Advertisment

কংগ্রেসের কিছু চাল কি আগ্রাসী বিজেপির সুবিধে করে দিচ্ছে?

কেরলে অনেক মানুষ আছেন যারা বামেদের বিরোধী বলে কংগ্রেস আর কংগ্রেসের বিরোধী বলে বাম। তাদের ভোটগুলো এবার বিজেপির ঝুলিতে গেলে তার দায় রাহুল গান্ধীর নম্র ভাষণকেই নিতে হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
rahul gandhi, Narendra Modi

বিজেপির শেষ বাজেটের থেকেও কিছুটা বেশি বামপন্থী প্রতিশ্রুতি শোনাতে পেরেছে কংগ্রেস

নির্বাচনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিজেপি আগ্রাসী। এতে দোষের কিছু নেই। সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করলে সবসময় যে সংসদীয় কিংবা ক্রিকেটিয় ভাবভঙ্গি নিয়ে প্রচার করতে হবে এমন কথা কেউ লিখে দিয়ে যায় নি। ফলে জল বাতাসা, নকুলদানা, নুন ছড়ানো, ঢাক বাজানো এই সমস্ত বিষয়গুলো সঠিকভাবে পেশ করতে পারলে কিছুটা রাজনৈতিক জমি যে বাড়ানো যায় সে খবর রাজনীতির দুঁদে কারবারিদের কাছে সবসময় আছে। সে রাস্তা ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস নিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ শাসনকালে বাম নেতারাও এর বাইরে নন। শিবসেনার প্রচার তো চিরকালই ভীষণ আক্রমণাত্মক। জয়ললিতার নেতৃত্বে এআইডিএমকেও এই পথের পথিক। ভারতের রাজনীতিতে এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে। হিন্দি বলয়ের তিন বিধানসভায় হারার পর এ বছরের শুরুতে পেছনের পায়ে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় খেলা বিজেপি একেবারে সঠিক সময়ে আগ্রাসী ভূমিকা নিতে পেরেছে। তার একটা বড় কারণ অবশ্যই পুলওয়ামার ঘটনা। সেই ঘটনাকে ভিত্তি করে পড়শি দেশের জঙ্গি ঘাঁটি আক্রমণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পুরনো যুদ্ধবিমানের লড়াইয়ের কাহিনী মিলেমিশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে নতুন কিনতে যাওয়া রাফায়েলের দাম নিয়ে গণ্ডগোল সংবাদপত্রের পাতা থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন। বিরোধীরা কিছু বলতে গেলেই তাতে দেশবিরোধী তকমা লাগিয়ে দেওয়া সহজ হচ্ছে অনেক। বিজেপি রাজত্বের শেষের দিকে যে বিষয়গুলো তাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল, সেগুলো আপাতত দেশের মানুষকে কিছুটা ভুলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছে তারা। নোটবাতিল নিয়ে বিরোধীদের প্রচারের ধার কমেছে অনেকটা। ভালো খারাপের তর্ক অনেক জটিল, আপাতত লোকসভা নির্বাচনে জয় পরাজয়ের অঙ্কে আগ্রাসী বিজেপির সুবিধে যথেষ্ট। শেষ বাজেটে শ্রমিকদের ভবিষ্যনিধি কিংবা কৃষকদের তিন দফায় দু হাজার করে টাকা, সেসব আর বিজেপির প্রচারে খুব বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে না। বরং বিভিন্ন মাত্রার জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্ব প্রচারে ফিরে আসছে অত্যন্ত সুচতুর উপায়ে।

Advertisment

আরও পড়ুন, অক্সফোর্ডে ঠাঁই: জাতে উঠল ‘চাড্ডি’

আর হিন্দুত্ব সংক্রান্ত সেই অস্ত্র তাদের হাতে অনেক সময়েই তুলে দিচ্ছে কংগ্রেস, যে কথায় আমরা সবশেষে বিশদে আলোচনা করব। তবে এর মূল কারণ কংগ্রেস নিজের অবস্থান স্থির রাখতে পারছে না। বিজেপির যেহেতু একটা উগ্র ডানপন্থী ভাবধারা আছে, তাই তাকে রুখতে গেলে মধ্য আর বামের মাঝামাঝি একটা জায়গায় নিজেদের জমি ধরে রাখার চেষ্টা করাটা কংগ্রেসের পক্ষে বেশ যুক্তিযুক্ত। স্বাধীনতার পর থেকে সেটাই তাদের রাজনীতি। এবারেও বামেদের সঙ্গে দহরম মহরম রেখে বাঁদিকের ঢালটা মসৃণ রেখেছিল তারা। বিজেপি বিরোধী জোটের বিভিন্ন মধ্য ধারার সমাবেশেও তাদের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছে মানুষ। গত বছর দুই ধরে দেশজোড়া কৃষক আন্দোলন সংগঠনে খুব একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন না করলেও, সেই সমস্ত আন্দোলনের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে রাহুল গান্ধীর দল। হিন্দি বলয়ের তিন রাজ্যে ভোটে জিতে কৃষি ঋণ মুকুবে একেবারে দেরী করে নি কংগ্রেস। তাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে ঋণখেলাপী চাষিদের ফৌজদারী অপরাধের ধারা থেকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘোষিত হয়েছে, আলোচিত হয়েছে ইতিবাচক কৃষি বাজেটের প্রসঙ্গ। যুবনেতার বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে সর্বজনীন ন্যূনতম আয়ের (ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম) প্রতিশ্রুতি। সব মিলিয়ে বিজেপির শেষ বাজেটের থেকেও কিছুটা বেশি বামপন্থী প্রতিশ্রুতি শোনাতে পেরেছে কংগ্রেস। বাস্তবায়ন কতটা হবে সে সমস্ত পরিসংখ্যান ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে দেশজুড়ে বামপন্থী দলগুলোর আসন কমলেও তাদের আন্দোলনের ধার যে কমেনি তা বোঝা যাচ্ছিল বিজেপি কিংবা কংগ্রেসের মুখে বারবার বামপন্থী কথাবার্তা শুনে।



পুলওয়ামা ঘটে যেতেই বিজেপির প্রচারে বাজেটের বামপন্থা ভ্যানিশ, পুরোটাই ডানপন্থী আগ্রাসন। আর কংগ্রেসের বাম ভাবনা ঘেঁটে পান্তাভাত। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের সঙ্গে জোটের জটিলতায় কংগ্রেসের অযৌক্তিক দাবি উঠে এসেছে বারবার। এর মধ্যে হঠাৎ করে কেরালায় লড়তে গেছেন রাহুল গান্ধী। সেখানে আবার মহান নেতা ঘোষণা করেছেন তিনি প্রচারে বামেদের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলবেন না। এবার মুশকিলটা বোঝা যাক। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস দু-একটা আসন পেলেও, চতুর্মুখী লড়াইতে বর্তমান ভোটবিন্যাসে বামেদের আসন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং তুলনায় গোলমেলে ভোট ভাঙাভাঙির অঙ্কে আসন বাড়াতে পারে বিজেপি। কেরালাতে বাম কংগ্রেস লড়াই হবে সবাই জানে, কিন্তু সেখানে রাহুলের বক্তব্য অবশ্যই বিজেপির পালে হাওয়া দেবে। কারণ বিজেপি বলতেই পারে যে বাম কংগ্রেস আসলে মিথ্যে যুদ্ধ করছে, বিজেপিই মূল প্রতিপক্ষ। শবরীমালা মন্দিরের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে কেরালায় বিজেপি এর মধ্যেই বেশ খানিকটা অক্সিজেন পেয়েছে। সেখানে রাহুলের বাম বিরোধিতার মাত্রা কম রাখা অবশ্যই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কেরলে অনেক মানুষ আছেন যারা বামেদের বিরোধী বলে কংগ্রেস আর কংগ্রেসের বিরোধী বলে বাম। তাদের ভোটগুলো এবার বিজেপির ঝুলিতে গেলে তার দায় রাহুল গান্ধীর নম্র ভাষণকেই নিতে হবে। উত্তরপ্রদেশে রাহুল-প্রিয়াঙ্কার হইচই কংগ্রেসের আসন দুইয়ের থেকে বাড়াতে পারার সম্ভাবনা বেশ কম। কিন্তু ভোট কাটাকাটির অঙ্কে বিজেপি কিছুটা বেশি সুবিধে পেতে পারে। কংগ্রেস এখানে আসনও বেশি পাবে না, বরং নাক কাটতে পারে সপা-বসপার। আজ থেকে মাসখানেক আগের লেখায় কংগ্রেসের জোট কৌশলকে যতটা যুক্তিযুক্ত

মনে হয়েছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কিন্তু তাদের আর বেশি নম্বর দেওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন, গবেষণায় হস্তক্ষেপের চেষ্টা: ঈশানকোণে সিঁদুরে মেঘ

সবশেষে আসা যাক কংগ্রেসের হিন্দু-সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত প্রচারের কথায়। পয়লা এপ্রিলের সভায় মোদী মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এই শব্দবন্ধটি তামাম হিন্দুদের ওপর কলঙ্কলেপন। দুহাত দুপাশে পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে প্রসারিত করে তিনি বলেছেন, “জিসকো উনহোনে আতঙ্কবাদী কহা হ্যায়, উহ অব জাগ চুকে হ্যায়”। অর্থাৎ হিন্দু আতঙ্কবাদের প্রশ্নে জবাব এসেছে হিন্দু গণজাগরণের। ঠিক এই ধরনের একটা প্রচারই বিজেপির তুরুপের তাস। আর সেই তাস সময়মত বিজেপির হাতে তুলে দিল কংগ্রেস। অন্যভাবে বিজেপিকে কৃতিত্ব দিয়ে বলা যেতে পারে যে তাদের চিন্তনদল কংগ্রেসের ঠিক কোন কথাটার জবাব দিতে হবে সেটা বেছে নিয়েছে। কৃষকদের জন্যে কংগ্রেসের বামপন্থী ঘোষণাকে খুব বেশি ব্যঙ্গ করার ভুল বিজেপি করে নি, তারা শুধু মনে করিয়ে দিয়েছে যে এত বছর ক্ষমতায় থেকেও কংগ্রেসে দেশের গরীব মানুষের জন্যে খুব কিছু করে উঠতে পারে নি। এখানে বিজেপির প্রচার এইটুকুই, যা মৃদুমন্দ বাতাস মাত্র। কিন্তু বিভিন্ন জনসভায় বিজেপি ঝড় তুলছে হিন্দুত্বের প্রশ্নে, সন্ত্রাসবাদকে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে হিন্দু জাগরণের আবরণে জড়িয়ে। সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ মামলায় অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস পাওয়ার কথা বলেছেন নরেন্দ্র মোদী, বিঁধেছেন কংগ্রেসকে। সব মানুষ তো আর গভীরভাবে ভাবতে যাচ্ছেন না যে তথ্যটা কী?  ভোটপ্রচারে ধর্মের সুড়সুড়ি জায়গামত ব্যবহার করেছেন তিনি, যখন মনে করিয়ে দিয়েছেন যে কেরালার ওয়ানাড়ে প্রার্থী হয়েছেন রাহুল গান্ধী, কারণ সেখানে সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগুরু।



বিজেপির আগ্রাসন শুধু অন্য দলের বিরুদ্ধেই নয়। নিজের দলের মধ্যেও তার প্রমাণ যথেষ্ট। তারা প্রার্থী করতে চাইছে না পঁচাত্তরের বেশি বয়সের নেতা-নেত্রীদের। লালকৃষ্ণ আদবানি তো আগেই বাদ পড়েছেন, যেখানে অমিত শাহের গান্ধীনগরে প্রার্থী হওয়া একই আগ্রাসনের বার্তা দেয়। সবে ছিয়াত্তর ছুঁতে চলা বিদায়ী লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনেরও একই অবস্থা। ইন্দোর আসনে এখনও প্রার্থী ঘোষণা করে নি বিজেপি, আর সেই চাপ সহ্য করতে না পেরে হতাশ হয়ে নিজের থেকেই জানিয়েছেন যে তিনি প্রার্থী হতে চান না। একথা তো সত্যি যে দলকে উঠে নেমে সারা মাঠ জুড়ে আগ্রাসী ফুটবল খেলতে গেলে কম বয়সী খেলোয়াড়দেরই প্রয়োজন বেশি। দেখা যাক পঁচাত্তরের দাগ না ছোঁয়া সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ বিজেপি নেতৃত্বের আগ্রাসন এনডিএকে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছে দিতে পারে কিনা।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

CONGRESS lok sabha 2019 bjp
Advertisment