বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় সংকলিত 'সংসদ বাংলা নাট্য অভিধান' (২০০০) অনুযায়ী বেঙ্গল থিয়েটার "বর্তমানে যেখানে বিডন স্ট্রিট পোস্টঅফিস সেই জমিতে ধনকুবের আশুতোষ দেবের(সাতুবাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ (১৮৩৪-১৮৮০) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত (১৬.৮.১৮৭৩)।" এবং কবি মাইকেল মধুসদন দত্তের পরামর্শে "এইখানেই প্রথম বাংলার সাধারণ রঙ্গালয়ে অভিনেত্রী নিয়োগ হয়।" এবছর গত ১৬ অগস্ট এই ঐতিহাসিক ঘটনার ১৪৯ তম বর্ষপূ্তি হয়ে দেড়শো বছরে পা পড়ল। এই উপলক্ষ্যে আসুন একটু ফিরে দেখা যাক ইতিহাস কী বলছে?
বেঙ্গল থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের প্রসঙ্গে লেখক-গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য সাধক চরিতমালার ২৩ নং গ্রন্থ 'মধুসূদন দত্ত' (১৯৪৩) তে লিখেছেন – “১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দের শেষ ভাগে কয়েক জন ধনী মিলিয়া কলিকাতায় একটি ইংরেজি ধরণের সাধারণ রঙ্গালয় স্থাপনের সংকল্প করেন। ইহারই নাম বেঙ্গল থিয়েটার। ছাতুবাবুর দৌহিত্র শরচ্চন্দ্র ঘোষ ইহার ম্যানেজার ছিলেন। থিয়েটারের উদ্যোক্তারা নানা বিষয়ে মধুসূদনের পরামর্শ লইতেন। অমৃতলাল বসু তাঁহার স্মৃতিকথায় বলিয়াছেন :- মাইকেল মধুসূদনের পরামর্শে থিয়েটরে অভিনেত্রী লওয়া স্থির হইল। তিনি বলিলেন ‘তোমরা স্ত্রীলোক লইয়া থিয়েটর খোল; আমি তোমাদের জন্য নাটক রচনা করিয়া দিব; স্ত্রীলোক না লইলে কিছুতেই ভাল হইবে না।’… ইতিপূর্ব্বে সাধারণ রঙ্গালয়ে স্ত্রীলোকের ভূমিকা পুরুষ কর্তৃকই অভিনীত হইত। মধুসূদনেরই পরামর্শে এই নূতন নাট্যশালায় সর্ব্বপ্রথম অভিনেত্রী নিযুক্ত করা হইয়াছিল। মধুসূদনের ‘শর্ম্মির্ষ্ঠা নাটক’ লইয়াই বেঙ্গল থিয়েটার প্রথম আসরে অবতীর্ণ হন,…”। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পরেই উল্লেখ করেন যে, বেঙ্গল থিয়েটার এই নাটক নিয়ে পথ চলা শুরু করে ১৬ অগস্ট ১৮৭৩ তারিখে।
'সংসদ বাংলা নাট্য অভিধান' (২০০০) এ বেঙ্গল থিয়েটারের এই অভিনেত্রীদের নামপরিচয় পাওয়া যায়, “মাইকেল মধুসূদন দত্তের পরামর্শে কর্তৃপক্ষ জগত্তারিণী, এলোকেশী, শ্যামা ও গোলাপ নামে চারজন বারাঙ্গনাকে অভিনেত্রী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়।” এবং এই রঙ্গালয়টি “প্রতিষ্ঠার জন্য জনপ্রতি হাজার টাকার শেয়ার বিক্রি করে আঠারো হাজার টাকা মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছিল। হাটখোলার মহাজনদের অনেকে শেয়ার কিনেছিলেন। লিউইসের লাইসিয়াম থিয়েটারের ধাঁচে থিয়েটার-বাড়ি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল পাঁচ হাজার টাকা।” ভাবা যায়? প্রায় দেড়শো বছর আগে যেখানে থিয়েটারে প্রথম অভিনেত্রী নিয়োগের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল, তার কী আড়ম্বর ছিল? এবং বাঙালি হিসাবে আরওই গর্ববোধ হয় যখন জানা যায় যে যার পরামর্শে এমন বৈপ্লবিক ঘটনা ঘটেছিল তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনীকার গোলাম মুরশিদ তার ‘আশার ছলনে ভুলি’ (১৯৯৫) গ্রন্থে জানিয়েছেন, কবি পরে এই বেঙ্গল থিয়েটারের জন্য ‘মায়া কানন’ নামে একটা নাটক লিখে যান।
আরও পড়ুন Tower of Silence: কলকাতায় অবলুপ্তির পথে পার্সিদের সৎকারের ভূমি, কিন্তু কেন?
বেঙ্গল থিয়েটারে হওয়া এই ঐতিহাসিক ঘটনার বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা কথা বলেছিল নাট্যকার তীর্থঙ্কর চন্দের সঙ্গে। তিনি বলেন, “নিঃসন্দেহে সেটা তো একটা একেবারে মোড় ফিরিয়ে দেওয়ার মতো কাজ। বিদ্যাসাগরমশাই নিজেও তার বিরোধিতা করেছিলেন এবং কর্তৃপক্ষ কমিটি ছেড়ে চলে এসেছিলেন কিন্তু মধুসূদনের যেটা জোর ছিল সেটা তো একেবারেই ওনার পড়াশুনা, চারপাশটাকে দেখা আর তিনি নিজে বিলেতে যা সব দেখেছেন সব মিলিয়ে ওনার ভেতরে যে জোর ছিল সেটা থেকে উনি ওই কাজটা করেছিলেন। এখন এই কথাটা সবাই আমরা জানি। সত্যি সত্যিই ওই সময়ে এই কাজটা করার যে সাহস এবং যে দূরদর্শিতা মধুসূদন দেখিয়েছিলেন সেইটা আমাদের কাছে একটা আশীর্বাদ হয়ে আছে যারা পরে আমরা থিয়েটার করেছি। এবং তার পর থেকে তো আস্তে আস্তে আমরা সবাই সেটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়েছি, কোথাও হয়তো একটু দেরি হয়েছে যেমন, কলকাতায় ১৮৭৩ এ এমন যুগান্তকারী কাজ হলেও এইটা বলতে পারি যে, আমার বাড়ি তো আসামে, আমাদের এখানে শিলচরে ১৮৭৩ এর ধরুন প্রায় ষাট-সত্তর বছর পরে এই পরিবর্তন আসে। আমার এখনও মনে আছে আমাদের ছোটবেলাতেও এখানে কিছু যাত্রা থিয়েটারে কিন্তু পুরুষরাই মহিলা চরিত্রে অভিনয় করতো। তবে কী কলকাতা কী শিলচর সাম্প্রতিককালে তো মহিলারাই অভিনয় করেন, একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে যেটা বলার সেটা হল, যে ডমিনেন্সটা আগে পুরুষ অভিনেতারা দেখিয়েছেন বা পরিচালকেরা দেখিয়েছেন, শহর কলকাতাতে এখনও অনেক মহিলা পরিচালক; আমরা পরিচালক বললে এখনও তার আগে ‘মহিলা’ শব্দটা জুড়ে দিয়ে তাকে আলাদা করি, তো সেইরকমভাবেও দেখা গেছে যে এখনও কিন্তু মহিলারা অভিনয় করেন ঠিকই কিন্তু একধরনের একটা ডমিনেন্স সেইটা পুরুষ পরিচালকদের থাকেই। আমরা যারা হালিশহর কাঁচরাপাড়া তথা মফঃস্বলে থিয়েটার করি আমরা সেখানেও এই একই জিনিস দেখতে পাই। কিন্তু যে পরিপ্রেক্ষিতে বা যে জোরের জায়গা থেকে মধুসূদন একটা ব্যবস্থাকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, সেটা অনেকটাই পাল্টে গেছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথাও যেন এখনও সেইরকম একটা মর্যাদা যেটা মহিলাদের দেওয়া উচিত সেইটা বোধহয় আমরা সর্বত্র দিয়ে উঠতে পারিনি। এখনও আমরা যারা নাটক লিখি তাদের কাছে অনুরোধ আসে যে একজন বা দুজনের বেশি নারী চরিত্র রাখবেন না। ধরুন, খুব ভালো হয় যদি সুলতানা রিজিয়াকে নিয়ে এমন নাটক লেখা যায় যেখানে রিজিয়া চরিত্রটাই নেই। অবস্থাটা এমন জায়গাতেই এসে দাঁড়িয়েছে।”
আরও পড়ুন স্বাধীনতার পরেও কলকাতায় উড়ত ব্রিটিশ ‘ইউনিয়ন জ্যাক’!
সবশেষে নাট্যকার চন্দ এই ঐতিহাসিক ঘটনার দেড়শো বছরে পা পড়ার উপলক্ষ্যে কয়েকটা প্রশ্ন আর কিছু সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তিনি বলেন “মধুসূদন যে মহিলাদের দিয়ে অভিনয় করানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন সেটা শুধু যেমন অভিনেত্রী হিসাবেও, তেমনই এর পাশাপাশি ওদের একটা সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার কথাও তাঁর মাথায় ছিল। এই যে সামাজিক স্বীকৃতির ব্যাপারটা, এটা শহর কলকাতা বাদ দিয়ে গোটা বাংলা জুড়ে যে অভিনেত্রীরা আছেন, তারা কি তা পেয়েছেন? এই দেড়শো বছর পরে দাঁড়িয়ে আমাদের এটাও কিন্তু একটু ভেবে দেখার যে, আমরা মধুসূদনের চিন্তাধারাকে পাথেয় করে ঠিক কতটা এগোতে পেরেছি। আর আমি আশা রাখি, সামনের বছর যখন এই ঐতিহাসিক ঘটনার দেড়শো বছর পূর্ণ হবে তখন নিশ্চয়ই বাংলা থিয়েটার তা ভুলে যাবে না। হয়তো এমন একটা দল আমরা দেখতে পাবো যেটা শুধু মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হবে, বা সেখানে শুধু মহিলারা অভিনয় করবেন। কিংবা হয়তো নাট্যোৎসব বা অন্যান্য উপায়ে এই দিন স্মরণ করা হবে, কিন্তু এই উদযাপনের হিড়িক চলে গেলে বাঙালি তথা বাংলা থিয়েটার যদি এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপকে ভুলে যায় এই আশঙ্কাও আমার মনে একইভাবে বেদনা দেয়।”