আর মাস দুয়েকের একটু বেশি সময় পরেই ভোট শেষ এবং গণনার কাজ শুরু। সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের সম্পূর্ণ নির্ঘন্ট প্রকাশ হয়ে গেছে। যেহেতু নির্বাচন চলবে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে, তাই একবার ভোট শুরু হয়ে গেলে বেশ অনেকগুলো দিন আর সমীক্ষার সুযোগ নেই। ফলে সামনের মাস খানেকের মধ্যেই ভোট পূর্ববর্তী অনুমানের কাজ সেরে ফেলবে বিভিন্ন সংস্থা এবং তাদের সহযোগী সংবাদমাধ্যম। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসবে গাদা গাদা সংখ্যা, যার কিছু কিছু নিজেদের মধ্যে মিলবে আবার কোথাও কোথাও সংখ্যাগুলো পেশ করবে পরস্পরবিরোধী মতামত। রাশিবিজ্ঞানের সঠিক নিয়ম মেনে সমীক্ষা হলে বিভিন্ন সংস্থার কয়েকটি বিষয়ের ওপর করা ভবিষ্যতবাণীতে মিল থাকার সম্ভাবনা খুব বেশি। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে যে সংস্থাই সেই পরিসংখ্যান পেশ করুন না কেন, পদ্ধতি ঠিক থাকলে আনুমানিক ভোট শতাংশের হিসেবে তাদের সবার ফলাফল খুব কাছাকাছি হওয়া উচিৎ। যেমন ধরুন সাম্প্রতিক সি-ভোটারের সমীক্ষা। তাতে বলা হয়েছে এনডিএ পাবে ৩১.১ শতাংশ ভোট এবং ইউপিএ ৩০.৯ শতাংশ। সংবাদে প্রকাশ যে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে। এই সমীক্ষা যদি পদ্ধতিগতভাবে ঠিক থাকে এবং অন্য কোন সংস্থাও যদি সঠিক নিয়মে আর একটি ভিন্ন সমীক্ষা একই সময়ে করে, তাহলে সেক্ষেত্রেও দেখা যাবে যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট এবং কংগ্রেস আর তার সহযোগীদের ভোট তিরিশ শতাংশের আশেপাশেই থাকবে।
এবার আসা যাক আসনের সংখ্যায়। এখানে কিন্তু সমীক্ষার পক্ষে খুব ভালো অনুমান পেশ করা অত্যন্ত শক্ত। আসনের হিসেব ঠিকঠাক পেতে গেলে দেশের পাঁচশো তেতাল্লিশটির প্রত্যেকটাতেই অন্তত হাজার চারেক মানুষের ওপর সমীক্ষা করতে হবে। সেটা যেহেতু এখনও কেউ করে নি, তাই ভোট শতাংশ থেকে আসনের সংখ্যায় যাওয়ার পথে অঙ্ক কম, ভাবনা বেশি। ভোট শতাংশ এবং আসন সংখ্যার মধ্যে হিসেব মোটেও সরলরৈখিক নয়, আর তাই ভোট শতাংশের হিসেব সমীক্ষায় ভালো মিললেও, আসনের নিরিখে গোলমাল হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। ভোট শতাংশের ওপর ভিত্তি করে গোণা আসনের সংখ্যার গোলমাল বেড়ে যায় যখন প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো ভোট শতাংশের হিসেবে খুব কাছাকাছি থাকে। সি-ভোটারের সমীক্ষা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে, যদিও তাদের মতে আসনে অনেকটা এগিয়ে থাকবে এনডিএ, তারা পেতে পারে ২৩৩টি আসন। ইউপিএ-র ক্ষেত্রে অনুমান ১৬৭ আর বাকি তৃতীয় পক্ষ ১৩০।
আরও পড়ুন, লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের জোট কৌশল
এ প্রসঙ্গে অবশ্যই পেশ করতে হবে সাম্প্রতিক মধ্য প্রদেশ এবং রাজস্থানের বিধানসভা ভোটের ফল। গত বছরের শেষ দিকে মধ্য প্রদেশে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪০.৯ শতাংশ ভোট, আসন ১১৪টি। বিজেপির ভোট শতাংশ ছিল সামান্য বেশি, ৪১.০, কিন্তু আসন কম, ১০৯। এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়, কারণ বিভিন্ন আসনের ভোট বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে সেই জায়গার জয় পরাজয়। ফলে কংগ্রেস যদি অল্প ব্যবধানে আসন জেতে, তাহলে তারা কম ভোট পেয়েও বেশি আসন দখল করতে পারে। তেমনটাই হয়েছে মধ্যপ্রদেশে। এবার দেখা যাক কী বলছে সি-ভোটারের অনুমান। সেখানে দেখা যাচ্ছে মধ্যপ্রদেশে ২৯টির মধ্যে ২৪টিতে জিতবে বিজেপি, আগের লোকসভায় যারা পেয়েছিল ২৬টি আসন। মুশকিল হচ্ছে এইখানেই। এটা বোঝা বেশ শক্ত যে সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনে যারা বিজেপি আর কংগ্রেসকে সমান সমান ভোট দিয়েছে, তারা কেন হঠাৎ লোকসভায় বিজেপিকে ঢেলে ভোট দিতে যাবে? তা না হলে বিজেপি এতো আসন পাবে কীভাবে? রাজস্থানে ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে সবকটা আসন পেয়েছিল বিজেপি, এবারের সমীক্ষা বলছে সেটা কমে হবে ২৪-এ ২০। এবার দেখা যাক সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনের ফল কি বলছে। এখানে ৩৯.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ১০০টি আসন জিতেছে কংগ্রেস, আর ৩৮.৮ শতাংশ ভোট পেয়ে ৭৩টি আসন বিজেপির। কোন মন্ত্রবলে বিজেপি সেখানে লোকসভায় এতগুলো আসন পাবে সে অঙ্ক কিন্তু সহজে মিলছে না।
কেরালার ফলাফল নিয়েও বেশ অদ্ভুত সংখ্যা এসেছে সমীক্ষায়। এখানে নাকি ২০টার মধ্যে ১৪টা আসনে জিতবে কংগ্রেস। অবশ্যই প্রায় তিন বছর হতে চলল বিধানসভা নির্বাচনের। বামফ্রন্ট সেই ভোটে পেয়েছিল ৪৩.৪৮ শতাংশ ভোট, আসন ৯১টি, কংগ্রেস ৩৮.৮১ শতাংশ ভোট, আসন ৪৭টি এবং বিজেপি ১৫.১০ শতাংশ ভোট, আসন ১টি। সেই নির্বাচনের পর থেকে আরও বিভিন্ন ছোটখাটো নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট কেটে বিজেপি বামফ্রন্টের সুবিধে করে দিয়েছে। শবরীমালা মন্দির সংক্রান্ত অশান্তিতে বাম আর বিজেপির মধ্যে লড়াই বেড়েছে অনেক বেশি। সেই জায়গায় কীভাবে কংগ্রেস ২০-র মধ্যে ১৪টি লোকসভা আসন পাবে সে অঙ্ক কিছুতেই মিলছে না। বোঝা যাচ্ছে না বিহারের অঙ্কও। এখানে সাম্প্রতিক সমস্ত উপনির্বাচনে বিজেপি আর নীতিশ কুমারের জোটের থেকে অনেক ভালো ফল করেছে আরজেডি। বারবার বোঝা গেছে যে পাটিগণিতের হিসেবে নীতিশের জেডিউ আর বিজেপির ভোট আদৌ পুরোপুরি যোগ হচ্ছে না, বরং রাজনীতির রসায়নে আরজেডি কিছুটা এগোচ্ছে। সেখানে সমীক্ষা জানাচ্ছে যে ৪০ আসনের লোকসভায় বিজেপি-জেডিইউ আগের বারের ২২ থেকে বেড়ে এবার ৩৬টা আসন পাবে। বেশ ভুরু কুঁচকে দেওয়ার মত সংখ্যা এগুলো। আসলে এই পরিসংখ্যানে সম্ভবত সবথেকে চিন্তায় পড়বে বিজেপি। কারণ এতদসত্ত্বেও সি-ভোটারের সমীক্ষা বলেছে উত্তরপ্রদেশে সপা-বসপা জোট হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। এবার মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান এবং বিহার মিলিয়ে ৯৩টি আসনে সমীক্ষা বিজেপি আর তার দলবলকে দিয়েছে ৮০টি আসন। এখান থেকে যদি তিরিশ-চল্লিশটা আসন কোনভাবে কমে যায় তাহলে অবশ্যই বিজেপির মহাবিপদ।
আরও পড়ুন, নির্বাচনে এবার জাতীয় নিরাপত্তা, না কৃষি সমস্যা?
আসলে মুশকিল হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের জন্যে চটজলদি সমীক্ষায় অনেক সময় সহজ কিছু নিয়ম মেনে চলার সময় থাকে না। সেক্ষেত্রে ভোট শতাংশ মোটামুটি সামলে নেওয়া গেলেও, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা না করে শুধু কিছু সংখ্যার খেলায় আসনের হিসেব করতে গেলে ভুলের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তবে তার মানেই এই নয় যে সি-ভোটারের এই সমীক্ষা মিলবে না। এমন হতেই পারে যে সাম্প্রতিক বিধানসভা কিংবা উপনির্বাচনের পর মানুষ আবার ফিরছেন বিজেপির দিকে। সীমান্তে অশান্তির পর জাতীয়তাবাদী চেতনা হয়ত বিজেপির প্রতি সমর্থন আরও বাড়িয়ে দেবে। তবে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা তো আর সমীক্ষার খাতায় লেখা থাকে না। পক্ষপাতহীনতার রাশিবিজ্ঞানে তাই রাজনীতির রসায়ন কতটা মিশে আছে সে খবর অজানাই থেকে যায়।
সবশেষে নজর দেওয়া যাক আমাদের রাজ্যে সমীক্ষার ফলাফলের দিকে। বলা হচ্ছে তৃণমূল পাবে ৪১% ভোট, বিজেপি ৩৫%, বাম ১৫% এবং কংগ্রেস ৮%। এ সমীক্ষা নাকি হয়েছিল বাম-কংগ্রেস জোট ঠিক হওয়ার আগে। আসনের হিসেবে বলা হচ্ছে ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল পেতে পারে ৩৪ আর বিজেপি ৮। ২০০৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বামেদের ভোট শতাংশ নিয়মিত কমছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবশ্যই বাড়ছে বিজেপির ভোট। তবে একটা বিষয় এবার মাথায় রাখার মত। তা হল বিজেপি কিন্তু প্রার্থী করছে অন্য দল ভেঙে আসা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে। নিজের দলের যে কর্মীরা গত কয়েক বছর ধরে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তুলনায় ভালো জায়গায় পৌঁছে দিয়েছেন, তার ফল ভোগ করতে চলেছেন মূলত তৃণমূলের টিকিট না পাওয়া কিছু রাজনীতিবিদ। রাজনীতি পেশা হিসেবে ধরলে দলবদল মেনে নিতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু রাজনীতির কল্পনাতেও মাঝে মাঝে নীতির কথা এসে পড়ে। সেই জায়গায় বিজেপি অন্যদলের নেতাদের নিজের দলের প্রার্থী করে কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে পারবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
সেই জায়গায় বাম-কংগ্রেস নিজেদের জোটের জট ছাড়িয়ে যদি কিছুমাত্র রাজনৈতিক পরিসর রক্ষা করতে পারে তাহলে তাদের ভোট হয়ত এতটা তলানিতে ঠেকবে না। আসনের সংখ্যায় তাদের পক্ষে খুব আশাব্যঞ্জক ফল না হলেও, এই দু-দলের ভোট ঠিক কোন অঙ্কে যোগ হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। গত বিধানসভার পরিসংখ্যান বলছে বামেদের ভোট বেশ ভালোভাবে হস্তান্তরিত হয়েছিল কংগ্রেসের দিকে, কিন্তু উল্টোটা ততটা ভালো হয় নি। তাই আসন জেতার থেকেও এবার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বাম প্রার্থীদের আসনে ভোট শতাংশের হিসেব। এই জোটের কোন দীর্ঘমেয়াদী সম্ভাবনা আছে কিনা সেই সংবাদ মিলবে সেই আসনগুলো থেকেই। আর কোনভাবে সি-ভোটারের সমীক্ষা যদি সত্যি হয় তাহলে এটা অনুমান করা যায় যে তৃণমূলের জনসমর্থন এই প্রথম সামান্য হলেও হ্রাস পাচ্ছে। গত বিধানসভায় তৃণমূলের ভোট ছিল ৪৪.৯১%, বামের ২৬.৩৬%, কংগ্রেসের ১২.২৫% আর বিজেপির ১০.২%। আসন ছিল তৃণমূলের ২১১, বামেদের ২৬, কংগ্রেসের ৪৪ আর বিজেপির ৩। বাম-কংগ্রেস থেকে এর মধ্যে বিভিন্ন পঞ্চায়েত, পৌরসভা বা অন্যান্য উপনির্বাচনে ভোট ভেঙেছে তৃণমূল এবং বিজেপির দিকে। তবে কখনোই ক্ষতি হয় নি তৃণমূলের। সি-ভোটারের সমীক্ষা কিন্তু এই প্রথম অন্য বার্তা দিচ্ছে। দলবদলের মরসুমে সি-ভোটারের সমীক্ষাকে ভুল প্রমাণিত করে বাম-কংগ্রেস এ রাজ্যে তাদের রাজনৈতিক পরিসর বজায় রাখতে পারলে বিরোধীদের ভোট কাটাকাটিতে সবথেকে লাভবান হবে তৃণমূল। তবে ভোটের বার্তা উপসংহারে কোন দিকে তার জন্যে অপেক্ষা এখনও দুমাসের থেকেও কয়েকদিন বেশি। ততদিন হোক-অনুমান আর প্রার্থনা চলুক শান্তিপূর্ণ এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)