সেনাবাহিনীতে মহিলা অফিসার: কী বলল সুপ্রিম কোর্ট

এই রায়ের প্রভাব পড়বে সেনাবাহিনীর মানবসম্পদ বিভাগেও, তাদের এবার এই রায় অনুযায়ী নিজেদের নীতি সম্পূর্ণ বদলাতে হবে।

এই রায়ের প্রভাব পড়বে সেনাবাহিনীর মানবসম্পদ বিভাগেও, তাদের এবার এই রায় অনুযায়ী নিজেদের নীতি সম্পূর্ণ বদলাতে হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Supreme Court Army Women

মনোভাবের বদল ঘটাতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট

সোমবার সুপ্রিম কোর্ট সেনাবাহিনীর ১০টি বিভাগে মহিলা অফিসারদের সর্ব বিষয়ে পুরুষদের সঙ্গে এক পংক্তিতে রাখার কথা ঘোষণা করেছেন। সরকারের দীর্ঘদিনের পুরনো আপত্তি সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। দিল্লি হাইকোর্টে প্রথমবার এই মামলা দায়ের হয় ২০০৩ সালে। ২০১০ সালে মহিলা অফিসারদের পক্ষে রায় দেওয়া হয়। কিন্তু সে নির্দেশ কখনওই বলবৎ তো হয়ইনি, উল্টে সরকার সুপ্রিম কোর্টে এই রায়কে চ্যালেঞ্জও জানিয়েছিল।

Advertisment

সেনাবাহিনীতে মহিলা- মামলার ইতিহাস

১৯৯২ সালে সেনাতে মহিলাদের নিয়োগ শুরু হয়। পাঁচ বছরের জন্য তাঁদের কয়েকটি বাছাই বিভাগে কমিশন করা হত। এর মধ্যে রয়েছে আর্মি এডুকেশন কর্পস, কর্পস অফ সিগন্যালস, ইন্টেলিজেন্স কর্পস ও কর্পস অফ ইঞ্জিনিয়রস। মহিলাদের বিশেষ প্রবেশ প্রকল্পে (WSES) এই নিয়োগে কমিশন পূর্ব একটি প্রশিক্ষণ পর্বও থাকত, যার সময়সীমা পুরুষদের এ ধরনের প্রকল্পের চেয়ে সংক্ষিপ্ত হত।

২০০৬ সালে WSES প্রকল্পের জায়গায় শর্ট সার্ভিস কমিশন (SSC) চালু হয়, যাতে মহিলা আধিকারিকদেরও নেওয়া হয়। এই কমিশন পর্বে মহিলাদের নেওয়া হত ১০ বছরের জন্য, যা ১৪ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। WSES আধিকারিকদের সুযোগ দেওয়া হত SSC প্রকল্পে চলে যাবার জন্য, বা তাঁরা পুরনো WSES প্রকল্পেও থেকে যেতে পারতেন। তবে যাই হোক না কেন, পূর্বোল্লিখিত বিভাগগুলি ছাড়া অন্য কোথাও তাঁরা কাজ করতে পারতেন না, অর্থাৎ ইনফ্যান্ট্রি ও সশস্ত্র বাহিনীতে কাজের সুযোগ তাঁদের ছিল না।

Advertisment

পুরুষ SSC অফিসাররা তাঁদের ১০ বছরের মেয়াদ শেষে স্থায়ী কমিশনে যেতে পারলেও মহিলা অফিসারদের কাছে সে সুযোগ থাকত না। ফলে তাঁদের কম্যান্ডে নিয়োগ করা হত না, এবং তাঁরা সরকারি পেনশনও পেতেন না, কারণ সরকারি পেনশন ২০ বছর চাকরি না করলে পাওয়া যায় না। নয়া প্রকল্পে মহিলা অফিসারদের প্রথম ব্যাচ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন ২০০৮ সালে।

আদালতের লড়াই

২০০৩ সালে, দিল্লি হাইকোর্টে একটি জনস্বার্ষ মামলা দায়ের করা হয়, যাতে মহিলা SSC আধিকারিকদের সেনাবাহিনীতে স্থায়ী কমিশনের জন্য আবেদন করা হয়। ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর মেজর লিনা গুরভ আরেকটি রিট পিটিশন দাখিল করেন, যার প্রাথমিক বিষয় ছিল সে বছরের গোড়ায় সার্কুলার মাফিক যেসব নির্দেশ ও শর্ত জারি করা হয়েছিল তাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং মহিলা অফিসারদের স্থায়ী কমিশনের দাবি।

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিরক্ষামন্ত্রক একটি নির্দেশ পাশ করে, যাতে বলা হয় SSC মহিলা অফিসারদের জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল বিভাগ ও আর্মি এডুকেশন কর্পস বিভাগে স্থায়ী কমিশন দেওয়া হতে পারে। দিল্লি হাইকোর্টে এই সার্কুলারকে চ্যালেঞ্জ জানান মেজর সন্ধ্যা যাদব ও অন্যান্যরা।

হাইকোর্টে একযোগে ২০০৩, ২০০৬ ও ২০০৮-এর চ্যালেঞ্জ শোনা হয়, এবং ২০১০ সালে আদালত তাদের নির্দেশ দেয়। বিমান বাহিনী ও সেনা বাহিনীর মহিলা অফিসাররা, যাঁরা SSC সম্পূর্ণ করেছেন এবং স্থায়ী কমিশন চেয়েও পাননি, তাঁরা এসএসসি-র পুরুষ অফিসারদের সমতুল্য বলে গণ্য হবেন বলে নির্দেশ দেয় আদালত। তবে এই সুবিধা কেবলমাত্র সেই সব মহিলা অফিসারদের পাবার কথা বলা হয় যাঁরা চাকরিতে থাকাকালীন হাইকোর্টে আবেদন করেছিলেন এবং রিট পিটিশন আদালতে স্থগিত থাকাকালীন অবসর নিয়েছিলেন। যেসব মহিলা অফিসাররা স্থায়ী কমিশনড অফিসারদের নির্ধারিত অন্তিম বয়ঃসীমায় পৌঁছননি, তাঁদের সমস্ত সুয়োগ সুবিধা সহ পুনর্বহাল করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

সরকার সুপ্রিম কোর্টে এই নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে, এবং যদিও হাইকোর্টের রায় স্থগিত রাখা হয়নি, তা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষামন্ত্রক এই নির্দেশ লাগু করেনি। মামলা চলাকালীনই প্রতিরক্ষামন্ত্রক ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এক নির্দেশে এসএসসি ভুক্ত মহিলা অফিসারদের পূর্বনির্ধারিত JAG ও AEC ছাড়াও সেনাবাহিনীর ৮টি বিভাগে স্থায়ী কমিশন দেওয়া হবে। কিন্তু তার জন্য কম্যান্ডে কোনও নিয়োগ করা হবে না, এবং তাঁরা কেবল স্টাফ হিসেবে চাকরি করতে পারবেন।

শুনানি চলাকালীন সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, মহিলা অফিসাররা ১৪ ছর চাকরি করলে তাঁদের স্থায়ী কমিশন দেওয়া হবে। যেসব মহিলা অফিসাররা ১৪ বছরের বেশি রয়েছেন তাণদের ২০ বছর পর্যন্ত কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে, তবে তাঁদের স্থায়ী কমিশনড হিসেবে গণ্য করা হবে না। কিন্তু তাঁরা পেনশন সমেত অবসর গ্রহণ করবেন এবং যাঁরা ২০ বছরের বেশি বাহিনীতে রয়েছেন তাঁদের অবসরের সময়ে তৎকাল পেনশন সংক্রান্ত সুবিধা দেওয়া হবে।

রায় ও তার প্রভাব

সুপ্রিম কোর্টে সরকার অন্য সওয়ালগুলিও তোলে, যার মাধ্যমে তারা স্থায়ী কমিশন নিয়ে নিজেদের অবস্থানের যাথার্থ্য প্রমাণ করতে চায়। তাদের সওয়ালের মধ্যে অবসরকালীন সুযোগসুবিধা, নীতি বিষয়ে বিচারবিভাগের পর্যালোচনার সীমাবদ্ধতা, পেশাগত সমস্যা, মহিলাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের কারণসমূহ, স্টাফ হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে মনোবৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতা প্রমুখ।

শীর্ষ আদালত এই সব যুক্তি খণ্ডন করে দেয়। বলা হয়, "এগুলি সবই লিঙ্গজনিত স্টিরিওটাইপ যার ভিত্তি হল সমাজস্বীকৃত লিঙ্গগত ভূমিকা, যা মহিলাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যসৃষ্টিকারী।" আদালত একইসঙ্গে সেনাবাহিনীতে "সত্যিকারের সাম্য আনার জন্য মনোভাবের বদলের উপর জোর" দেয়।

বাহিনীর ১০টি বিভাগে চাকরির সময়কালের উপর নির্ভর করে নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত বৈষম্য নাকচ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, জানিয়ে দিয়েছে মহিলা ও পুরুষ অফিসারদের মধ্যে ভেদাভেদ নেই। তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল, মহিলা অফিসাররা কেবলমাত্র স্টাফ হিসেবে চাকরি করতে পারবেন, এই পুরনো নিয়মও তুলে দিয়েছে শীর্ষ আদালত।

এর অর্থ হল মহিলা অফিসাররা কম্যান্ড স্তরেও নিয়োগ পাবেন, যেমনটা পান পুরুষ অফিসাররা, যার জেরে তাঁদের সামনে আরও পদোন্নতির সুযোগ থাকবে। কেবলমাত্র স্টাফ পদে কাজ করলে তাঁরা কর্নেল পদের উপরে উঠতে পারতেন না।

একই সঙ্গে জুনিয়র পদ ও কেরিয়ার কোর্সে মহিলা অফিসাররা একই প্রশিক্ষণ পেতে পারবেন এবং কঠিন পদে নিয়োজিত হতে পারবেন, যা পদোন্নতির জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।

সেনাবাহিনী সরকারিভাবে সন্ধে পর্যন্ত এ রায় নিয়ে কথা বলেনি, যদিও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। এই রায়ের প্রভাব পড়বে সেনাবাহিনীর মানবসম্পদ বিভাগেও, তাদের এবার এই রায় অনুযায়ী নিজেদের নীতি সম্পূর্ণ বদলাতে হবে।

কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হবে সেনাবাহিনীর নিচের তলার সংস্কৃতি, নিয়মকানুন এবং মূল্যবোধে, যার দায়িত্ব বরিষ্ঠ সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের। সুপ্রিম কোর্টের এ হেন প্রগতিশীল সিদ্ধান্তের পর তাদের সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই।

supreme court