Advertisment

নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব নাগরিক অধিকারের কথা নেই

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় শুরু হয়েছে সুজাত ভদ্রের কলাম, অধিকারের হৃদয় হতে। নির্বাচনী ইস্তেহারে যেসব অধিকার কথা ধরা পড়েনি, তা নিয়ে লিখলেন এই বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Sujato Bhadra, Sujato Bhadra

অলংকরণ- অরিত্র দে

সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচন শুরু হওয়ার অব্যবহিত আগে বিজেপির ইস্তেহার প্রকাশিত হয়েছে। এবার অবশ্য ২০১৪ সালের মত প্রচুর হৈচৈ হয়নি। অন্যদিকে কংগ্রেস এপ্রিল মাসের শুরুতেই ইস্তেহার প্রকাশ করেছে। এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের ইস্তেহার মার্চ মাসেই প্রকাশিত হয়েছে। কংগ্রেস দাবি করেছে, এক মাসের গবেষণা নানা স্তরের মানুষের সাথে কথা বলে, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে আর্থ-সামাজিক সমস্যার নিরসনে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা বাস্তবসম্মত ভাবে পালন করা সম্ভব। অন্যদিকে, বিজেপিও কংগ্রেসের মত দাবি করেছে, তাদের দলের ইস্তেহার "মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন"। কিন্তু সেই দাবির সত্যতা নিয়ে ধন্দে পড়ে যেতে হয়, যখন আমরা ভূমিকার শেষ অনুচ্ছেদটি পড়ি। তাতে বলা হচ্ছে, ইস্তেহারের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দূরদৃষ্টির সারসংক্ষেপ। নরেন্দ্র মোদীর "ভিশন" আর আপামর জনসাধারণের ইচ্ছা মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে।

Advertisment

জাতীয় স্তরে দুটি প্রধান প্রতিপক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে বাক-যুদ্ধে ব্যস্ত। প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়ে কটাক্ষ, তীব্র আক্রমণ আমরা শুনছি, দেখছি। কিছু প্রশ্নে মনে হয়েছে, কংগ্রেসের ইস্তেহারে গণতন্ত্রের কাঠামোকে, বুনিয়াদকে আরও শক্তিশালী করার উপর জোর দিয়েছে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং দলের সভাপতি অমিত শাহ সহ অন্যান্যদের বক্তব্যে সমরবাদের জয়ধ্বনি করা হচ্ছে, উগ্র, আগ্রাসী বীর রসে সিঞ্চিত এক জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে 'অপরপক্ষ' হিসাবে দেখিয়ে আক্রমণের বর্শামুখকে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন, আগামী সরকার হোক অনিশ্চিত সরকার

এই আবহে সিডিশন বা রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিলের কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতিকে নাগরিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের বহুদিনের দাবির প্রাথমিক স্বীকৃতি হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। বিজেপি এর বিরোধিতা করে বলছে, এই বাতিলের প্রতিশ্রুতি নাকি জাতীয়তাবিরোধী ভাবনা। সত্যিই কি তাই?

সিডিশন আইন তো ব্রিটিশ আমলের আইন, অর্থাৎ বাতিলের কথা তো উপনিবেশ-বিরোধী, এবং তা সব রংয়ের জাতীয়তাবাদীদেরও সোচ্চারে সমর্থন করা উচিত। কংগ্রেস আফস্পা-র পুনর্বিবেচনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজেপি "গেল গেল" রব তুলেছে, তারা এব্যাপারে জোরালোভাবে দুটি যুক্তি হাজির করছে।

এক) এলাকায় সৈন্যবাহিনীর যা-ইচ্ছে-করার ঢাল কেড়ে নেওয়া হবে এর ফলে।  ২০০৪ সালে মণিপুরে মনোরমার ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার পর মণিপুরের তথা ভারতের নাগরিক সমাজের তীব্র প্রতিবাদের চাপে পড়ে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার আফস্পা পুনর্বিবেচনা করার জন্য বিচারপতি জীবন রেড্ডি কমিশন বসিয়েছিল, কমিশন রিপোর্টও জমা দেয়। আজ পর্যন্ত সেই রিপোর্ট সরকারিভাবে দিনের আলো দেখেনি। সুতরাং আরেকবার পুনর্বিবেচনার প্রতিশ্রুতি মানে প্রত্যাহার নয়। যদিও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের দাবি, অবিলম্বে এ আইনের প্রত্যাহার।

দুই) এই পুনর্বিবেচনার প্রতিশ্রুতি নাকি অতীতের সঙ্গে বিচ্ছেদ, তাই বর্জনীয়। এটা একটা সমান্তরাল যুক্তির উদাহরণ। বিজেপি নিজেরাই দাবি করছে, ৭০ বছরের সব কিছু খারাপ- এখন নতুন ভারত নতুন নেতৃত্বে গড়ে উঠছে, পুরাতন সব বাদ। অন্যদিকে বিরোধী দল যখন অতীত থেকে সরে এসে নতুন কিছু দাবি করছে, তখন তাও মানছে না বিজেপি।

আরও পড়ুন, লোকসভা নির্বাচন ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

আফস্পায় বলীয়ান হয়ে অব্যাহতির সংস্কৃতির আড়ালে ভুয়ো সংঘর্ষের ঘটনা কাশ্মীরে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ঘটেই চলেছে। সুপ্রিম কোর্টও বহু বছর পরে কিছু ঘটনার বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতিকে সাধুবাদ জানিয়েও বলতে হবে, আফস্পা প্রত্যাহারের দাবি কিন্তু আজও অধরাই থেকে গেছে।

কোনও দলেরই ইস্তেহারে নেই দেশ থেকে চিরতরে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের প্রতিশ্রুতি, নেই বিলোপ সাপেক্ষে মৃত্যুদণ্ড রদ। নেই দেশ জুড়ে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির প্রশ্ন। ১৯৭৭ সালে বন্দীমুক্তির নিঃশর্ত প্রতিশ্রুতি পালন গণতন্ত্রের কাঠামোকে শক্তিশালী করেছিল। কারও ইস্তেহারে নেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত বন্দিদের সংশোধনের প্রক্রিয়ার পর মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি, সংশোধিত সমাজের মূল অংশে যুক্ত করা। নির্বাচনের প্রচারে সব দলের, বিশেষ করে বামদল সহ বিরোধীদের বক্তব্য এসেছে দেশ জুড়ে কৃষকদের দুরবস্থার কথা, অনাহারে মৃত্যুর কথা। সেভাবে আসছে না, কিন্তু শাসকদলের আনীত ২০০৬ সালের বনাঞ্চল বা অরণ্যাবাসীদের অধিকার সংক্রান্ত আইনের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর সংশোধনীগুলির বাতিলের কথা। ২০১৯ সালের এই সমস্ত সংশোধনী ব্রিটিশযুগের বনাঞ্চল সংক্রান্ত নিপীড়নমূলক ক্ষমতাকেই ফেরত নিয়ে আসছে, আবার অরণ্যবাসীরা তাদের অধিকার হারাবেন যদি সংশোধনীগুলি সংসদে গৃহীত হয়।

আরও পড়ুন, ভোট দিতে যাওয়ার আগে মনে রাখবেন…

পরিবেশরক্ষা, গঙ্গা দূষণ, বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে নদীর ভাঙন ইত্যাদি জ্বলন্ত সমস্যা আশানুরূপভাবে প্রতিফলিত হয়নি নির্বাচনের প্রচারে বা ইস্তেহারে। যা আশির দশকে শোনা যেত তাও আজ শোনা যায় না: অপদার্থ, দুর্নীতিগ্রস্ত, জনপ্রতিনিধিদের ফিরিয়ে আনার অধিকার। অথবা, একটি প্রতীকে জেতা জনপ্রতিনিধিদের দল বদলের ঘটনা ঘটলে তার জনপ্রতিনিধিত্ব বাতিল হওয়া এবং পুনরায় জিতে আসার আইন প্রণয়ন করা। কোনও দলেরই ইস্তেহারে এটার উল্লেখ পর্যন্ত নেই যে, সংসদে প্রস্তাবিত যে তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার সম্পর্কিত বিল পেশ হয়েছে তা তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার সুনিশ্চিত করার বদলে সংকোচন করেছে। ফলে এ বিল বাতিল বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতিও অনুল্লেখিত বা অশ্রুত রয়ে গেছে।

এসবই আজও নন-ইস্যু বা বড়জোর প্রান্তিক ইস্যু হিসেবেই থেকে যাচ্ছে।

(সুজাত ভদ্র মানবাধিকারকর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)

Human Rights General Election 2019
Advertisment