Advertisment

কার্গিলের কুড়ি বছর: 'অভিনন্দনের বেলায় সরকারের যে আগ্রাসন দেখলাম, আমাদের বেলায় দেখি নি'

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে জীবিত অবস্থায় ১৫ মে, ১৯৯৯-এ ধরা পড়েন ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া, এবং পরবর্তী কয়েকদিন ধরে তাঁর ওপর চালানো হয় অকথ্য, অকল্পনীয় অত্যাচার।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kargil war 20 years

কার্গিল যুদ্ধে প্রয়াত ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার পরিবার। ছবি: গুরমীত সিং, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

১৯ ফেব্রুয়ারি্‌ ১৯৯৯: 'আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ২০ ফেব্রুয়ারি শান্তি আলোচনা করতে পাকিস্তান যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বিএসএফ আমাদের জানিয়েছে যে পাক সেনা একটি ইন্ডিয়ান পোস্ট আক্রমণ করেছে, যদিও ইন্ডিয়ান সেনা আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে...'

Advertisment

২ মার্চ, ১৯৯৯: 'ব্রিগেড এবং ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে হোলি উৎসব হলো। পাকিরা হোলির শুভেচ্ছা জানাল সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত ১৮০ রাউন্ড মিডিয়াম আর্টিলারি ছুড়ে। তামুর আর চোর নালার বন্দুকগুলো খোলা হলো...'

১৯৯৯ সালের শীত এবং বসন্তকাল জুড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে কার্গিলে যা ঘটছিল, তার সংক্ষিপ্ত অথচ প্রাঞ্জল বিবরণ পাওয়া যায় ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়ার হাতে লেখা ডায়েরি থেকে।

৪ জাট রেজিমেন্টের (ইনফ্যান্ট্রি) অফিসার হিসেবে ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মাত্র দু'মাস পরেই কার্গিলে মোতায়েন হলেন সৌরভ। তিনি এবং আরও পাঁচজন সতীর্থ স্বেচ্ছায় ১৪.০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কাকসার এলাকার বজরং পোস্টে যেতে চাইলেন, ভারতের মাটিতে অনুপ্রবেশ ঘটেছে কিনা দেখতে।

সেই যাওয়ার যা পরিণতি হয়েছিল, তা আজও শিরদাঁড়া দিয়ে শিহরণ বইয়ে দেয়।

kargil war 20 years

মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো সৌরভ কথা বলেন ৩০ এপ্রিল, ১৯৯৯ সালে

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে জীবিত অবস্থায় ১৫ মে, ১৯৯৯-এ ধরা পড়েন ক্যাপ্টেন কালিয়া, এবং পরবর্তী কয়েকদিন ধরে তাঁর ওপর চালানো হয় অকথ্য, অকল্পনীয় অত্যাচার। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, তাঁর সারা শরীরে ছিল সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ, দুই চোখ ওপড়ানো, সেগুলিতে ছিদ্র করা, বহু হাড় এবং দাঁত ভাঙা, নখ ছাঁটা, মুখমণ্ডল সম্পূর্ণ বিকৃত। এবং এসব তাঁকে গুলি করে মারার আগে।

তাঁর পরিবারের কথায়, ২২ দিন পর অর্থাৎ ৯ জুন যখন তাঁর দেহ ফেরত আসে, তখন আর চেনার উপায় নেই।

আজ পর্যন্ত এই ভয়াবহতার দায় স্বীকার করেনি পাকিস্তান, বরং একে "ভারতীয় প্রচার" বলে এসেছে। এবং আজ পর্যন্ত পুত্রের প্রতি ন্যায় বিচারের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ৭০ বছর বয়সী এন কে কালিয়া।

গত কুড়ি বছরে পাঁচশোরও বেশি চিঠি এবং ই-মেইল পাঠিয়েছেন তিনি, কিন্তু কালিয়ার বক্তব্য, দিল্লিতে যে সরকারই থাকুক, কেউ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খোলাখুলি জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করার অভিযোগ আনে নি, বরং "সৌরভের ঘটনার পরেও একই কাজ করে চলেছে তারা"।

kargil war 20 years

১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় জওয়ানদের সঙ্গে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। এক্সপ্রেস আর্কাইভের ছবি

কালিয়া আরও বলেন, "আমি বেঁচে থাকতে এই লড়াই শেষ হবে না। স্রেফ আমার ছেলের জন্য নয়, সমস্ত যুদ্ধবন্দীদের জন্য। কেন ওই দেশের (পাকিস্তানের) বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার মতো কেউ নেই? আমার ছেলের সঙ্গে যা করা হয়েছে, তা অমানবিক। কিন্তু তার পরেও তো আমাদের সৈনিকদের মাথা কেটে ফেরত দেওয়া হয়েছে।"

সুপ্রিম কোর্টে অদ্যাবধি অমীমাংসিত অবস্থায় ঝুলে রয়েছে তাঁর আবেদন।

কুড়ি বছর ধরে একের পর এক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, রাষ্ট্রদূত, বিদেশমন্ত্রী, এমনকি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকেও চিঠি লিখে চলেছেন কালিয়া। তিনি বলেন, "আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই জোটে নি।" তাঁর অভিযোগ, রাজনৈতিক রঙ যাই হোক, কোনও সরকারই "সহানুভূতি বা গুরুত্ব" দিয়ে বিষয়টিকে দেখে নি। কালিয়ার কথায়, "এটা শুধু আমার ছেলের প্রশ্ন নয়। এটা সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীর সম্মানের প্রশ্ন। এটা পাকিস্তানের মুখোশ খুলে দেওয়ার প্রশ্ন। ওরা আজ পর্যন্ত মেনে নেয় নি যে ওকে ওরা এত বীভৎসভাবে অত্যাচার করে মেরেছে।"

kargil war 20 years

পালমপুরে তাঁদের বাড়িতে ক্যাপ্টেন কালিয়ার বাবা-মা

হিমাচল প্রদেশে কাংড়া জেলায় পালমপুরের সৌরভ নগর এলাকায় সৌরভদের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, একটি ঘরে তাঁর পরিবার একটি মিনি জাদুঘর বানিয়েছেন, নাম 'সৌরভ স্মৃতি কক্ষ'। সেখানে সযত্নে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন ক্যাপ্টেন কালিয়ার হরেক স্মৃতি - ফোটোগ্রাফ, ডায়েরি, বই, উর্দি, টুপি, পোস্টার, বজরং পোস্ট থেকে আনা মাটি, এবং সৌরভের প্রিয় আরও অনেক কিছু।

ঘরটি আমাদের ঘুরে দেখাল ১৩ বছরের পার্থ কালিয়া, যার কাছে তার জেঠু স্রেফ তার জন্মের বহুকাল আগে মৃত এক আত্মীয় নন, বরং তার হিরো। "উনি আমার রোল মডেল। উনিই প্রথম অফিসার যিনি কার্গিলে পাকিস্তানিদের ঢুকে আসার খবর দেন। ওঁকে টর্চার করে মারা হয়। আমার দাদু আর বাবা ওঁর হয়ে বিচারের জন্য লড়ছেন। আমার এখনও কার্গিল যুদ্ধ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে..."

কিছুক্ষণ থেমে হঠাৎ পার্থ বলে, "পাখি দেখতে খুব ভালবাসতেন উনি।"

পার্থের বাবা, সৌরভের ছোট ভাই বৈভব কালিয়া (৪২), বলেন, "যে অবস্থায় আমার দাদাকে ফেরত দেওয়া হয়েছিল, জীবনে ভুলতে পারব না।" তাঁর বক্তব্য, তাঁদের লড়াই এটা নিশ্চিত করতে যে, "সৌরভের সঙ্গে যা হয়েছিল তা যেন আর কারও সঙ্গে না হয়"।

কিন্তু এখানেই বক্তব্যের শেষ নয় তাঁর। "আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে সৎভাবে, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করা হয়নি পাকিস্তানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার। চিঠি লেখা ছাড়া আমাদের করার আর কী আছে? এয়ার ফোর্সের উইং কম্যান্ডার অভিনন্দনের বেলায় সরকারের তরফে যে আগ্রাসী মনোভাব দেখলাম, তখন এরকমটা ছিল না। এখন আমাদের দেশ কূটনৈতিকভাবে আরও বেশি শক্তিশালী। এই আগ্রাসন যদি তখন দেখানো হতো, ওরা (পাকিস্তান) সাহস পেত না সৌরভের সঙ্গে ওরকম করার। উর্দি পরেন যাঁরা, তাঁদেরও তো মানবাধিকার আছে। আমাদের লড়াইটা সেখানেই - পাকিস্তানকে এসব নিয়ম মানতে বাধ্য করা।"

শেষবারের মতো মা বিজয় কালিয়ার সঙ্গে সৌরভ কথা বলেন ৩০ এপ্রিল, ১৯৯৯। "ও বলে, 'অনেক দূরে যাচ্ছি পোস্টিং নিয়ে, ফোন বা চিঠি না পেলে চিন্তা কোরো না।' আমার স্বামী শুধুমাত্র আমাদের সন্তানের জন্য লড়ছেন না। প্রতিটি সন্তানের জন্য লড়ছেন। এটা সেনার ইজ্জতের প্রশ্ন। আমরা আশা ছাড়ি নি, কতরকম আশ্চর্য ঘটনা তো ঘটে।"

কালিয়া বলেন, "আমি হেরে যাইনি। পাকিস্তানের আসল চেহারা সবাইকে দেখাতে পারাও আমার জিত। ওদের ডিএনএ'তে রয়েছে মিথ্যা বলা। আমার ছেলের পাশবিক মৃত্যু ওদের কাছে 'ভারতীয় প্রচার'। যতদিন না ওদের ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে (আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত) নিয়ে যাচ্ছি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য, ততদিন আমার শান্তি নেই।"

আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিউটিতে যাওয়ার আগে অমৃতসর স্টেশনে মাকে প্রণাম করে ক্যাপ্টেন কালিয়া বলে গিয়েছিলেন, "মা, এমন কিছু করে আসব যাতে আমার নামটা সবার মনে থাকে।"

"ঠিক কথা রেখেছে ও," বলেন বিজয় কালিয়া।

pakistan
Advertisment