কের হিসাবে এই পরিমান ১৫.৫ বিলিয়ান মার্কিন ডলার। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানেইজেশনের তথ্য অনুসারে, চিনে মোট রফতানির মাত্র দুই শতাংশ ভারতে হয়ে থাকে।

চিনা আমদানির উপর সার্বিক নিষেধাজ্ঞা ভারতীয় রফতানিকে কীভাবে আঘাত করতে পারে?

ওষুধ থেকে টেলি যোগাযোগ এবং অটোমোবাইল শিল্পের পক্ষ থেকে চিনা আমদানিতে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হয়েছে। ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানেইজেশনের সভাপতি শরদ কুমার সারফ ও ডিরেক্টর অজয় সহায় বলেছেন, চিনের উপর ভারত কাঁচামালের জন্য নির্ভরশীল। তাই 'সার্বিক নিষেধাজ্ঞা' সম্ভব হবে না।

সারফের কথায়, 'চিনের পণ্য দিয়ে এখানে বহু দ্রব্য গড়ে তোলা হয়। সার্বিক আমদানি নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সেগুলি তৈরিতে অসুবিধা হবে।' তাঁর সংযোজন, 'তারা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিলে আমাদের উপর তা আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।' এর ফলে সংকটে রয়েছে ইন্ডিয়া সেলুলার অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স অ্যাসোসিয়েশন এবং অটোমোটিভ কম্পোনেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতো বাণিজ্য ও শিল্প সংস্থাসমুহ।

সহায়য়ের কথায়, 'বিষয়টি কৌশলগত...মূলত চিনা কাঁচামাল ব্যবহারের ফলে ভারতীয় পণ্য রফতানি অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে থাকে।'

উদাহরণস্বরুপ বলা যায় যে, ওষুধ প্রস্তত করতে ভারত বিভিন্ন দেশ থেকে ৩.৬ বিলিয়ান মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে থাকে। যার মধ্যে ৬৮ শতাংশই চিনের। ভারত বিশ্বের ওষুধ শিল্পের অন্যতম বৃহৎ কেন্দ্র বলে বিবেচিত। ওষুধ ফরমুলেশনের ক্ষেত্রে ভারতকেও আমেরিকার মত উল্লেখযোগ্য অংশ বলে গণ্য করা হয়।

চিন থেকে আমদানিকৃত ওষুধের উপকরণে ভারতের বন্দরগুলিতে পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও নজরদারি বাড়ানো হলে দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্র ও রফতানি বাজারে ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

দিল্লির বৃহত্ ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা ম্যানকাইন্ড ফার্মার চেয়ারম্যান আর সি জুনেজার মতে, দেশে যে পরিমান ওযুধের যোগান রয়েছে তাতে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনও অসুবিধা হবে না। তাঁর কথায়, 'সমস্যা সমাধান না হলে আগামী ডিসেম্বর থেকে এর প্রভাব পড়তে পারে। একাধিক দেশ ও অঞ্চল ভারতে তৈরি ওষুধের উপর নির্ভরশীল।'

এই পরিস্থিতিতে বিকল্প কী হতে পারে?

ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানেইজেশনের সভাপতি শরদ কুমার সারফের মতে, চিন থেকে তৈরি অত্য়াবশ্যকীয় নয় এমন পণ্য বয়কট করার সিদ্ধান্তটি ব্যক্তির উপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। অন্যদিকে, চিন থেকে আমদানিকৃত স্বল্পমূল্যের কাঁচামালের ক্ষেত্রে শুল্ক বৃদ্ধির মতো বাণিজ্য সম্পর্কিত পদক্ষেপগুলি সার্বিক নিষেধাজ্ঞার চেয়ে ভাল হবে।

সিআইআই-য়ের এক বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, বেশ কিছুগুরুত্বপূর্ণ ইলেকট্রনিক্স, যানবাহন এবং ওষুধের উপাদানের বিকল্প আমদানির উৎস হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, জাপান, মেক্সিকো এবং কিছু ইউরোপীয় দেশকে পরখ করা যেতে পারে। সম্ভবত এই বিকল্প উৎসগুলি থেকে কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেশি হতে পারে এবং প্রস্তুতকারীরা সেগুলি গ্রহণ করতে না পারলে উপোভোক্তাদের কাছে পৌঁছনো যেতে পারে।

ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানেইজেশনের (এফআইইও) মত অনুসারে, ভারতকে চিন ও হংকংয়ের সঙ্গে তার বাণিজ্যের সামগ্রিকতা খতিয়ে দেখতে হবে এবং তাদের উপর নির্ভরতা হ্রাস করার জন্য কিছু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হবে।

কেন্দ্রীয় সরকারের 'আত্মনির্ভর' প্রকল্প মন্ত্রকগুলোর অধীন বিভিন্ন শিল্পকে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করবে। ভারতে বিরাট অংশের ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ কার্যকরী হলে তা এ ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে হবে।

মোবাইল প্রস্তুতিতে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তৈরিতে স্বনির্ভরতার মাধ্যমে মোবাইল আমদানি নির্ভরতা কমানো সম্ভব। এফআইইও অনুসারে, ভারতীয় পুঁজির বিনিয়োগ, একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স ও টেলি যোগাযোগের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হওয়া যেতে পারে।

এফআইইও-র মত অনুসারে, শুল্ক বৃদ্ধি আমদানির বন্ধের বিকল্প হিসাবে পরিগনিত হতে পারে। আরও কার্যকর কৌশল হ'ল এমন একটি পদ্ধতি রূপায়ণ যা আমদানির তুলনায় ভারতীয় পন্য প্রস্তুতির ব্যয় হ্রাস করবে। এ ক্ষেত্রে আমদানির বদলে ভারতীয় যেসব পণ্য তৈরি হবে তার জন্য আকর্ষনীয় অর্থ সহায়তাও প্রয়োজন। এছাড়া, অন্যান্য উন্নত বাজার নির্ভর দেশ এবং যেসব রাষ্ট্রের চিন বিরোধী মনোভাব লক্ষ্য করা যায় তাদের চিহ্নিত করে কৌশলে রফতানি বৃদ্ধি করতে হবে প্রস্তুতকারীদের।

Read in English

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

india china standoff
Advertisment